গতবছরের ঈদযাত্রার তুলনায় এবারের ঈদুল ফিতরের যাত্রায় সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ৭৪ শতাংশ বেড়েছে বলে জানিয়েছে যাত্রী অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ। এবারের ঈদযাত্রায় দেশের সড়ক ও মহাসড়কে ২২৪টি সড়ক দুর্ঘটনা, এতে নিহত হয়েছেন ২৮৩ জন, আহত হয়েছেন ৩১৯ জন বলেও জানায় সংগঠনটি।
আজ শনিবার (২২ মে) গণমাধ্যমে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানিয়েছে যাত্রী অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ।
সংগঠনটির দুর্ঘটনা গবেষণা ও মনিটরিং সেলের সদস্যরা ১৩টি জাতীয় দৈনিক, সাতটি আঞ্চলিক দৈনিক ও ১০টি অনলাইন নিউজপোর্টালে প্রকাশিত সংবাদের তথ্য নিয়ে এ প্রতিবেদন তৈরি করে।
সংগঠনটির দুর্ঘটনা প্রতিবেদন বলছে, গতবছরের ঈদযাত্রার তুলনায় এবারের ঈদুল ফিতরের যাত্রায় নিহত বেড়েছে ৭৪ শতাংশ। ২০২০ সালের ঈদুল ফিতরে ১৪৩ সড়ক দুর্ঘটনায় ১৬২ জন নিহত ও ২৭১ জন আহত হয়েছিলেন।
সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মো. সামসুদ্দীন চৌধুরী স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে গতবছরের মতো এবছরও প্রথম রমজান থেকে ‘কঠোর লকডাউন’ ছিল সারাদেশে। গণপরিবহন বন্ধ থাকায় পণ্যপরিবহনে ব্যবহৃত যান ও ব্যক্তিগত পরিবহনে ঈদযাত্রা করলেও ঈদের আগে ও পরে সড়ক দুর্ঘটনা ছিল আগের তুলনায় বেশি।
যাত্রী অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের প্রতিবেদন বলছে, গত ৮ মে থেকে ২০ মে পর্যন্ত ১৩ দিনে ২২৪টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২৮৩ জন নিহত ও ৩১৯ জন আহত হয়েছেন। এ সময়ে রেলপথে ট্রেনে কাটা পড়ে একজন নিহত হয়। একই সময়ে নৌপথে বিচ্ছিন্ন দুর্ঘটনায় ছয় জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ৮ মে ২৬টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২৮ জন নিহত ও ১৯ জন আহত, ৯ মে ১৪টি দুর্ঘটনায় ১৫ জন নিহত ও ১৬ জন আহত, ১০ মে ১৬টি দুর্ঘটনায় ১৯ জন নিহত ও ১৭ জন আহত, ১১ মে ১৫টি দুর্ঘটনায় ১৫ জন নিহত ও ২৬ জন আহত হয়। ১২ মে থেকে ১৬ মে পর্যন্ত ৮০টি দুর্ঘটনায় ১০৮ জন নিহত ও ১৬৬ জন আহত হয়। ১৭ মে ২০টি দুর্ঘটনায় ২৭ নিহত ও ২৩ জন আহত, ১৮ মে ১৩টি দুর্ঘটনায় ১৫ জন নিহত ও ১০ জন আহত, ১৯ মে ২৩টি দুর্ঘটনায় ৩৪ নিহত ও ১২ জন আহত, ২০ মে ১৭টি দুর্ঘটনায় ২২ জন নিহত ও ৩০ জন আহত হয়। সর্বমোট ২২৪টি দুর্ঘটনায় নিহত হয় ২৮৩ জন আর আহত ৩১৯ জন।
যাত্রী অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের তথ্যমতে, ২০১৯ সালের ঈদুল ফিতরের ঈদযাত্রায় ১৮৫টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২২১ জন নিহত ও ৬৫২ জন আহত হয়েছিল। এছাড়া ২০২০ সালের ঈদুল ফিতরে ১৪৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় ১৬২ জন নিহত ও ২৭১ জন আহত হয়েছে। গতবছরের চেয়ে এবারের ঈদযাত্রায় নিহত ৭৪ শতাংশ সংখ্যা বেড়েছে।
পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, মোট যানবাহনের ১৯টি বাস-মিনিবাস; ৬৭টি ট্রাক-কাভার্ডভ্যান ও পিকআপ; ৩৪টি কার-মাইক্রো; ৪৫টি নছিমন-করিমন, ভটভটি-ইজিবাইক, অটোরিকশা; ৯৩টি মোটরসাইকেল; ১৭টি অন্য যানবাহন এসব দুর্ঘটনায় জড়িত ছিল।
দুর্ঘটনার ধরন বিশ্লেষণে দেখা যায়, ৬৩টি গাড়িচাপায়, ৮০টি সংঘর্ষ, ১৬টি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ে ও অন্যান্য কারণে ৬৫টি দুর্ঘটনা ঘটে।
যাত্রী অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে- লকডাউনে গণপরিবহন বন্ধ থাকায় ছোট যানবাহনে যাত্রীর চাপ, ফাঁকা রাস্তায় চালকদের প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব ও অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানো, অতিরিক্ত ভাড়া আদায়, অদক্ষ চালকের হাতে দৈনিক চুক্তিতে যানবাহন ভাড়া দেওয়া, ফিটনেসবিহীন যানবাহনে যাত্রী বহন, মহাসড়কে অটোরিকশা, ব্যাটারিচালিত রিকশা, নছিমন-করিমনের অবাধে চলাচল, বিপজ্জনক ওভারটেকিং, পণ্যপরিবহনের যানে ঝুঁকিপূর্ণভাবে যাত্রী বহন, যাত্রীদের ট্রাফিক আইন না মানার প্রবণতা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার অভাব এসব দুর্ঘটনার জন্য দায়ী। টিনএজারদের বেপরোয়া গতির মোটরসাইকেলও দুর্ঘটনার জন্য দায়ী।
এদিকে ঈদুল ফিতরের আগে ও পরে ১৪ দিনে দেশে ২৩৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩১৪ জন নিহত এবং ২৯১ জন আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন।
আজ শনিবার রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
এতে বলা হয়, গত ৭ থেকে ২০ মে পর্যন্ত সাতটি জাতীয় দৈনিক, পাঁচটি অনলাইন নিউজপোর্টাল এবং ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে।
সড়ক দুর্ঘটনার পাশাপাশি একই সময়ে চারটি নৌ দুর্ঘটনায় তিন জন ও একটি রেলপথ দুর্ঘটনায় একজনের মৃত্যু হয়।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, দুর্ঘটনাগুলোর ৯৪টি (৩৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ) জাতীয় মহাসড়কে, ৮৯টি (৩৭ দশমিক ২৩ শতাংশ) আঞ্চলিক সড়কে, ৩৪টি (১৪ দশমিক ২২ শতাংশ) গ্রামীণ সড়কে, ১৮টি (সাত দশমিক ৫৩ শতাংশ) শহরের সড়কে এবং চারটি (এক দশমিক ৬৭ শতাংশ) অন্যান্য স্থানে সংঘটিত হয়েছে।
সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা কবলিত হয়েছে ট্রাক, কাভার্ডভ্যান ও পিকআপ। সময় বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সকালে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে ২৮ দশমিক ৮৭ শতাংশ। এ ছাড়া, বিকেলে ২৩ শতাংশ, দুপুর ২২ দশমিক ৫৯ শতাংশ এবং রাতে ১১ দশমিক ৭১ শতাংশ।
বিভাগভিত্তিক পরিসংখ্যান বলছে, সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে ঢাকা বিভাগে ৩৩ দশমিক ৪৭ শতাংশ, রাজশাহীতে ১৬ দশমিক ৭৩, চট্টগ্রামে ১৪ দশমিক ৬৪, খুলনায় আট দশমিক ৭৮, বরিশালে ছয় দশমিক ৬৯, সিলেটে সাত দশমিক ৫৩, রংপুরে ছয় দশমিক ২৭ এবং ময়মনসিংহ বিভাগে পাঁচ দশমিক ৮৫ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটেছে।
দুর্ঘটনার কারণ হিসাবে সংগঠনটি বলছে, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন; বেপরোয়া গতি; চালকদের বেপরোয়া মানসিকতা, অদক্ষতা ও শারীরিক-মানসিক অসুস্থতা; বেতন ও কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট না থাকা; মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল; তরুণ ও যুবদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানো; জনসাধারণের মধ্যে ট্রাফিক আইন না জানা ও না মানার প্রবণতা; দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা; বিআরটিএ’র সক্ষমতার ঘাটতি; গণপরিবহন খাতে চাঁদাবাজি।
দুর্ঘটনা রোধে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের বেশ কয়েকটি সুপারিশ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে- দক্ষ চালক তৈরির উদ্যোগ বাড়াতে হবে; চালকের বেতন ও কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করতে হবে; বিআরটিএ’র সক্ষমতা বাড়াতে হবে; পরিবহনের মালিক-শ্রমিক, যাত্রী ও পথচারীদের প্রতি ট্রাফিক আইনের বাধাহীন প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে; মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল বন্ধ করে এগুলোর জন্য আলাদা পার্শ্বরাস্তা (সার্ভিস লেন) তৈরি করতে হবে; পর্যায়ক্রমে সব মহাসড়কে রোড ডিভাইডার নির্মাণ করতে হবে; গণপরিবহনে চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে; রেল ও নৌ-পথ সংস্কার ও সম্প্রসারণ করে সড়ক পথের ওপর চাপ কমাতে হবে; টেকসই পরিবহন কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে; ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’ বাধাহীনভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০০৮
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ