ফেনী থেকে চট্টগ্রামে ফুফুর বাসায় বেড়াতে এসে ধর্ষণের শিকার হয় এক স্কুলছাত্রী। এ ঘটনায় প্রধান অভিযুক্ত চান মিয়া ওরফে চান্দু। এলাকায় তাকে ‘পুলিশ সোর্স’ হিসেবে চেনেন সবাই। চলতি মাসে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে বোনের বাসায় বেড়াতে এসে খুন হন পঞ্চাশোর্ধ্ব গাড়িচালক আইয়ুব আলী। এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছয়জনের একজন বাবু ওরফে শাকিল। সেও ‘পুলিশ সোর্স’। শুধু এ দুটি ঘটনাই নয়, চাঁদাবাজি, ছিনতাই থেকে শুরু করে খুন-ধর্ষণের মতো ভয়ংকর সব অপরাধে জড়িত এসব সোর্স। পুলিশের সঙ্গে সখ্য থাকায় এরা কারও তোয়াক্কা করে না। নির্ভয়ে সব অপকর্ম করে বুক ফুলিয়ে চলে। এদের ভয়ে তটস্থ সাধারণ মানুষ। নানা উপায়ে মানুষকে হয়রানি করাই এদের কাজ। চট্টগ্রামের মানুষের কাছে এখন নতুন আতঙ্কের নাম হয়ে উঠেছে এই ‘পুলিশ সোর্স’। সংশ্নিষ্টদের অভিযোগ, কিছু পুলিশ সদস্যের আশ্রয়ে এসব অপরাধী বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এখনই লাগাম না টানলে তারা আরও ভয়ংকর হয়ে উঠবে। চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের উপকমিশনার ফারুক উল হক বলেন, ‘পুলিশ সদস্যরা কোনো ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে নানা মানুষের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে থাকে। যাদের কাছ থেকে তথ্য নেওয়া হয় নিরাপত্তার স্বার্থে তাদের পরিচয় প্রকাশ করা হয় না। যারা প্রকাশ্যে পুলিশের সোর্স পরিচয় দেয়, তারা অপরাধী। তাদের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান চলছে। পুলিশের সোর্স পরিচয় দিয়ে অপরাধ করে পার পাওয়ার সুযোগ নেই। পুলিশের কোনো সদস্যের যদি এ ধরনের অপরাধীর সঙ্গে সখ্যের প্রমাণ পাওয়া যায় তার বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অধ্যাপক ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘অপরাধীদের চিহ্নিত করতে পুলিশ সদস্যরা অনেককে সোর্স হিসেবে ব্যবহার করেন। এর মধ্যে পেশাদার অপরাধীও সোর্স হিসেবে কাজ করে, যারা অপরাধীদের চিহ্নিত করে দেওয়ার পাশাপাশি সাধারণ মানুষকেও হয়রানি করে। সোর্স বাছাইয়ে পুলিশের অবশ্যই সতর্ক হওয়া উচিত। প্রতিটি পেশায় কিছু অর্থলিপ্সু মানুষ থাকে। পুলিশের কিছু সদস্যও এসব সোর্সের মাধ্যমে মানুষকে হয়রানি করে। কর্তৃপক্ষের উচিত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া।’অনুসন্ধানে জানা যায়, গত রোববার নগরের ডবলমুরিং থানার আগ্রাবাদ ১ নম্বর সুপারিওয়ালাপাড়ায় নিজ বাসায় এক কিশোরীকে ধর্ষণ করে চান মিয়া নামে এক যুবক। আগ্রাবাদ এলাকায় পুলিশের সোর্স হিসেবে পরিচিত সে। তার বিরুদ্ধে একটি মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও রয়েছে। এর আগে তাকে গ্রেপ্তারে গিয়ে বাধার সম্মুখীনও হয় পুলিশ। ডবলমুরিং থানার চাকরিচ্যুত এসআই মো. হেলালের সোর্স হিসেবে কাজ করত সে। গত ১৬ জুলাই রাতে চান মিয়াসহ আরেকজন সোর্সকে সঙ্গে নিয়ে আগ্রাবাদের বাদামতলী মসজিদ গলিতে সালমান ইসলাম মারুফ নামে এক কিশোরকে ইয়াবা দিয়ে ফাঁসানোর চেষ্টা করে হেলাল। এ সময় তার মা-বোনকে মারধর করে তারা। এতে অপমানে আত্মহত্যা করে ওই কিশোর। পুলিশের তদন্তে এ ঘটনার সত্যতা পাওয়ায় এসআই হেলালকে চাকরিচ্যুত করা হয়।
মঙ্গলবার গ্রেপ্তারের পর ডবলমুরিং থানায় চান মিয়া সমকালকে বলে, ‘হেলাল স্যারের সোর্স হিসেবে কাজ করতাম। ওয়ারেন্টের লোকজনকে খুঁজে দিতাম। কেউ মাদক বিক্রি করলে দেখিয়ে দিতাম।’ নিজেও মাদক সেবন ও অসামাজিক কাজে লিপ্ত থাকার কথা স্বীকার করে সে।
গত ৪ সেপ্টেম্বর ফরিদপুরের নগরকান্দা উপজেলার কাশেম শরীফের ছেলে আইয়ুব আলী (৫৫) চট্টগ্রামের লালখানবাজারে বোনের বাড়িতে বেড়াতে আসেন। রাতে সেখান থেকে নগরের বারিক বিল্ডিংয়ে যাওয়ার পথে ছিনতাইকারীদের হাতে প্রাণ হারান তিনি। সিসিটিভি ফুটেজে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ধরা পড়ে। এ ঘটনায় জড়িত পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাদের মধ্যে একজন বাবু ওরফে শাকিল। সে সদরঘাট থানার সোর্স হিসেবে কাজ করত। বিভিন্ন সময় মাদক দিয়ে মানুষকে ফাঁসানোর অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
গুড মর্নিং ট্রান্সপোর্ট এজেন্সির চালক মো. মুন্না সমকালকে বলেন, ‘কয়েক মাস আগে সদরঘাটের কামাল গেটে ট্রাক পার্ক করে রেখেছিলাম। সেখানে তিন লিটার মদ রেখে আমাকে পুলিশের কাছে ধরিয়ে দেয় বাবু। সদরঘাট থানার এসআই হুমায়ুন ও ফয়েজ তাকে সোর্স হিসেবে ব্যবহার করতেন। পরে এসআই হুমায়ুনকে ২৫ হাজার টাকা দিয়ে ছাড়া পাই। হুমায়ুন ও ফয়েজ সদরঘাট থানা থেকে যাওয়ার পর এএসআই মাধব এখন তাকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেন।’ তবে অভিযোগ অস্বীকার করে সদরঘাট থানার এএসআই মাধব সমকালকে বলেন, ‘বাবুর সঙ্গে তার কোনো সখ্য নেই। সে কার সোর্স ছিল সদরঘাট থানার সবাই জানে।’
২০১৯ সালের জুলাইয়ে আগ্রাবাদের চৌমুহনী হোটেল হক টাওয়ারের এক পোশাককর্মীকে পুলিশ কনস্টেবল পদে চাকরি দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে তিন দিন আটকে রেখে ধর্ষণ করে শাহাদাত হোসেন রাজু। সে নোয়াখালী জেলার সুধারাম থানার ভাটিরটেক গ্রামের আবদুল মালেকের ছেলে। নগরের কদমতলী মোড়ে ট্রাফিক পুলিশের টেন্ডল (ট্রাফিক পুলিশের হয়ে গাড়ি থেকে চাঁদা তোলার কাজ) হিসেবে কাজ করত সে।নগরের বায়েজিদ বোস্তামী-ফৌজদারহাট সংযোগ সড়কের প্রবেশমুখ বাংলাবাজার। এখানে অন্তত ২৫০টি ভ্যান বসিয়ে চাঁদাবাজি করে পুলিশ সোর্স মো. মানিক। এছাড়া বায়েজিদ বোস্তামী থানার সোর্স হিসেবে বিভিন্ন জায়গায় চাঁদাবাজি করে মো. আকাশ। মানিক ভ্যান বসানোর কথা স্বীকার করলেও চাঁদাবাজির অভিযোগ অস্বীকার করে আকাশ। তার বক্তব্য- ‘ওসি স্যারের সঙ্গে প্রায় ১০-১২ বছরের পরিচয়। স্যারের বাসায় বাজারসদাই করে দেই। বিষয়টি অনেকে ভালো চোখে দেখেন না। তাই অপপ্রচার চালান। আমার বাসা থানার পাশে।’
এ প্রসঙ্গে বায়েজিদ বোস্তামী থানার ওসি প্রিটন সরকার বলেন, ‘থানার অফিসারদের বাজারসদাই করে দেয় আকাশ। এ ধরনের কোনো কিছুর সঙ্গে সে জড়িত নয়। থানায় কাজ করে, এ জন্য হয়তো কেউ তার নাম ব্যবহার করছে।’
আপনার মতামত জানানঃ