করোনা পরিস্থিতে বেসামাল ভারত। কেবল ভারত নয়, সীমানা পেরিয়ে করোনা একই রুপ ধারণ করছে পার্শ্ববর্তী দেশ নেপালেও। নেপাল প্রতিবেশী ভারতের মতো ভয়াবহ করোনার সংক্রমণের মুখে পড়তে যাচ্ছে বলে সতর্ক করেছেন দেশটির চিকিৎসকেরা। এই পরিস্থিতিতে ভারতের সংক্রমণ বাংলাদেশেও প্রভাব ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন জনস্বাস্থ্যবিদরা।
করোনা বিপর্যয়ের মুখে নেপাল
নেপালের বর্তমান করোনাভাইরাস সংক্রমণের হারে রকেটগতি, হাসপাতালগুলো রোগীতে ঠাসা, প্রধানমন্ত্রী অন্য দেশগুলোর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করছেন। এমন দৃশ্য পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও দেখা যাচ্ছে। কিন্তু ভারতের মতো অর্থবিত্ত বা জনশক্তি কোনোটাই নেপালের নেই। রয়েছে অবকাঠামোগত ঘাটতিও। ফলে করোনার হানায় হিমালয় পাদদেশে ভারতের চেয়েও ভয়াবহ বিপর্যয় নামার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এরই মধ্যে ভারতের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে উদ্বেগজনক হারে সংক্রমণ বৃদ্ধি এবং হাসপাতালে শয্যা ও অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দেওয়ার কথা জানিয়েছেন তারা। ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
এতে বলা হয়, ভারতের উত্তর প্রদেশের সীমান্তবর্তী লুম্বিনি প্রদেশের বাঙ্কে জেলার ভেরি হাসপাতালের চিকিৎসকেরা সেখানকার পরিস্থিতি বর্ণনায় ‘মিনি ইন্ডিয়া’ বলেছেন।
তাদের ভাষ্যমতে, ওই এলাকায় করোনাভাইরাস সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।
হাসপাতালের চিকিৎসক রাজন পান্ডে বলেছেন, ‘পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে। আমরা অসহায় অবস্থায় আছি।’
গত দুই সপ্তাহে ওই হাসপাতালের ৮০ জন কর্মীর করোনাভাইরাস সংক্রমণ ধরা পড়েছে। সেখানে নার্সের সংকট চলছে বলে রাজন পান্ডে জানিয়েছেন।
নেপালের স্বাস্থ্যমন্ত্রী হরিদায়েশ ত্রিপাঠি সম্প্রতি দেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আসছে বলে সতর্ক করেছিলেন। এবারের ভাইরাসটি আরও বেশি ‘সংক্রামক ও প্রাণঘাতী’ বলে জানিয়েছিলেন তিনি। এরপর বৃহস্পতিবার থেকে রাজধানী কাঠমান্ডুতে দুই সপ্তাহের লকডাউন দেওয়া হয়। নেপালি টাইমসকে ত্রিপাঠি বলেছেন, নেপালের স্বাস্থ্যব্যবস্থার মহামারি সামাল দেওয়ার মতো যথেষ্ট শক্তিশালী নয়।
গার্ডিয়ানের প্রতিবেদন বলছে, কাঠমান্ডুর বাইরে যেসব এলাকায় করোনার সংক্রমণ সবচেয়ে বেশি হয়েছে, তার একটি বাঙ্কে জেলা।
এখন পর্যন্ত নেপালে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন মোট ৩ লাখ ২৩ হাজার ১৮৭ জন এবং এতে মৃত্যু হয়েছে ৩ হাজার ২৭৯ জনের। তবে এখন সংক্রমণ দ্রুত বাড়ছে।
নেপালে বর্তমানে প্রতি এক লাখ মানুষের মধ্যে দৈনিক ২০ জনের করোনা ধরা পড়ছে। মাত্র দু’সপ্তাহ আগে ভারতেও একই পরিস্থিতি ছিল।
গত সপ্তাহান্তে নেপালে করোনা টেস্টের ৪৪ শতাংশ ফলাফল পজিটিভ এসেছে। সেখানে দ্রুত গভীর সংকট তৈরি হওয়ার আশঙ্কাপ্রকাশ করেছে রেড ক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট।
নেপালে রেড ক্রসের প্রধান ড. নেত্র প্রসাদ তিমসিনা এক বিবৃতিতে বলেছেন, ভারতে বর্তমানে যা হচ্ছে তা হলো নেপালের ভবিষ্যৎ। আমরা যদি এই করোনার স্রোত থামাতে না পারি, তাহলে আরও অনেক প্রাণ যাবে।
নেপালের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এমনিতেই ভঙ্গুর। সেখানে মানুষের তুলনায় চিকিৎসকের অনুপাত ভারতের চেয়ে কম, টিকাদানের হারেও প্রতিবেশীদের চেয়ে বিস্তর পিছিয়ে নেপালিরা। তাছাড়া সংক্রমণের উচ্চহারই প্রমাণ করে দিচ্ছে, পর্যাপ্ত পরীক্ষার অভাবে দেশটিতে বহু করোনা রোগী অশনাক্তই থেকে যাচ্ছেন। এমনকি করোনাভাইরাস পৌঁছে গেছে এভারেস্ট চূড়াতেও।
নেপালের স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ডা. সামির অধিকারী বলেছেন, পরিস্থিতি দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে এবং ভবিষ্যতে তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।
রাজন পান্ডেসহ অন্যান্য চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের অনেকে মনে করছেন, ভারতে প্রথম শনাক্ত হওয়া করোনাভাইরাসের বি ১৬১৭ ধরনটিই এখনকার সংক্রমণ ঘটাচ্ছে। এই ধরনটি বেশি সংক্রামক বলে ধারণা করা হচ্ছে। এতে ভারতের মতো তরুণ এমনকি শিশুরাও আক্রান্ত হচ্ছে। তবে এই ধারণার পক্ষে এখনো যথেষ্ট বৈজ্ঞানিক তথ্য–উপাত্ত পাওয়া যায়নি।
রাজন পান্ডে বলেন, এটা কোন ভ্যারিয়েন্ট, তা পরীক্ষা করে দেখার মতো যন্ত্র তাদের নেই। জিনোম সিকোয়েন্সের মেশিন কেনা হয়েছে বলে তাকে বলা হয়েছে। তবে এটার ব্যবহার এখনো শুরু হয়নি। তিনি এমন একটি হাসপাতালের বিবরণ দেন, যেটা কোভিড–১৯ রোগীদের সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। ওই হাসপাতালে ভর্তির জন্য শ্বাসকষ্ট নিয়ে অনেককে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাইরে অপেক্ষা করতে হচ্ছে। রোগীর তুলনায় সেখানে আইসিইউ বেড ও ভেন্টিলেটরের ঘাটতি রয়েছে।
অনেকেই এর জন্য করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে বিপর্যস্ত ভারতের সঙ্গে খোলামেলা সীমান্ত থাকাকে দায়ী করেছেন।
ভারতে প্রবেশের জন্য নেপালিদের পাসপোর্ট বা আইডি কার্ড দেখানোর দরকার হয় না। এ কারণে সীমান্তের ওপারে ব্যবসা শুরু করেছেন অনেক নেপালি। অর্থাৎ, নেপাল-ভারত সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিন প্রচুর মানুষ অবাধে চলাচল করে। তাছাড়া, সম্প্রতি ভারতের হাসপাতালগুলোতে শয্যা সংকট দেখা দেয়ায় অনেকেই চিকিৎসা নিতে নেপালে ছুটে গেছেন।
অবশ্য সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির মুখে সম্প্রতি সীমান্তে কিছুটা কড়াকড়ি আরোপ করেছে নেপালি কর্তৃপক্ষ।
তবে জনস্বাস্থ্য গবেষক ডা. সমীর মণি দীক্ষিত মনে করেন, এধরনের পদক্ষেপ নিতে দেরিই করে ফেলেছে নেপাল। দেশটিতে এরই মধ্যে তাণ্ডব শুরু করে দিয়েছে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস।
নেপালে জনসংখ্যার মাত্র ৭ শতাংশ করোনাভাইরাসের টিকা পেয়েছেন। প্রথম দিকে নয়াদিল্লির ‘টিকা কূটনীতির’ সুবিধাভোগী হয়েছিল নেপাল। সে সময় দেশটিতে এক লাখ ডোজ টিকা পাঠিয়েছিল ভারত সরকার। তবে পরে ভারত টিকা রপ্তানি বন্ধ করায় এখন এ জন্য চীনের ওপর নির্ভরশীল হতে হচ্ছে দেশটিকে।
বাংলাদেশের জন্য অশনিসংকেত
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গতকালের তথ্য অনুযায়ী আগের ২৪ ঘণ্টায় বাংলাদেশের স্থলবন্দর দিয়ে ৪৮০ জন দেশে প্রবেশ করেছেন। এর আগের দিন এ সংখ্যা ছিল ৩২৫ জন। এছাড়া প্রতিদিন বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে দেশে চার থেকে পাঁচশ’ পণ্যবাহী ট্রাক প্রবেশ করছে। এসব ট্রাকপ্রতি দু’তিনজন চালক ও সহকারী প্রবেশ করছেন। তাদের মাধ্যমেও সংক্রমণ ছড়ানোর ঝুঁকি রয়েছে বলে জনস্বাস্থ্যবিদরা আশঙ্কা করছেন।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে খ্যাতিমান সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ ও বিএসএমএমইউ’র সাবেক উপাচার্য প্রফেসর ডা. নজরুল ইসলাম জাতীয় এক দৈনিককে বলেন, ‘ভারতের সংক্রমণের প্রভাব নেপালে পড়েছে, শ্রীলঙ্কায়ও পড়ছে। আমাদের এখানেও এর প্রভাব পড়বে। তবে নেপালে বিপর্যয় নেমে আসার কারণ হলো তারা ভারতের সঙ্গে সীমান্ত খোলা রেখেছে।’
বাংলাদেশ ইতোমধ্যে ভারতের সঙ্গে সব সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছে, এরপরও দেশে ভারতের সংক্রমণের প্রভাব কেন পড়বে, জানতে চাইলে এই ‘ভাইরোলজিস্ট’ বলেন, ‘আমাদের প্রায় সবদিকেই ভারতের সীমান্ত। তা বন্ধ থাকলেও নানাভাবে দুই দেশের মানুষ আসা-যাওয়া করে। অর্থাৎ সীমান্ত পুরোপুরি বন্ধ রাখা সম্ভব হয় না। এ কারণে একটু দেরিতে হলেও বাংলাদেশে ভারতের সংক্রমণের প্রভাব পড়বে।’
ভারতীয় সংক্রমণ রোধে করণীয় সর্ম্পকে প্রফেসর নজরুল ইসলাম বলেন, ‘সবাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে, মাস্ক পরলে, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখলে এটি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। কিন্তু সরকার সংক্রমণ ঠেকাতে নানা বিধিনিষেধ আরোপ করছে, আমরা অনেকেই তা মানছি না।’
দেশের করোনা পরিস্থিতি
গতকাল বিকেলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সকাল আটটা পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় দেশে ৫০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এটি গত পাঁচ সপ্তাহের মধ্যে সবচেয়ে কম। এর চেয়ে কম মৃত্যু হয়েছিল গত ৩০ মার্চ, সেদিন ৪৫ জনের মৃত্যুর তথ্য জানয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। গত ৩৫ দিনে তা ৫০ এর নিচে নামেনি। গত একদিনে মৃত্যু হওয়া ৫০ জনকে নিয়ে দেশে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ালো ১১ হাজার ৭৫৫ জনে।
গত একদিনে দেশে এক হাজার ৭৪২ জনের দেহে করোনা সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। এ নিয়ে মোট শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়ালো সাত লাখ ৬৭ হাজার ৩৩৮ জনে।
যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় বিশ্বে করোনা শনাক্তের দিক থেকে ৩৩তম স্থানে এবং মৃত্যুর সংখ্যায় রয়েছে ৩৭তম অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, গত একদিনে সারাদেশে ৪২৭টি ল্যাবে ২০ হাজার ২৮৪টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এ পর্যন্ত নমুনা পরীক্ষা হয়েছে ৫৫ লাখ ৬০ হাজার ৬৭৮টি।
গত একদিনে নমুনা পরীক্ষার বিবেচনায় শনাক্তের হার ৮ দশমিক ৫৯ শতাংশ, এ পর্যন্ত মোট শনাক্তের হার ১৩ দশমিক ৮০ শতাংশ। শনাক্ত বিবেচনায় সুস্থতার হার ৯১ দশমিক ০২ শতাংশ এবং মৃত্যুর হার ১ দশমিক ৫৩ শতাংশ।
২৪ ঘণ্টায় যারা মারা গেছেন তাদের মধ্যে পুরুষ ৩২ জন এবং নারী ১৮ জন। এর মধ্যে ৩৫ জন সরকারি হাসপাতালে, ১২ জন বেসরকারি হাসপাতালে এবং তিনজনের মৃত্যু হয়েছে বাসায়। মৃত্যু হওয়া ১১ হাজার ৭৫৫ জনের মধ্যে পুরুষ আট হাজার ৫৪৪ জন এবং নারী তিন হাজার ২১১ জন।
বয়সভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত একদিনে মৃত্যু হওয়া লোকজনের মধ্যে ৩০ জনের বয়স ছিল ৬০ বছরের বেশি, ১৩ জনের বয়স ৫১ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে, পাঁচ জনের বয়স ৪১ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে এবং দুইজনের বয়স ৩১ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে ছিল।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬১৯
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ