নেসারুল হক খোকন : হাওরে ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণে দুর্নীতি প্রতিরোধে এবার নতুন প্ল্যান বাস্তবায়ন শুরু করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। সার্ভে থেকে শুরু করে বাঁধ নির্মাণ পর্যন্ত সম্পূর্ণ কাজটি মনিটরিং করবে টাস্কফোর্স। ইতোমধ্যে বাঁধ নির্মাণে সম্ভাব্য ব্যয় নির্ধারণ করতে মাটির কাজের যে জরিপ (প্রিওয়ার্ক) করা হয় তার প্রকৃত চিত্র উপস্থাপনে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে দক্ষ সার্ভেয়ার নিয়োগ দেয়া হয়েছে। বাঁধ নির্মাণে এখন থেকে অতিরিক্ত ব্যয়ের আড়ালে লুটপাট ঠেকাতে নেয়া হয়েছে কঠোর পদক্ষেপ। ২৩ জুলাই ‘হাওরে ফসল রক্ষা বাঁধ’, ‘টাস্কফোর্সের জরিপে সাগর চুরির চিত্র’ শিরোনামে যুগান্তরে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ছাপা হয়। প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয় বাঁধের মাটির কাজ বাস্তবায়নে লুটপাটের ভয়াবহ চিত্র।
পাউবোর টাস্কফোর্সের জরিপে বলা হয়, সুনামগঞ্জে মাটির কাজে সর্বোচ্চ বেশি বিল ধরা হয় ৫০৪ শতাংশ। ইঞ্জিনিয়ারিং ভাষায় এটিকে বলা হয় ভেরিয়েশন। যেখানে খরচ হওয়ার কথা ২ লাখ ৯ হাজার টাকা, সেখানে বরাদ্দ দেয়া হয় ১৭ লাখ ৩৫ হাজার টাকা। সুনামগঞ্জের পিআইসিকে (প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি) সামনে রেখে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এভাবেই সরকারের কোটি কোটি টাকা লোপাটের আয়োজন করেন। ব্যয় বাড়াতে গঠন করা হয় ৭৪৫ পিআইসি। জেলার ছোট-বড় ১১টি হাওর ঘুরে সরকারি টাকা লোপাটের এমন তথ্য পায় টাস্কফোর্স। প্রতিবেদন প্রকাশের পরই টনক নড়ে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়সহ পানি উন্নয়ন বোর্ডের।
তাই এবার আলোচিত সেই টাস্কফোর্স প্রধান সৎ ও নিষ্ঠাবান কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত পাউবোর অতিরিক্ত মহাপরিচালক কাজী তোফায়েল হোসেনকে প্রিওয়ার্ক ও পোস্ট-ওয়ার্ক জরিপের নেতৃত্ব দেয়া হয়। এবার তার মনিটরিংয়েই চলবে বাঁধের কাজ। এ ব্যাপারে কঠোর নির্দেশনা দিয়ে প্রিওয়ার্ক জরিপে অংশ নেয়া সার্ভেয়ারদের ট্রেনিংও দেয়া হয়েছে। কাজী তোফায়েল হোসেন বুধবার সুনামগঞ্জে গিয়ে এ ট্রেনিং কার্যক্রমে অংশ নিয়ে কঠোর নির্দেশনা দেন। মাটির কাজের প্রকৃত চিত্র নির্ধারণে সার্ভেয়ারদের জন্য কেনা হয়েছে অত্যাধুনিক যন্ত্রও।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে টাস্কফোর্সের একজন কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, বাঁধে অতিরিক্ত মাটির হিসাব ধরে লুটপাটের আগাম হিসাব করা হলে সংশ্লিষ্ট সার্ভেয়ারের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। টাস্কফোর্স আকস্মিকভাবে কিছু বাঁধ জরিপ করলেই প্রকৃত চিত্র উঠে আসবে। তখন প্রিওয়ার্ক সম্পন্ন করা সার্ভেয়ার চিহ্নিত হবেন। আশা করি, রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তির বিষয়টি মাথায় রেখে সবাই সঠিক দায়িত্ব পালন করবেন।
জানতে চাইলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালক আমিনুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, হাওরের বাঁধ নির্মাণে কঠোর নজরদারি থাকবে। আমরা কোনো অস্বচ্ছ প্রক্রিয়া বরদাশত করব না। গত বছর ভালো কাজের মধ্যেও কিছু ত্রুটি ছিল। এবার আমরা সেই ত্রুটিগুলো কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হব বলে আশা করছি।
তিনি বলেন, প্রিয়াওয়ার্ক জরিপে যেসব সার্ভেয়ার অংশ নেবেন তারাও যদি ভেরিয়েশন করে অতিরিক্ত ব্যয়ের আড়ালে দুর্নীতির সুযোগ করে দেন তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। আমরা স্বচ্ছ একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণ শেষ করতে চাই। তিনি বলেন, হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধ নিয়ে ভবিষ্যতে আর কোনো অভিযোগ শুনতে চাই না। এ ব্যাপারে যথাযথ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, এবার সুনামগঞ্জের ১১ উপজেলায় প্রায় ৭শ’ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ বা সংস্কারের হিসাব করে সার্ভে করা হচ্ছে। পাউবোর দু’জন নির্বাহী প্রকৌশলীর তত্ত্বাবধানে উপজেলাগুলোকে ভাগ করা হয়। এর মধ্যে পাউবোর পওর বিভাগ ১-এর আওতায় রয়েছে ৫টি উপজেলা ও ২-এর আওতায় ৬টি উপজেলা। দক্ষ বিবেচনায় ২২টি সার্ভে টিম প্রকৃত ব্যয় নির্ধারণ করবে। এবার কোনো উপজেলায় কত কিলোমিটার ডুবন্ত বাঁধ নির্মাণ বা সংস্কারের প্রয়োজন তার একটি সম্ভাব্য তালিকা সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা মহাপরিচালকের কার্যালয়ে পাঠিয়েছেন। এর মধ্যে সুনামগঞ্জ সদরে প্রায় সাড়ে ৩২ কিলোমিটার, বিশ্বম্ভরপুরে ৪৩ কিলোমিটার, তাহিরপুরে ৮০ কিলোমিটার, জামালগঞ্জে ১০৯ কিলোমিটার, ধর্মপাশায় ১৭০ কিলোমিটার, দক্ষিণ সুনামগঞ্জে প্রায় ৬২ কিলোমিটার, জগন্নাথপুরে প্রায় ৭৮ কিলোমিটার, দিরাইয়ে ১২০ কিলোমিটার, শাল্লায় ১২০ কিলোমিটার, ছাতকে সাড়ে ১৫ কিলোমিটার এবং দোয়ারাবাজারে সাড়ে ২৫ কিলোমিটার নির্ধারণ করা হয়েছে। এর আগে বাঁধ নির্মাণে প্রিওয়ার্ক করা হয়েছে অনুমান নির্ভর। যে কারণে অতিরিক্ত ব্যয় ধরে সরকারি টাকা ভাগবাটোয়ারা করেছে একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট। পাউবোর টাস্কফোর্সের কারণে এবার সেই লাগাম টেনে ধরা হয়েছে। আগেরবার এ টাস্কফোর্স সর্বোচ্চ ৫শ’ পার্সেন্ট ভেরিয়েশনের তথ্য পেয়ে প্রায় ২০ কোটি টাকা পরিশোধে আপত্তি জানায়। সেই টাকা এখনও মন্ত্রণালয় পরিশোধ করেনি।
২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য ডুবন্ত হাওর রক্ষা বাঁধের ব্যয় নির্ধারণসহ সারসংক্ষেপ পাউবোতে উপস্থাপন করা হয়। সেখানে সুনামগঞ্জের পাউবোর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা নিজেদের গা বাঁচিয়ে টাস্কফোর্সের জরিপে উঠে আসা মাটির কাজে সাগরচুরির চিত্র ভিন্নভাবে তুলে ধরেছেন। এ প্রসঙ্গে বলা হয়, ‘বর্তমান অর্থবছরে উন্মুক্ত দরপত্রে ঠিকাদার নিয়োগের মাধ্যমে কাবিটা কাজের প্রিওয়ার্ক ও পোস্ট-ওয়ার্ক গ্রহণের নিমিত্তে প্রস্তাবনা পাঠানো হয়। কিন্তু বছর নিয়োজিত ঠিকাদারের মাধ্যমে সার্ভে কাজ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারের মাঠপর্যায়ের জনবলের অনভিজ্ঞতা। এছাড়া পাউবোর কাজের ধরন সম্পর্কে তাদের সম্যক ধারণা না থাকায় বিভিন্ন ত্রুটি-বিচ্যুতি দেখা দেয়। যার ফলশ্রুতিতে টাস্কফোর্স কর্তৃক প্রিওয়ার্ক ও পোস্ট-ওয়ার্ক যাচাইকালে বিভিন্ন মাত্রায় তারতম্য পরিলক্ষিত হয়। এতে করে বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।’ বলা হয়, হাওর এলাকায় ডুবন্ত বাঁধের প্রিওয়ার্ক ও পোস্ট-ওয়ার্ক গ্রহণ খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে করতে হয়। তাই অত্র বিভাগের বিদ্যমান জনবল দিয়ে কোনো অবস্থাতেই তা সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে পাউবোর অন্যান্য মাঠপর্যায়ে বিদ্যমান উপযুক্ত জনবল সাময়িকভাবে অত্র দফতরের অনুকূলে নিয়োজিত করে প্রিওয়ার্ক ও পোস্ট-ওয়ার্ক কাজটি বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। এ চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে ২২ জন সার্ভেয়ারসহ কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হয়। তারাই মাটির কাজের সম্ভাব্য ব্যয় নির্ধারণের একটি হিসাব উপস্থাপন করবেন।
এ সংক্রান্ত দাফতরিক নথিপত্রে বলা হয়, সুনামগঞ্জের হাওর এলাকার কাজ বাস্তবায়নের সময়সীমা অত্যন্ত সীমিত। তাছাড়াও সংশোধিত কাবিটা নীতিমালা- ২০১৭ অনুযায়ী ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে কাজ শুরুর বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এ কারণে ৭ থেকে ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে প্রিওয়ার্ক পরিমাপ গ্রহণ কাজ সম্পন্ন করা প্রয়োজন। অপরদিকে হাওরের ডুবন্ত বাঁধের কাজ বাস্তবায়ন শেষে আগাম বন্যার আগেই (১৫ মার্চ থেকে ৩০ এপ্রিল সময়) কাজের পোস্ট-ওয়ার্ক গ্রহণ করা আবশ্যক। ফলে মাটির কাজের জরিপে নিয়োজিত টিম প্রথম দফায় প্রিওয়ার্ক গ্রহণ ও দ্বিতীয় দফায় পোস্ট-ওয়ার্ক সময় পর্যন্ত তাদের সুনামগঞ্জে অবস্থান করতে হবে। এরপরই পানি উন্নয়ন বোর্ড সার্ভের জন্য অতিরিক্ত জনবল নিয়োজিত করার উদ্যোগ নেয়। নিয়োজিত সার্ভেয়ারদের জরিপ কাজের জন্য যাবতীয় ব্যয় পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে দেয়া হয়েছে।
খবর : যুগান্তর
আপনার মতামত জানানঃ