করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ ও রোগীর চিকিৎসায় জরুরি সামগ্রী কেনাকাটায় সমন্বয় নেই। এই সমন্বয়হীনতা দেখা দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দুটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে। একটি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, অন্যটি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীন কেন্দ্রীয় ঔষধাগার (সিএমএসডি)।
দেশে করোনা পরীক্ষার আরটি-পিসিআর কিটের ঘাটতি হতে পারে বলে আশঙ্কা কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের (সিএমএসডি)। তারা ২০ এপ্রিল স্বাস্থ্যসেবা বিভাগকে দেওয়া এক চিঠিতে জানিয়েছে, যে কিট মজুত আছে, তা দিয়ে ১৫ থেকে ২০ দিনের চাহিদা সামাল দেওয়া যাবে। জরুরিভাবে যদি কিনতে হয়, তাহলেও এক থেকে দেড় মাস লাগবে। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দাবি, দেশে কিটের কোনো সংকট নেই। কিট আছে বলেই আগের চেয়ে বেশি পরীক্ষা করা যাচ্ছে।
জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, মহামারির সময় মানুষকে সঠিক তথ্য দেওয়া জরুরি। উল্লেখ্য, দেশে গত বছর করোনা সংক্রমণ শুরুর পর কিটের ঘাটতি দেখা গিয়েছিল। তখন নমুনা পরীক্ষাও হতো কম।
দুই সংস্থার দুই রকম বক্তব্য
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে পাওয়া সিএমএসডির ২০ এপ্রিলের চিঠিতে দেখা যায়, মজুত কিটের সংখ্যা ২ লাখ ৭৫ হাজার ৮০২। চিঠিতে বলা হয়, সরকারি নিয়মনীতি অনুসরণ করে কিট কিনতে তিন থেকে সাড়ে তিন মাস সময় লাগে। আর জরুরিভাবে সরাসরি ক্রয়ের ক্ষেত্রে সব প্রক্রিয়া শেষ করে সরবরাহ পেতে সময় লাগে এক থেকে দেড় মাস। করোনা পরিস্থিতিতে উৎস দেশের সঙ্গে যোগাযোগ ও যাতায়াতে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হচ্ছে।
এদিকে গতকাল বুধবার (২৮এপ্রিল) অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি সিএমএসডিকে আরটি-পিসিআর টেস্ট কিট ও পিসিআর ল্যাবে ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন উপকরণ (কনজ্যুমেবলস) সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে কেনার নীতিগত অনুমোদন দেয়।
স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, দেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের মধ্যে নমুনা পরীক্ষা অনেক বেড়েছে। এতে কিটের চাহিদাও বেড়েছে। এখন দৈনিক ২৫ থেকে ৩০ হাজার নমুনা পরীক্ষা হচ্ছে। এর আগে ৮ এপ্রিল সিএমএসডি একটি চিঠিতে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগকে জানিয়েছিল, কিটের মজুত আছে ৩ লাখ ৩০ হাজারের মতো। যা দিয়ে ১৫ থেকে ২০ দিনের চাহিদা পূরণ সম্ভব।
সিএমএসডির ওই চিঠিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে কিট ও অন্যান্য সামগ্রীর চাহিদা কত হতে পারে, তা পাঠাতে বলা হয়েছিল। এতে আরও উল্লেখ করা হয়, মহামারি মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণ ও প্রস্তুতির অংশ হিসেবে আগে থেকেই ভবিষ্যৎ ক্রয় পরিকল্পনা করার দায়িত্ব স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের। কিন্তু কোভিড-১৯-এর দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় সিএমএসডি কোনো উৎস থেকেই এখন পর্যন্ত কোনো ক্রয় পরিকল্পনা পায়নি। এমনকি মহামারির আকস্মিক নাজুক অবস্থাতেও কোনো জরুরি ক্রয় পরিকল্পনা পাওয়া যায়নি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে সিএমএসডিকে ছয় মাসের আরটি-পিসিআর কিটসহ অন্যান্য সামগ্রীর চাহিদা জানানো হয়। এর মধ্যে ছয় মাসে কিটের চাহিদা বলা হয় ৩৬ লাখ। ২ লাখের মতো মজুত থাকায় কিনতে হবে ৩৪ লাখ। চাহিদার ৫০ শতাংশ কিট সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে কিনতে চায় সিএমএসডি। পরিমাণে তা ১৭ লাখের মতো। প্রতিটি ৯৮০ টাকা সম্ভাব্য মূল্য ধরে দাম পড়বে ১৬৭ কোটি টাকার মতো।
কিটের বিষয়ে জানতে চাইলে সিএমএসডির পরিচালক আবু হেনা মোরশেদ জামান গণমাধ্যমকে কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হননি।
কী বলছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর
কিটের কোনো সংকট কি আছে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম গণমাধ্যমকে বলেন, কোনো সংকট নেই। তিনি এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক নাসিমা সুলতানার সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্র জানায়, গতকাল তাদের কাছে কিটের মজুত ছিল ২ লাখ ৪৮ হাজারের মতো। কয়েকটি হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সেখানে আপাতত কিটের ঘাটতি নেই। পরীক্ষা করা যাচ্ছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চট্টগ্রাম বিভাগের একটি জেলার সিভিল সার্জন গত রাতে বলেন, তার কাছে যে কিটের মজুত আছে, তা দিয়ে ১৮-২০ দিন চলা যাবে। আগামী সপ্তাহে নতুন করে চাহিদাপত্র পাঠাবেন তিনি। নতুন সরবরাহ এক সপ্তাহের মধ্যে পাওয়া যাবে।
সরকারি সংস্থার সমন্বয়হীনতা
করোনাকালে সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে এমন সমন্বয়হীনতা আগেও দেখা গেছে। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের শুরুতে বিভিন্ন হাসপাতালে নানা ধরনের সরঞ্জামের ঘাটতি লক্ষ করা যায়। অথচ বিমানবন্দরে ১০ মাস ধরে পড়ে ছিল ১০২ কোটি টাকার জীবন রক্ষাকারী নানা সরঞ্জাম ও সামগ্রী। দেখা গেছে, শুধু উদ্যোগের অভাবে এসব খালাস করা হয়নি। যদিও সামগ্রীগুলো কেনা হয়েছিল জরুরি প্রয়োজন মেটাতে। এ নিয়ে ১৩ এপ্রিল এ নিয়ে প্রথম আলোয় সংবাদ প্রকাশিত হওয়ায় এবং স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিবের নির্দেশের পর মাত্র সাত দিনেই জটিলতা কেটে যায়। খালাস শুরু হয় বিমানবন্দরে পড়ে থাকা পণ্যের।
কিট নিয়ে দুই সংস্থার দুই রকম বক্তব্যের বিষয়ে জনস্বাস্থ্যবিদ আবু জামিল ফয়সাল বলেন, মহামারি মোকাবিলায় সমন্বয়ের অভাব একটি বড় ঘাটতি। কিটের বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাছে হয়তো আলাদা তথ্য আছে, যেটি ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরকে জানায়নি। সরকারের দুটি সংস্থার মধ্যে তথ্য আদান-প্রদান জরুরি। তা না হলে বিভ্রান্তি তৈরি হয়। মানুষ সঠিক তথ্য জানা থেকে বঞ্চিত হয়।
হস্তক্ষেপ করা উচিত
করোনার শুরুর দিকে গত বছর স্বাস্থ্য খাতে সুরক্ষাসামগ্রী ও চিকিৎসা সরঞ্জাম নিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতির তৈরি হয়েছিল। এরপর দ্বিতীয় ঢেউ আসার আগে প্রস্তুতির বেশ সময় পেয়েছে সরকারি সংস্থাগুলো। কিন্তু স্বাস্থ্য খাতে চিঠি চালাচালিতে স্পষ্ট যে এ ক্ষেত্রে সমন্বয়হীনতা ও প্রস্তুতির ঘাটতি রয়েছে। এর মাশুল দিতে হয় করোনার রোগীদের।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজারি কমিটির সদস্য আবু জামিল ফয়সাল বলেন, ‘মহামারির এই সময়ে স্বাস্থ্যের দুটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কেনাকাটার মতো বিষয়ে সমন্বয়হীনতা থাকলে তা হবে দুঃখজনক। সমন্বয়হীনতা থাকলে এখনই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপ করা উচিত।’
এসডব্লিউ/পিএ/ এফএ/১৩১৯
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ