ঐতিহ্যগতভাবে রক্ষণশীল ইসলামী দেশ হিসেবেই পরিচিত সৌদি আরব। কিন্তু হাজার হাজার বছরের সেই ঐতিহ্য থেকে ক্রমেই বেরিয়ে আসছে দেশটি। এক্ষেত্রে একেবারে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন দেশটির যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতি, ইতিহাস, ধর্ম ইত্যাদি বিষয়ে পড়ানোর পরিকল্পনা নিয়েছেন। এরই অংশ হিসেবে সৌদির স্কুলে রামায়ণ-মহাভারত পড়ানো হবে। স্কুলে পড়ুয়াদের অন্য বিষয়ের পাশাপাশি রামায়ণ এবং মহাভারতের শিক্ষা দেওয়ার কথা ঘোষণা করে দিয়েছে সৌদি আরব সরকার। সৌদি আরবের পড়ুয়াদের গীতা জ্ঞান এবং ভারতীয় সংস্কৃতি সম্বন্ধে পাঠ করানো হবে বলে জানানো হয়েছে।
দেশটির প্রিন্স মোহাম্মাদ বিন সালমান ভিশন ২০৩০ ঘোষণার পর শিক্ষাক্ষেত্রে সংস্কারের অংশ হিসেবে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। বিভিন্ন দেশের ভিন্ন ভিন্ন ধর্ম, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য সম্পর্কে জ্ঞান দিতেই এমন কার্যক্রম হাতে নেন মোহাম্মাদ বিন সালমান।
সৌদি যুবরাজের পরিকল্পনা অনুযায়ী, দেশটির প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ্যসূচিতে বেশ কিছু পরিবর্তন আনা হচ্ছে। এ পরিকল্পনার নাম দেওয়া হয়েছে ‘ভিশন ২০৩০’। পাঠ্যসূচিতে বিভিন্ন দেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতি সম্পর্কে স্কুলপড়ুয়াদের প্রাথমিক ধারণা দেওয়া হবে বলে জানা গেছে। তারই পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন ধর্মের পাশাপাশি সৌদি আরবের স্কুল পাঠ্যসূচিতে যোগ করা হয়েছে রামায়ণ ও মহাভারতের পরিচয়।
সৌদি আরবে শিক্ষার সংস্কারে প্রিন্স সালমানের এই উদ্যোগ এরই মধ্যে প্রশংসিত হয়েছে বিভিন্ন দেশে। দেশটির শিক্ষামন্ত্রী জানিয়েছিলেন, এই সংস্কার কাজে সহযোগিতা করছে অস্ট্রেলিয়া। দ্য অস্ট্রেলিয়ান কাউন্সিল ফর এডুকেশনের (এসিইআর) সহায়তায় পাঠ্যক্রম সংস্কার হচ্ছে। দেশটির পরীক্ষা পদ্ধতি নিয়েও কাজ করছে সংস্থাটি।
অস্ট্রেলিয়ার একদল প্রশিক্ষক এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে সৌদি শিক্ষকদের।
ইন্ডিয়া টুডের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বে ভারতের সংস্কৃতি হিসেবে যোগ ব্যায়াম এবং আয়ুর্বেদিকের খুব সুনাম রয়েছে। শিক্ষার্থীদের এসব বিষয়েও জ্ঞান দিতে সৌদি পাঠ্যক্রমে এগুলো যুক্ত করা হবে।
হিন্দুস্তান টাইমস বলছে, ভারতীয় পুরাণের দুই মহাকাব্য রামায়ণ ও মহাভারত সৌদির স্কুলে পড়ানোর ফলে ভারতের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সম্পর্কে সেখানকার পড়ুয়ারা অবগত হবে এবং দুই দেশের মধ্যে যে সুসম্পর্ক রয়েছে, তা আরও বৃদ্ধি পাবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
সৌদি আরব ও ভারতের মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে কূটনৈতিক সম্পর্ক আগের তুলনায় উন্নতি করেছে। এবার সেই সুসম্পর্ক কূটনৈতিক স্তর ছাড়িয়ে স্কুলের বইয়ের পাঠ্যক্রমের মধ্যেও জায়গা করে নিল।
তবে এ নিয়ে খোদ সৌদি বাসিন্দাদের মধে বিরুপ প্রতিক্রিয়া রয়েছে। অনেকে মনে করছেন, অন্যান্য দেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতি অধ্যয়নের জন্য রামায়ণ এবং মহাভারত ছাড়াও আরো অনেক বিষয়ই আছে যা থেকে শিক্ষার্থীরা উপকৃত হতে পারবে।
তবে ভিন্নমত পোষণকারী ভারতীয় অধিবাসী কিংবা হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা বিষয়টিকে স্বাগত জানিয়েছে। তারা মনে করছে, ভারতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতি রামায়ণ এবং মহাভারতের মাধ্যমেই বৈশ্বিকভাবে মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারবে।
পরিকল্পনা অনুযায়ী ইতিমধ্যেই সৌদি আরবের স্কুল পাঠ্যসূচিতে ঢুকেও পড়েছে রামায়ণ ও মহাভারত। সেই সঙ্গে যোগব্যায়াম ও আয়ুর্বেদ সম্পর্কেও বেশ কিছু বিষয় পড়ানো হবে।
ইংরেজি ভাষা শিক্ষাও ভিশন ২০৩০-এ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
নউফ আর মারওয়াই সৌদির এক নাগরিক বিষয়টি নিয়ে টুইট করেছেন। তিনি সম্প্রতি তার ছেলের স্কুলের সিলেবাসের একটি স্ক্রিনশট পোস্ট করেছেন। সেখানে তিনি লিখেছেন, সৌদি আরবের স্কুলের সোশ্যাল স্টাডিজের সিলেবাসে হিন্দুধর্ম, বৌদ্ধধর্ম, মহাভারত এবং ধর্মের মতো বিষয় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। আমার ছেলেকে এ বিষয়গুলোতে সাহায্য করতে পেরে আমি খুবই আনন্দিত।
সেখানে তিনি লেখেন যে সৌদি আরবে এই নতুন ভিশন-২০৩০ একটি সমন্বয়পূর্ণ, মুক্তচিন্তাধারা ও ধৈর্যশীল ভবিষ্যৎ গড়ে তুলবে। এই সিলেবাসের মধ্যে শুধু রামায়ণ-মহাভারত নয়, রয়েছে আরও অন্যান্য বিষয়।
সৌদি আরবের স্কুলের সোশ্যাল স্টাডিজ-এর সিলেবাসে এই নতুন বিষয়গুলো যুক্ত করা হয়েছে। এই সিলেবাসের মধ্যে রামায়ণ ও মহাভারতের সঙ্গেই জায়গা করে নিয়েছে বৌদ্ধ ধর্মের মতো বিষয়ও।
সৌদি যুবরাজের এই ভিশন-২০৩০ আগামী দিনে এমন একটি শিক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করতে চাইছে, যার ফলে সে দেশের সরকারের ব্যবসার প্রসারের অসুবিধাগুলি দূর হবে। এছাড়াও এর ফলে ছাত্রছাত্রীরা বহির্বিশ্বের বিভিন্ন সংস্কৃতি সম্পর্কেও অবগত হবে। এই পরিকল্পনার মাধ্যমে সৌদি আরব আগামী দিনে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ টানার জন্য এক অনুকূল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চলেছে বলে মত রিয়াদের সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ মহলের।
দেশটির যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান সৌদির আদি ইসলামী ঐতিহ্যকে ‘কট্টরপন্থা’ আখ্যা দিয়েছেন। বিপরীতে দেশে ‘মধ্যপন্থী ইসলাম’ প্রতিষ্ঠার কথা বলছেন তিনি।
কিন্তু বিশ্লেষকরা বলছেন, ‘মধ্যপন্থা’র নামে তিনি আসলে পশ্চিমা ভাবধারা ও সংস্কৃতিকেই আমদানি করছেন। সমাজ ও সংস্কৃতির ‘আধুনিকায়নে’ ভিশন-২০৩০ ঘোষণা দিয়েছেন তিনি।
সেই লক্ষ্যেই ইতিমধ্যে বহু নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়েছে। গাড়ি চালানো, হলে গিয়ে সিনেমা ও মাঠে গিয়ে খেলা দেখা এমনকি অভিভাবক ছাড়াই নারীদের হোটেলে কক্ষ ভাড়া নেয়ার অনুমতি দেয়া হয়েছে।
তরুণ সৌদি যুবরাজের সংস্কারমূলক কাজের মধ্যে রয়েছে তেলের ওপর নির্ভরতা থেকে অর্থনীতিকে বের করে আনা, তরুণ নাগরিকদের কর্মসংস্থানে নতুন নতুন খাত তৈরি, নারীর ক্ষমতায়ন ও নাগরিকদের জীবনযাপনের ওপর কড়াকড়ি শিথিলের মতো বিষয়গুলো।
এর প্রথম ধাপ হিসেবে গাড়ি চালানোর ক্ষেত্রে নারীদের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয় দেশটি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬০৫
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগীতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ