বাংলাদেশে যেকোনো সময় অক্সিজেনের ভয়াবহ সংকট সৃষ্টি হতে পারে। বন্ধ হয়ে যেতে পারে মেডিকেল গ্রেড অক্সিজেনের মূল জোগানদাতা লিন্ডের দুটি প্ল্যান্ট। পাশাপাশি করোনা পরিস্থিতিতে ভারতে অক্সিজেনের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় দেশটি অক্সিজেন রপ্তানি বন্ধ করে দিতে পারে। এসব আশঙ্কা বাস্তবে রূপ নিলে চলমান করোনা সংক্রমণে প্রতিদিন যে পরিমাণ অক্সিজেনের প্রয়োজন তার চার ভাগের এক ভাগও সরবরাহ করা সম্ভব হবে না। ভয়াবহ সমস্যায় পড়তে পারেন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন কোভিড রোগীরা। সম্প্রতি অক্সিজেন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে এসব তথ্য জানানো হয়েছে।
হাসপাতাল সূত্র বলছে, গত বছরের তুলনায় এ বছর করোনা সংক্রমণ অনেক বেশি বেড়ে যাওয়ায় এবং নতুন স্ট্রেইনগুলো অতি মাত্রায় সংক্রামক হওয়ায় রোগীদের ফুসফুস মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হচ্ছে। অনেকেরই তীব্র শ্বাসকষ্টের সমস্যা দেখা দিচ্ছে। ফলে বেশি সংখ্যক রোগীকে অক্সিজেন দিতে হচ্ছে।
তারা আরও জানান, গুরুতর অসুস্থদের জীবন বাঁচাতে অক্সিজেন সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখা অত্যন্ত জরুরি। বেশিরভাগ রোগীই তীব্র শ্বাসকষ্ট নিয়ে আসছেন এবং তাদের হাই-ফ্লো নজেল ক্যানুলার মাধ্যমে অক্সিজেন দিতে হচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, সরকারি হাসপাতালগুলোতে অক্সিজেন সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখতে প্রতিদিন প্রায় এক হাজার টন অক্সিজেন প্রয়োজন। এ অক্সিজেনের ৯০ শতাংশই সরবরাহ করে লিন্ডে বাংলাদেশ লিমিটেড নামের একটি বহুজাতিক কোম্পানি। বাকিটা সরবরাহ করে ইসলাম অক্সিজেন লিমিটেড ও স্পেকট্রা অক্সিজেন।
প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, দেশে বর্তমানে অক্সিজেনের চাহিদা ১৫০ টন। কিন্তু লিন্ডের দুটি ইউনিট যেকোনো সময় বন্ধ হয়ে যেতে পারে। সেজন্য অধিদপ্তর ৩টি নতুন উৎসের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। এসব উৎস থেকে পাওয়া যাবে মোট ৭৫ টন। তবে বর্তমানে এই তিনটি প্রতিষ্ঠান মাত্র ৩৫ টন অক্সিজেন দিতে পারবে বলে জানিয়েছে। এর মধ্যে আবুল খায়ের স্টিল মেল্টিং লি. দৈনিক ৭ টন, ইসলাম অক্সিজেন ২০ টন এবং এ কে অক্সিজেন লি. ৮ টন সরবরাহ করতে পারবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোভিড পরিস্থিতির আগে দেশে দৈনিক ১০০ টন মেডিকেল গ্রেড অক্সিজেনের চাহিদা ছিল। কোভিড রোগীদের সংখ্যা বাড়ায় হাইফ্লো নেজাল ক্যানুলা, ভেন্টিলেটর ও আইসিইউর চাহিদা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় অক্সিজেনের চাহিদা বাড়ছে, যা বর্তমানে ১৫০ টনে পৌঁছেছে। এই চাহিদা আরও বাড়তে পারে। সোমবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে পরিচালক হাসপাতাল, লাইন ডিরেক্টর হাসপাতাল ও একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তার সঙ্গে অক্সিজেন সরবরাহকারী কোম্পানিগুলোর প্রতিনিধিরা আলোচনা করেন। সেখানে তারা তাদের সামগ্রিক অবস্থা তুলে ধরেন।
সেই সভায় জানানো হয়, লিন্ডে বাংলাদেশ দেশের সব সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয় অক্সিজেনের বড় অংশ সরবরাহ করে থাকে। এর মধ্যে নারায়ণগঞ্জে অবস্থিত প্ল্যান্ট থেকে ৬০ টন এবং চট্টগ্রামে অবস্থিত প্ল্যান্ট থেকে ২০ টন অক্সিজেন উৎপাদন করে। ২০২০-এর ১১ ডিসেম্বর লিন্ডের নারায়ণগঞ্জে অবস্থিত প্ল্যান্টের কম্প্রেসারের মোটর পুড়ে যায়। ফলে অক্সিজেন উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমানে এই কারখানা চালু আছে। অন্যদিকে চট্টগ্রামের প্ল্যান্ট যেকোনো সময় বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলে তারা জানিয়েছে। গত ৩ থেকে ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত এই প্ল্যান্ট বন্ধ ছিল।
অন্যদিকে স্পেক্ট্রা অক্সিজেন লি. প্রতিদিন ৩৮ টন অক্সিজেন সরবরাহ করছে। তারা স্থানীয়ভাবে ২০ টন এবং ভারত থেকে ১৮ টন আমদানি করছে। সেখানে আরও বলা হয়, ভারত থেকে লিকুইড অক্সিজেন আনা সময়সাপেক্ষ হওয়ায় এবং সাপ্তাহিক ছুটির দিনে পরিবহণ বন্ধ থাকায় অক্সিজেনের সংকট তৈরি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ ছাড়া লিন্ডের দুটি প্ল্যান্টই যেকোনো মুহূর্তে বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
বাংলাদেশ স্টিল রি-রোলিং মিলস লিমিটেডের সহকারী ব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন সেনগুপ্ত জানান, তারা এখনো পর্যাপ্ত পরিমাণে শিল্পজাত অক্সিজেন পাচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘যদি ভবিষ্যতে অক্সিজেনের ঘাটতি তৈরি হয়, তবে ইস্পাতের উৎপাদন অবশ্যই ব্যাহত হবে।
এ বিষয়ে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের ভাইরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. জাহিদুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, অধিকাংশ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর মৃদু বা মাঝারি লক্ষণ প্রকাশ পায়। খুব অল্পসংখ্যক মানুষের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার দরকার হয়। পর্যাপ্ত হাইফ্লো অক্সিজেন সাপ্লাই থাকলে তাদের মধ্য থেকেও একেবারে হাতে গোনা দু-একজনের আইসিইউ সুবিধার প্রয়োজন হয়।
তিনি বলেন, আমাদের দেশে রোগীরা আইসিইউতে আসার আগপর্যন্ত যে চিকিৎসা, সেটি পাচ্ছেন না। ফলে আইসিইউর চাহিদা বাড়ছে। সুতরাং এই মুহূর্তে আইসিইউ শয্যা বৃদ্ধি করার চেয়েও জরুরি জেলা এবং উপজেলা পর্যায়ের সরকারি হাসপাতালগুলোয় কেন্দ্রীয়ভাবে অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা করা। তবে এক বছর সময় পাওয়ার পরও সরকারি হাসপাতালগুলোয় হাইফ্লো অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। এ বিষয়গুলো গুরুত্বসহকারে দেখতে হবে।
এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এবিএম খুরশীদ আলম গণমাধ্যমকে বলেন, অক্সিজেনের চাহিদা নিশ্চিত করতে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। এখন পর্যন্ত চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে। আশা করছি, কোনো বড় ধরনের সংকট হবে না।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশে বর্তমানে সারা দেশে করোনায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি আছেন পাঁচ হাজার ৮৪ জন। এর মধ্যে শুধু ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি আছেন তিন হাজার ২২৩ জন। একইসঙ্গে আইসিইউতে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন ২৯৪ জন। এ ছাড়া আরও অনেকের আইসিইউর প্রয়োজন থাকলে শয্যার অভাবে তাদের আইসিইউতে নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
এসডব্লিউ/এমএন/ এফএ/১৪৩৩
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগীতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ