বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের টিকা সরবরাহে অনিশ্চয়তা তৈরি হওয়ায় টিকা প্রয়োগের কার্যক্রম ঝুঁকিতে পড়েছে। ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউটের সাথে চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রতিমাসে ৫০লাখ ডোজ করে টিকা আসার কথা থাকলেও গত দুই মাসে কোন চালান আসেনি। কবে নাগাদ টিকার চালান আসতে পারে, তা কেউ বলতে পারছে না।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, আগে থেকেই বিকল্প না রেখে একটি প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভরশীল থাকার কারণে বাংলাদেশের টিকা পাওয়ার ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। এরইমধ্যে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার বাইরে অন্য উৎস থেকে ভ্যাকসিন কেনার বিষয়ে কার্যক্রম শুরু করেছে সরকার। বিভিন্ন কোম্পানির ভ্যাকসিনের প্রস্তাব পর্যালোচনার জন্য ৫ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে। আগামী সাতদিনের মধ্যে প্রস্তাবকৃত কোম্পানিগুলোর ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা যাচাই-বাছাই করে প্রতিবেদন জমা দিলে সরকার ভ্যাকসিন কেনার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।
অন্যদিকে স্থানীয় ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির সহযোগিতায় বাংলাদেশে ‘স্পুটনিক ফাইভ’ ভ্যাকসিন উৎপাদনের প্রস্তাব দিয়েছে রাশিয়া। ভ্যাকসিন সংগ্রহে ভারতের বিকল্প হিসেবে বাংলাদেশের অন্য উপায় অনুসন্ধানের এ সময়েই দেশে ভ্যাকসিনের যৌথ-উৎপাদন ব্যবস্থাপনার এ প্রস্তাব এলো।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন মঙ্গলবার বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থাকে (বাসস) দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “রাশিয়ার সঙ্গে ভ্যাকসিনের যৌথ-উৎপাদনের ব্যাপারে আমরা একমত হয়েছি…যদিও এখনো কিছু চূড়ান্ত হয়নি”।
ড. মোমেন জানান, সম্প্রতিই দেশে ভ্যাকসিন উৎপাদনের প্রস্তাবনা পাঠায় মস্কো, বাংলাদেশে ভ্যাকসিন রপ্তানির মতো উৎপাদন সক্ষমতা নেই রাশিয়ার। তিনি জানান, প্রস্তাবনা অনুযায়ী রাশিয়া বাংলাদেশকে ভ্যাকসিন তৈরির প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিগত সহায়তা করবে ও বাংলাদেশি ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানিগুলো দেশেই ভ্যাকসিন উৎপাদন করবে। যদি সবকিছু ঠিকঠাক থাকে, দামও কম হবে, সবকিছু ভালোর দিকেই এগোবে।
এর আগে সোমবার প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের সভাপতিত্বে এক জরুরি সভায় বিভিন্ন দেশের পাঁচটি টিকা নিয়ে আলোচনা হয়। তাদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের দুটি করে এবং রাশিয়ার একটি ভ্যাকসিন রয়েছে। দেশীয় কয়েকটি প্রতিষ্ঠান চারটি টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। আর একটি টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সরকারি পর্যায়ে যোগাযোগ হচ্ছে।
সূত্র জানায়, বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের জনসন অ্যান্ড জনসন ও মডার্না, চীনের সিনোফার্ম ও ক্যানসিনো এবং রাশিয়ার স্পুটনিক ফাইভ- এই পাঁচটি টিকা নিয়ে আলোচনা হয়। এর মধ্যে বাংলাদেশি একটি ওষুধ কোম্পানি জনসন অ্যান্ড জনসন ও মডার্নার টিকা বাংলাদেশে আনতে পারবে বলে বৈঠকে জানিয়েছে। স্পুটনিক-ফাইভ টিকার বিষয়ে সরকারি পর্যায়ে যোগাযোগ চলছে।
এই পাঁচটি টিকার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মাহবুবুর রহমানকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের কমিটি করা হয়েছে। পাঁচটি টিকার মধ্যে কোনটি অধিকতর কার্যকর এবং দ্রুততম সময়ে পাওয়া যাবে, তা যাচাই-বাছাই করতে কমিটিকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আগামী সাত কর্মদিবসের মধ্যে সম্ভাব্য টিকা নিয়ে মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন দিতে হবে কমিটিকে।
স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব সৈয়দ মজিবুল হক গণমাধ্যমকে বলেন, “যেকোন ভ্যাকসিন তো কেনা যাবেনা, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদনের বিষয় রয়েছে, কার্যকারিতা কেমন আছে তা দেখতে হবে। আগামী কাল অথবা দুই একদিনের মধ্যে আমরা কমিটির সদস্যরা বসে ভ্যাকসিনের প্রস্তাবগুলো পর্যালোচনা করে সুপারিশ করবো। এখনো আমরা কাউকে প্রাধান্য দিচ্ছিনা। আমাদের কাছে অনেকগুলো ভ্যাকসিনের প্রস্তাব আছে। প্রস্তাব যেগুলো আছে, বিশ্বের কোন কোন দেশে ব্যবহার করা হচ্ছে, কবে পাওয়া যাবে সেসব বিবেচনা করে আমরা সিদ্ধান্ত নেবো”।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, চীনের ভ্যাকসিন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন না পাওয়ায় এর আগে চীনা ভ্যাকসিন কেনার প্রতি উৎসাহ দেখায়নি বাংলাদেশ। কিন্তু, আমরা এখন ভ্যাকসিন পাওয়ার জন্য সব দরজাই খোলা রাখছি।
তবে, ইতোমধ্যে অন্যান্য দেশকে ভ্যাকসিন সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দেওয়ায়, আগামী ডিসেম্বরের আগে চীন বাংলাদেশে ভ্যাকসিন রপ্তানি করতে পারবে না বলে জানিয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, সম্প্রতি বিশ্ব ব্যাংক জানিয়েছে আগামী মাসের মধ্যে কোভ্যাক্সের আওতায় ৮০ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন পেতে পারে বাংলাদেশ। কোভ্যাক্সের আওতায় ভ্যাকসিন পাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী আমরা,” বলেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক নাসরিন সুলতানা বলেছেন, সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ যখন চলছে, তখন টিকা কার্যক্রম ব্যাহত হলে ঝুঁকি বাড়বে। সিরাম থেকে এ পর্যন্ত অক্সফোর্ড অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা যতটা পাওয়া গেছে, সেই টিকাই প্রয়োগ করা হচ্ছে। কিন্তু এই টিকার প্রথম ডোজ যারা নিয়েছেন, তাদের কাউকে দ্বিতীয় ডোজ দেয়া সম্ভব না হলে তার শরীরে টিকা কার্যকর হবে না। এটাকে বড় সমস্যা হিসাবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেছেন, পুরো ডোজ না দিলেতো টিকা কাজ করবে না। এখনও যারা প্রথম ডোজ নিচ্ছেন, তাদের আট সপ্তাহ পর দ্বিতীয় ডোজ দিতে হবে। একটা সময় পাওয়া যাবে। এই সময়ে টিকা ম্যানেজ করা সম্ভব হবে বলে আমরা মনে করি। একই সাথে তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন, অক্সফোর্ড অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার দ্বিতীয় ডোজ দেয়া নিশ্চিত করতে এই টিকার প্রথম ডোজ দেয়া বন্ধ করা হতে পারে। তিনি বলেছেন, নতুন টিকা এলে তখন আবার প্রথম ডোজ দেয়া যেতে পারে। এমনটা তারা ভাবছেন।
প্রাণঘাতী এ ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে দেশের মোট জনগোষ্ঠীর ৮০ শতাংশকে বিনামূল্যে ভ্যাকসিন দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা হাতে নিয়েছে সরকার। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত প্রায় ৫৫ লাখ মানুষ ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজ নিয়েছেন, ভ্যাকসিন নিতে নিবন্ধন করেছেন আরও ৭০ লাখ মানুষ।
এসডব্লিউ/এমএন/ এফএ/১৪০৪
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগীতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ