এ বছর বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের নিঃসরণ রেকর্ড ছাড়াবে। বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইডের নিঃসরণ চলতি বছরে শুধু বাড়বেই না, বৃদ্ধির দিক থেকে এটি হবে ইতিহাসে দ্বিতীয় বৃহত্তম। আন্তর্জাতিক শক্তি সংস্থা (আইইএ) এমন পূর্বাভাস দিয়েছে বলে জানানো হয়েছে দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে।
সংস্থাটির পক্ষ থেকে সতর্ক করে বলা হয়েছে, ১০ বছর আগে ব্যাপক আর্থিক সংকটের মুখে পড়ে বিশ্ব। ওই ঘটনার পর এই প্রথম কার্বন নিঃসরণের হার এতটা বাড়তে যাচ্ছে। এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যে পরিবেশ বিপর্যয় ঘটছে, সেটি আগামীতে আরও বাড়বে।
আইইএ বলছে, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বিভিন্ন দেশ এরই মধ্যে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। চলতি বছরে ব্যাপক মাত্রায় কার্বন নিঃসরণ বন্ধে দেশগুলোকে এখনই ব্যবস্থা নিতে হবে, নাহলে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা সম্ভব নয়।
জীবাশ্ম জ্বালানির মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিকর কয়লা। পৃথিবীর অনেক দেশে বিদ্যুতের জন্য কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালানো হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ও এশিয়ায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা তুলনামূলক বেশি। এতে কার্বন নিঃসরণ বাড়ছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লার বিপুল ব্যবহারে তাই উদ্বেগ বাড়াচ্ছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানির দাম কয়লার চেয়ে কম। এরপরেও বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কয়লার ব্যবহার কমছে না।
আইইএর নির্বাহী পরিচালক ফাতিহ বিরল গার্ডিয়ানকে বলেন, ‘বিষয়টি খুবই দুঃখজনক ও উদ্বেগের। একদিকে রাষ্ট্রপ্রধানরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তন তাদের অগ্রাধিকার। অন্যদিকে আমরা ইতিহাসের দ্বিতীয় বৃহত্তম কার্বন নিঃসরণ দেখছি। এটি আসলেই হতাশাজনক।’
বিজ্ঞানীরা আগেই সতর্ক করে বলেছিলেন, বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১.৫ সেলসিয়াস পর্যন্ত রাখতে চাইলে এ দশকে কার্বন নিঃসরণ ৪৫ শতাংশ কমাতে হবে। এর অর্থ বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইডের মাত্রা যেন এতটা না বাড়ে যাতে তাপমাত্রা বিপজ্জনক হারে বৃদ্ধি পেতে পারে। এজন্য এই দশকেই কার্বন নিঃসরণ সহনীয় পর্যায়ে আনা জরুরি।
বিরল বলেন, ‘মহামারির কারণে হওয়া অর্থনৈতিক বিপর্যয় ঠেকাতে কার্বন নিঃসরণ বাড়ানো আমাদের এ বার্তা দেয়, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় আমাদের প্রাথমিক পদক্ষেপ কোনোভাবেই পর্যাপ্ত নয়।’
২০১০ সালের আর্থিক সংকটের সঙ্গে বর্তমান পরিস্থিতির তুলনা করেন আইইএর নির্বাহী পরিচালক বিরল। সে সময় সস্তা জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের মধ্য দিয়ে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা হয়েছিল। এর ফলে কার্বন নিঃসরণ ছয় শতাংশের বেশি বেড়ে যায়।
বিরল সতর্ক করে বলেন, ‘মনে হচ্ছে, আমরা আবারও একই ভুল করছি। ২০১০ সালের চেয়ে এবার আমি আরও বেশি হতাশ।’
করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে গত বছর বিশ্বের অনেক দেশে কঠোর লকডাউন দেয়া হয়। ওই সময় কার্বন নিঃসরণ রেকর্ড সাত শতাংশ কমে যায়। কিন্তু লকডাউন উঠে যাওয়ার পর বছরের শেষের দিকে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ আগের জায়গায় ফেরত আসে। কয়েকটি জায়গায় তা ২০১৯ সালের পরিমাণকেও ছাড়িয়ে যায়।
জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমাদের দুর্ভাগ্য, পৃথিবীর তাপমাত্রা অব্যাহতভাবে বেড়ে চলেছে। কার্বন নিঃসরণের মাত্রা ঠিক করার কাজটি নিয়ে যত সময়ক্ষেপণ হবে, মতানৈক্য থাকবে, তত বেশি মোকাবেলা করতে হবে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি। সেই ঝুঁকি এড়ানোর পথ একটাই, সেটা হল শিল্পোন্নত রাষ্ট্রগুলোকে এক টেবিলে বসিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা। পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা প্রাক-শিল্পায়ন যুগের চেয়ে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে অবশ্যই সীমাবদ্ধ রাখতে হবে।
তারা বলেন, একটি তথ্য হল, কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের পর তা শোধন করে সবুজ গাছগাছালি। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, আমাদের এ পৃথিবীর উষ্ণতা বাড়ার একটি প্রধান কারণ হল জীবাশ্ম গ্যাস, যাকে আমরা বলি গ্রিনহাউস অ্যাফেক্ট। বায়ুতে কার্বন ডাই-অক্সাইড, নাইট্রোজেন-অক্সাইড, ক্লোরোফ্লোরো-কার্বন, মিথেন ও অন্যান্য গ্যাস এত বেশি বেড়ে গেছে যে, এর পরিমাণ গত দেড় লাখ বছরে যা ছিল, তার চেয়েও এখন অনেক বেশি। আমাদের মানতে হবে, এটি এখন একটি বৈশ্বিক সমস্যা। মানুষ তার প্রয়োজনেই উজাড় করছে গাছ।
তারা বলেন, বেড়ে গেছে কাঠের বহুমুখী ব্যবহার। মানুষ এ প্রয়োজন মেটাতে গিয়ে নির্বিচারে উজাড় করছে বৃক্ষ। বনাঞ্চল হয়ে পড়ছে সংকুচিত। ফলে বায়ুমণ্ডলে ভেসে বেড়ানো গ্যাসগুলো পুরোটা পরিশোধিত হতে পারছে না। প্রতি মুহূর্তেই বেড়ে চলেছে অপরিশোধিত গ্যাসের পরিমাণ। আজ শোধন করার মতো প্রয়োজনীয় গাছগাছালির রয়েছে প্রকট ঘাটতি। ফলে অপরিশোধিত অতিরিক্ত গ্যাস বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়িয়ে দিচ্ছে।
তার ওপর আবার কিছু কিছু রাসায়নিক স্ট্রাটোস্ফিয়ারে পৌঁছে ওজন স্তরকে করছে ক্ষতিগ্রস্ত। ওজন স্তরের ক্ষতি হওয়া মানে সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি সরাসরি ভূপৃষ্ঠে এসে পড়া। এতে জীব ও উদ্ভিদ জগতে বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে। প্রকৃতির শৃঙ্খলিত নিয়ম ভেঙে পড়তে পারে। ইতোমধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের লক্ষণ হয়ে উঠেছে পরিষ্কার।
বায়ু মন্ডলের উঞ্চতা বৃদ্ধির বিষয়টি বৈশ্বিক। তাই শুধুমাত্র কয়েকটি দেশ জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার হ্রাস ও নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়ালেই বিশ্বের উঞ্চতা হ্রাস পাবে না। কিছু কমতে পারে মাত্র। তাই বর্তমান বিশ্বের প্রধান ও প্রকট সংকট বায়ু মন্ডলের উঞ্চতা হ্রাস করার জন্য বিশ্বের সব দেশকেই একসাথে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে এবং সবুজায়ন ও বৃক্ষ রোপন বৃদ্ধি করতে হবে বৈশ্বিক চাহিদা অনুযায়ী।নতুবা এ ক্ষেত্রে এসডিজি পূরণ হবে না। অপরদিকে জলবায়ু ফান্ডের প্রতিশ্রুত অর্থ দ্রুত পরিশোধ করা ও প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে সহায়তা করা এবং সে ফান্ড সঠিকভাবে ব্যবহার করা দরকার।
এ ক্ষেত্রে জাতিসংঘের প্রাক্তন মহাসচিব বান কি মুনের মন্তব্য স্মরণযোগ্য। মুন বলেছেন, ‘আমাদের যেহেতু দ্বিতীয় আরেকটি পৃথিবী নেই,তাই কার্বন নিঃসরণ কমাতে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ ব্যতীত আর কোন উপায়ও নেই’।
অপরদিকে, ইউএনডিপি প্রধান বলেছেন, ‘বশ্বব্যাপী উন্নয়নের শক্তিশালি ও নতুন পরিকল্পনা প্রণয়ন প্রয়োজন। মানব সমাজের উন্নয়নের কারণে পরিবেশ ও প্রকৃতিতে যে প্রভাব পড়ছে তা মোকাবিলায় এটি খুবই জরুরি’।
তিনি আরও উল্লেখ করেছেন, ‘কোভিড-১৯ মহামারির প্রকোপ অব্যাহত থাকায় এবং বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে আমাদের উন্নয়নের ধারণা আবারও নির্দিষ্ট করা উচিৎ’।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭২০
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ