নির্ধারিত বাড়ির কাজ না লিখে অন্য লেখা জমা দেয়ার অপরাধে কওমি মাদরাসার দ্বিতীয় জামায়াতের এক শিশু শিক্ষার্থীকে বেধড়ক মারধর করেছেন এক শিক্ষক। মারধরের একটি ভিডিও চিত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। ঘটনাটি ঘটেছে কুড়িগ্রাম জেলার ভূরুঙ্গামারী উপজেলার পাথরডুবি ইউনিয়নের ঢেবঢেবি বাজার কুলছুম কওমি মাদরাসায়।
শিক্ষকের হাতে শিক্ষার্থী নির্যাতনের ঘটনায় সমালোচনার ঝড় ওঠেছে। এ নিয়ে এলাকায় তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। বিষয়টি সুরাহা করতে সোমবার (১৯ এপ্রিল) বিকেলে সালিশি বৈঠকের আয়োজন করে মাদরাসা কর্তৃপক্ষ ।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ২মিনিট ৩০সেকেন্ডের ভিডিও ক্লিপটিতে দেখা যায় মাদরাসার শিক্ষক আবু সাইদ টুপি মাথায় সাদা পাঞ্জাবি পরিহিত অবস্থায় শিক্ষার্থীর কাছ থেকে পড়া আদায় করছেন। তার বাম হাতে একটি খাতা বা বই ডান হাতে একটি বেত নিয়ে বসে আছেন। কিছুক্ষণ পর গোলাপি পাঞ্জাবি পরিহিত একজন শিক্ষকার্থীকে আঘাত করছেন। আরেকটি সাদা পাঞ্জাবি পড়া একজন শিশু শিক্ষার্থীকে বেত দিয়ে গুতা দিয়ে মাথা নিচু করে মাটিতে ফেলে বেধড়ক পেটাতে থাকেন। এক পর্যায় অভিযুক্ত শিক্ষক রাগানিত্ব হয়ে ওই শিক্ষার্থীও বাম হাত চেপে ধরে জোরে জোরে পেটাতে শুরু করেন। মার সহ্য করতে না পেরে ওই শিক্ষার্থী মাগো বলে চিৎকার করে উঠে। কিন্তু থামে না শিক্ষকের মার। এসময় শ্রেণির অন্যান্য শিক্ষার্থীরা নিশ্চুপ হয়ে যায়।
ভিডিওটির সূত্র ধরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শিক্ষার্থী পাথরডুবী বাজারের বাসিন্দা এবং ঢেবঢেবি বাজারের ব্যবসায়ী মোতালেব হোসেনের ছেলে লাম মিয়া ওরফে লাল মিয়া (৭)। সে ওই মাদরাসার দ্বিতীয় জামাতের শিক্ষার্থী।
ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীর বাবা মোতালেব হোসেন মুঠোফোনে গণমাধ্যমকে জানান, ঘটনাটি ২৭ মার্চের। ছেলেকে বাড়ির কাজের জন্য নির্দিষ্ট একটি লেখা দেয়া হয়েছিল। সেই লেখা না এনে অন্য লেখা নিয়ে যাওয়ায় এমনভাবে পিটিয়েছেন ওই শিক্ষক। ছেলে বাড়িতে ভয়ে কিছু জানায়নি।
‘আমি সোমবার দুপুরে ফেসবুকে ভিডিওটি দেখে আঁতকে উঠি। বাড়িতে গিয়ে ছেলের কাছে সব ঘটনা শুনতে পাই। হুজুরের ভয়ে ছেলে এতদিন আমাদের বিষয়টি জানায়নি। ছেলের কাছে তিনি আরও জানতে পারেন, মারপিটের কথা কাউকে বললে তাকে মেরে ফেলবে বলে হুজুর ভয় দেখিয়েছেন।’
মোতালেব হোসেন আরও বলেন, ‘আমার ছেলে ছাড়াও আরও তিন চারজন শিক্ষার্থীকে ওই হুজুর একইভাবে নির্যাতন করেছেন বলে জানতে পেরেছি। এ বিষয়ে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষকে জানালে তারা সোমবার বিকেলে মিটমাট করার জন্য আমাকে ডাকে। কিন্তু আমি ওই বৈঠকে যেতে পারিনি।’
অভিযুক্ত শিক্ষক মো. আবু সাইদ জানান, ঘটনাটি প্রায় দেড় দুইমাস আগের। সেখানে দ্বিতীয় জামায়াতের নয়, তৃতীয় জামাতের শিক্ষার্থী ছিল। পরীক্ষা চলার সময় এক শিক্ষার্থী আমার সঙ্গে বেয়াদবি করায় তাকে একটু শাসন করেছি। বিষয়টি নিয়ে সে সময় মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ আমাকে শাস্তি দিয়েছে।‘
এ বিষয়ে মাদ্রাসার প্রধান মৌলভি শিক্ষক মাওলানা আবু বক্কর সিদ্দিক জানান, ‘অভিযুক্ত শিক্ষক দেড় বছর ধরে এই মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করছেন। দ্বিতীয় জামায়াতের ওই শিক্ষার্থী নির্যাতনের বিষয়ে গতকাল বাদ আসর মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ এবং নির্যাতনের শিকার শিক্ষার্থী লাল মিয়ার চাচাকে নিয়ে একটা বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে শিক্ষক আবু সাইদকে বহিস্কার করা হয়েছে।’
কুড়িগ্রামের পুলিশ সুপার সৈয়দা জান্নাত বলেন, বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখছি। ঘটনার সত্যতা পেলে ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে সরকারের নির্দেশ অমান্য করে মাদরাসা চালু রাখা ও শিশু নির্যাতনের অভিযোগসহ দুটি মামলা করা হবে।
বিশেষজ্ঞদের মন্তব্য
সংশ্লিষ্ট বিশেজ্ঞরা বলেন, মাদ্রাসা-মক্তবে করপোরাল পানিশমেন্টের প্রতিবিধান কঠিন। কারণ, এসব শিশুর পিতা-মাতা অত্যন্ত দরিদ্র এবং স্বল্পশিক্ষিত। শিক্ষা বিষয়ে তাদের বদ্ধমূল ধারণা এই যে নির্যাতন শিক্ষারই অংশ। যারাই পড়াশোনা শিখেছেন, সবাই এসব অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে গেছেন। তাহলে নতুন আপত্তির তো অর্থ হয় না। আরও সমস্যা এই যে তাদের ধর্মবোধও আদি স্তরের। ধর্মাচরণ শিখতে পাঠিয়েছেন, তাদের প্রতিবাদ বা শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ গোনাহর কাজ না হয়ে যায়, এ ভাবনায় তাদের দ্বিধার শেষ থাকে না।
শিক্ষা হলো শিশুর স্বতঃস্ফূর্ত আত্মবিকাশ। শিশুদের সামর্থ্য ও শক্তিগুলোর স্বাভাবিক ও সুষম বিকাশই শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য। শিশুদের অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্যগুলো আবিষ্কার এবং তা পরিপূর্ণভাবে বিকাশ করতে শিক্ষা পদ্ধতির বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। কখনো কখনো প্রচলিত ধারার শিক্ষা পদ্ধতির কঠোর অনুশাসন, নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিকূল পরিবেশ শিশুর শিক্ষাজীবনকে বিপন্ন করতে পারে। তাই শিশুদের সুপ্ত প্রতিভার বিকাশের ক্ষেত্রে একটি গঠনমূলক, আনন্দঘন ও শিশুবান্ধব পরিবেশ গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি, যা তাকে কৌতূহলী ও আজীবন শিক্ষানবিশ হিসাবে বেড়ে উঠতে সাহায্য করবে।
এসডব্লিউ/এমএন/ এফএ/১৪৫০
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগীতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ