করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে চলমান ‘সর্বাত্মক লকডাউন’ আরও এক সপ্তাহ বাড়ানোর চিন্তাভাবনা করছে সরকার। শনিবার (১৭ এপ্রিল) মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, করোনার সংক্রমণ বেশি থাকায় চলমান লকডাউন আরও এক সপ্তাহ বাড়তে পারে।
লকডাউন পরিস্থিতি পর্যালোচনা করতে এ বিষয়ে আগামী সোমবার সভা ডাকা হয়েছে। সেখানেই লকডাউনের বিষয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত হবে বলে জানান তিনি। দেশে করোনাভাইরাসের ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণের প্রেক্ষাপটে গত বুধবার থেকে কঠোর বিধিনিষধের ঘোষণা করে সরকার। এই বিধিনিষেধকে বলা হচ্ছে ‘সর্বাত্মক লকডাউন’।
গত বুধবার ভোর ৬টা থেকে আগামী ২১ এপ্রিল রাত ১২টা পর্যন্ত সাতদিন এ বিধিনিষেধ কার্যকর থাকবে। তবে গার্মেন্টসসহ শিল্প কারখানা এবং ব্যাংক খোলা রয়েছে। চলাচলে কড়াকড়ি আরোপসহ নানা নিষেধাজ্ঞায় বুধবার ভোর থেকে সরকারের এই নির্দেশনা কার্যকর হয়েছে। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রাস্তায় জনসাধারণের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করার জন্য চেকপোস্ট বসিয়েছে পুলিশ। এসব চেকপোস্টে গাড়ি থামিয়ে যাত্রীদের পরিচয় এবং রাস্তার বের হওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করা হচ্ছে।
যেসব পেশার মানুষ জরুরি সেবার সঙ্গে সম্পৃক্ত, তাদের চেকপোস্ট অতিক্রম করার অনুমতি দিয়ে অন্যদের ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া অনেক রাস্তাতে বেরিকেড বসিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সেসব রাস্তায় জরুরি সেবা সংস্থারও কোনো যানবাহন যেতে পারছে না; যেতে হচ্ছে বিকল্প রাস্তায়। ‘মুভমেন্ট পাস’ ছাড়া সাধারণ মানুষকে বাড়ির বাইরে আসতে দেওয়া হচ্ছে না।
গত বছরের ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্তের তথ্য জানায় সরকার। করোনায় প্রথম মৃত্যু হয় ১৮ মার্চ। এরপর সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সরকার ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছিল। কয়েক দফায় বাড়িয়ে টানা ৬৬ দিন সাধারণ ছুটি ছিল। একপর্যায়ে করোনার সংক্রমণ কমেও গিয়েছিল। কিন্তু গত মার্চ মাস থেকে করোনার সংক্রমণ আবারও বাড়ছে। পরপর দুদিন করোনায় সংক্রমিত হয়ে ১০১ জন করে মারা গেছেন।
এমন পরিস্থিতিতে করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সরকার প্রথমে ৫ এপ্রিল থেকে সাত দিনের জন্য গণপরিবহন চলাচলসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ জারি করেছিল। পরে তা আরও দুদিন বাড়ানো হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না আসায় ১৪ থেকে ২১ এপ্রিল পর্যন্ত আরও কঠোর বিধিনিষেধ দিয়ে ‘সর্বাত্মক লকডাউন’ শুরু হয়।
এখন এই লকডাউন আরও বাড়বে কি না, সেটি নিয়ে মানুষের মধ্যে আলাপ-আলোচনা চলছে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের পরিকল্পনা হলো, চলমান লকডাউন আরও সাত দিন বাড়িয়ে এরপর আবার শর্তসাপেক্ষে বিভিন্ন বিধিনিষেধ দিয়ে চলা। এভাবে পবিত্র ঈদুল ফিতর পর্যন্ত চলা। পরে পরিস্থিতি বিবেচনা করে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া। লকডাউন সাত দিন যদি বাড়ে, তাহলে ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত হয়।
পরের দিন ২৯ এপ্রিল, বৃহস্পতিবার।এর পরের দুদিন সাপ্তাহিক ছুটি। এসব বিষয় মাথায় রেখেই লকডাউনের পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে। করোনা নিয়ন্ত্রণে সরকার গঠিত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটিও সিটি করপোরেশন ও পৌর এলাকায় টানা দুই সপ্তাহের লকডাউন দেওয়ার সুপারিশ করেছে।
জানতে চাইলে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন আজ গণমাধ্যমকে বলেন, লকডাউন বাড়ানোর পরামর্শ আছে। এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ১৯ এপ্রিলের সভার পর ওই দিন বা ২০ এপ্রিল কী হবে, তা জানিয়ে দেওয়া হবে।
এদিক, সারা দেশে ‘সর্বাত্মক লকডাউনের’ চতুর্থ দিনে গত তিন দিনের তুলনায় ঢাকার রাস্তায় মানুষের ভিড় কিছুটা বেশি দেখা গেছে। কর্মস্থলে যেতে বেশ ভোগান্তিতে পড়েছেন অনেকে। গাড়ি না পেয়ে অনেকেই হেঁটে বা রিকশায় কর্মস্থলে গেছেন।
আসাদগেটে আল আমিন ইসলাম প্রাইভেট কার এলেই হাত নেড়ে থামার জন্য ইশারা করছিলেন। তিনি ডেভেলপারের কাজ করেন। যাবেন উত্তরায়। রিকশায় করে মোহাম্মদপুর থেকে সকাল সাড়ে আটটায় বের হয়ে আল আমিন ইসলাম আসেন আসাদগেটে। সকাল ১০টায়ও তিনি উত্তরায় যাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারেননি। তিনি বলেন, ‘প্রাইভেট কার, সিএনজিচালিত অটোরিকশায় ভেঙে ভেঙে যেতে হচ্ছে। কিছু কিছু প্রাইভেট কারের চালক তাঁদের মালিককে রেখে যাওয়ার সময় ভাড়ায় নিয়ে যায়। সে জন্য অপেক্ষা করছি।’
মোহাম্মদপুরের রাস্তায় জোরে হাঁটছিলেন ইফতেখার বাপ্পী। তিনি এসিআইয়ের টেরিটরি অফিসার। সরবরাহ করেন নিত্যপ্রয়োজনীয় মেডিকেল ও অন্যান্য সামগ্রী। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘আমিনবাজার থেকে হেঁটে যাচ্ছি টাউন হল পর্যন্ত। অনেক ভাড়া চায় রিকশা। তাই হেঁটেই যেতে হচ্ছে। আমাদের অফিসে যেতেই হয়।’
আবদুল হামিদ মিরপুরের হাইভ্যালি ফ্যান কোম্পানিতে কাজ করেন। তিনি বলেন, ‘যেদিন একেবারেই কোনো যানবাহন পাই না, সেদিন যাই না।’
জীবিকার তাগিদে মোটরসাইকেল নিয়ে রাস্তায় বের হয়েছেন কবির হোসেন। তিনি বলেন, ‘পেটের দায়ে নেমেছি। করোনায় চাকরি নেই। তাই রাইড (অ্যাপসভিত্তিক মোটরসাইকেল সেবা) দিচ্ছিলাম। কিন্তু এখন বন্ধ। অন্য সময় দিনে এক হাজার টাকা করে লাভ থাকে। সেই আয়ে টানা পাঁচ থেকে সাত দিন বসে খাওয়া সম্ভব না।’ কবির হোসেন জানান, পুলিশি ঝামেলা এড়াতে অলিগলি দিয়ে বাইক চালান।
ফার্মগেটে চেকপোস্টে দায়িত্ব পালন করছিলেন ট্রাফিক পুলিশ সার্জেন্ট মো. আরিফ। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আজ মানুষ একটু বেশি বের হচ্ছে। রাস্তায় বের হওয়ার বাস্তবিক কারণ দেখাচ্ছেন তারা। কেউ টিকা নেওয়ার কথা বলছেন, কেউ হাসপাতালের কথা বলে, কেউ ফ্লাইটের কথা বলছেন। মো. আরিফ জানান, অনেকেই মুভমেন্ট পাস নেননি। কীভাবে নিতে হয়, তা জানেন না। জরুরি কিছু হলে সে ক্ষেত্রে তারা যেতে দিচ্ছেন।
এসডব্লিউ/এমএন/ এফএ/২১১৯
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগীতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ