সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে সহিংসতা বহুলাংশে বেড়ে গেছে। গত এক মাসে বেশ কয়েকটি এমন ঘটনা ঘটেছে, যেখানে বন্দুকধারীর হামলায় অসংখ্য বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন। এবার যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা অঙ্গরাজ্যের সবচেয়ে জনবহুল শহর ইন্ডিয়ানাপোলিসে বন্দুকধারীর হামলায় অন্তত আটজন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও অনেকে। পুলিশের ধারণা, নিহত লোকজনের মধ্যে বন্দুকধারীও আছেন। নিজের গুলিতেই মারা যান তিনি। বার্তা সংস্থা এএফপি এ খবর দিয়েছে।
বৃহস্পতিবার রাতে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বহুজাতিক পণ্য ডেলিভারি সংস্থা ফেড-এক্সের একটি স্থাপনায় এ হামলা হয় বলে জানিয়েছে মেট্রোপলিটন পুলিশ।
শুক্রবার সকালে পুলিশের মুখপাত্র জেনায়ে কুক জানিয়েছেন, হামলায় বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন। তাদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এদের মধ্যে একজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
তিনি বলেন, বন্দুকধারী নিজেই নিজের প্রাণ নিয়েছে বলে বিশ্বাস করে পুলিশ। বর্তমানে ওই এলাকায় কোনও হুমকি নেই। হামলাকারীর উদ্দেশ্য এখনও নিশ্চিত নয়।
কুক জানান, স্থানীয় সময় রাত ১১টার দিকে ঘটনাস্থলে পৌঁছায় পুলিশ। তখন সেখানে গুলি চলছিল। এরপরও নির্দ্বিধায় ভেতরে প্রবেশ করেন পুলিশ কর্মকর্তারা।
তিনি বলেন, আমরা গুলিবিদ্ধ আটজনকে শনাক্ত করেছি, যারা ঘটনাস্থলেই মারা গেছেন।
প্রত্যক্ষদর্শীর বরাতে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি জানিয়েছে, স্বয়ংক্রিয় এক অস্ত্র ব্যবহার করে গুলি চালিয়ে যাচ্ছিলেন একজন বন্দুকধারী।
এদিকে ফেডেক্সের একজন কর্মী জেরেমিয়াহ মিলার স্থানীয় সম্প্রচারমাধ্যম উইশ-টিভিকে বলেন, তিনি এক বন্দুকধারীকে গুলি করতে দেখেন। আতঙ্কিত হয়ে তিনি সঙ্গে সঙ্গে নিচে শুয়ে পড়েন। বন্দুকধারী নিজের গুলিতে আত্মহত্যা করেছেন বলে তারা ধারণা করছেন।
ফেডেক্সের মুখপাত্র এএফপিকে জানিয়েছেন, ঘটনার অনুসন্ধান ও তদন্তে তারা কর্তৃপক্ষকে সব ধরনের সহযোগিতা করছেন।
যুক্তরাষ্ট্রে দিন দিন বন্দুক হামলাসহ সহিংস ঘটনা বেড়েই চলেছে।
এর আগে গত ৯ এপ্রিল টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের ব্রায়ানের একটি শিল্প উদ্যান এলাকায় এক বন্দুকধারীর গুলিতে একজন নিহত ও ছয়জন গুরুত্বর আহত হয়েছেন।
তার আগে ৩১ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় একটি বাণিজ্যিক ভবনে বন্দুক হামলার ঘটনায় এক শিশুসহ চারজন নিহত হয়েছে।
২৩ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডো অঙ্গরাজ্যের বলডার নগরীর একটি গ্রোসারি মার্কেটে বন্দুকধারীর গুলিতে পুলিশের এক কর্মকর্তাসহ অন্তত ১০ ব্যক্তি নিহত হয়েছেন।
২০ মার্চ পেনসিলভানিয়া অঙ্গরাজ্যের ফিলাডেলফিয়ায় একটি আবাসিক এলাকায় অবৈধ পার্টিতে গুলির ঘটনা ঘটেছে। এতে ঘটনাস্থলে একজন নিহত ও পাঁচজন গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়েছেন।
ফিলাডেলফিয়া পুলিশ কমিশনার ড্যানিয়েলে আউট ল জানিয়েছেন, ওই দিন সকালে ওই পপ-আপ পার্টিতে অন্তত ১৫০ জন উপস্থিত ছিলেন। সেখানেই এলোপাতাড়ি গুলির ঘটনা ঘটে।
একই দিনে টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের হাউসটনে একটি ক্লাবে গুলির ঘটনায় পাঁচজন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। তাদের মধ্যে একজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছে পুলিশ।
একই দিনে টেক্সাসে ডালাসের একটি নৈশক্লাবে অজ্ঞাত একজন বন্দুকধারীর হামলায় গুলিবিদ্ধ হয়ে ২১ বছর বয়সী একজন তরুণী নিহত ও সাতজন গুরুতর আহত হয়েছেন।
১৮ মার্চ অরেগন অঙ্গরাজ্যের গ্রেসাম সিটিতে এক বন্দুকধারীর হামলায় চারজন গুরুতর আহত হয়েছেন। তাদের হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে বলে পুলিশ এক টুইট বার্তায় জানিয়েছে।
১৭ মার্চ ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের স্টকটনে গুলির ঘটনা ঘটেছে। সান জোয়াকিন শেরিফের দপ্তর থেকে জানানো হয়েছে, এ ঘটনায় কেউ গুরুতর আহত হয়নি।
সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের তথ্য অনুযায়ী, বন্দুকধারীর হামলায় ২০১৯ সালে প্রায় ৪০ হাজার মানুষ নিহত হয়েছে। আর চলতি বছর এ ধরনের আরও চারটি ঘটনা ঘটেছে।
এর মধ্যে গত ৯ জানুয়ারি ইলিনয় অঙ্গরাজ্যের এভানস্টোনের একজন বন্দুকধারীর গুলিতে পাঁচজন নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া বন্দুকধারীর হামলায় ২৪ জানুয়ারি ইন্ডিয়ানাপোলিসে পাঁচজন, গত ২ ফেব্রুয়ারি ওকলাহোমার মুসকিজিতে ছয়জন ও ১৩ মার্চ ইন্ডিয়ানাপোলিসে চারজন নিহত হয়েছেন।
কিন্তু কেন হয় এমন হত্যাকাণ্ড? বিবিসি সেই কারণ অনুসন্ধানে জানা গেছে, উন্নত প্রযুক্তির দ্রুতগতির অস্ত্রগুলোই এর জন্য দায়ী। এছাড়া দেশটির সহজ অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ আইনও এজন্য দায়ী।
হারভার্ড স্কুল অব পাবলিক হেল্থের কর্মকর্তা উন্নত প্রযুক্তির দ্রুতগতির অস্ত্রগুলোকে এর জন্য দায়ী করেছেন। তার মতে, এতে কম সময়ে বেশিগুলি করা যাচ্ছে। এক অস্ত্রেই অনেক মানুষ মারা যাচ্ছে।
১৯৯৪ সালে সেমি অটোমেটিক, উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন অস্ত্রগুলোর ওপর মার্কিন সরকার নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল। কিন্তু ২০০৪ সালে তা তুলে নেওয়া হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ আইন তুলে নেওয়ায় বন্দুক হামলার নতুন যুগ শুরু হয়। এসব অস্ত্রের মাধ্যমে দ্রুত গতিতে এবং বেশি সময় ধরে অনেক মানুষকে মারতে পারছে দুষ্কৃতিকারীরা। এসব হামলার কোনোটা আবার এশীয়-আমেরিকানদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষের কারণে ঘটেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
আক্রমণকারীরা মানুষের ভিড় আছে এমন জায়গাগুলো বেছে নিচ্ছে। এমন ভিড় যেখানে কোথাও নির্দিষ্ট লক্ষ্য তাক করতে হয় না। এমনটাই বলছেন ইউনিভার্সিটি অব সেন্ট্রাল ফ্লোরিডার জে করজিন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বন্দুক হামলার উদ্দেশ্য খুঁজে বের করা কঠিন এবং কঠোর নীতি প্রণয়ন করাও কঠিন। কিন্তু বন্দুক হামলার সুযোগ বন্ধ করা তেমন কঠিন নয়। শ্বেতাঙ্গদের শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার সারা দুনিয়াতেই আছে এবং আছে তাদের সহিংস ইচ্ছার বাহার। কিন্তু একজন সহিংস মানুষের হাতে রান্না করার ছুরি বা বেসবল খেলার ব্যাট হাতে যতটা না ভয়ংকর তারচেয়ে অনেক বেশি ভয়ংকর স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে। কারণ চোখের পলকেই সে ১০০ রাউন্ড গুলি ছুঁড়তে সক্ষম। আর এ পদ্ধতিটি সন্দেহাতীতভাবে লোভনীয়।
তারা বলেন, কথা খুব স্পষ্ট যে, স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের মালিকানা নিয়ে ক্রাইস্টচার্চ হামলার পর নিউজিল্যান্ড যে ধরণের নীতি গ্রহণ করেছে, একই রকম নীতি গ্রহণ করলে যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুক হামলার ঘটনা কমতে পারে। কিন্তু এভাবে সব বন্দুক হামলায় মৃত্যু রোধ করা সম্ভব হবে না। যেমন সম্ভব হবে না সংবিধান সংশোধন করার মাধ্যমেও। যুক্তরাষ্ট্রের বন্দুক হামলার সমস্যা, ব্রাজিলের বন উজাড় হওয়া বা চীনের বায়ু দূষণের মতোই ভয়াবহ। মানবসৃষ্ট পরিবেশ বিপর্যয় বন্ধ করা কঠিন এবং রাতারাতি পরিবর্তন সম্ভব ও নয়। তবে তাই বলে সাহসী মানুষের অভিযাত্রা থেমে থাকবে কেন?
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬৫৪
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ