ভারতের তামিলনাড়ুর ‘গ্লোবাল হিউম্যান পিস ইউনিভার্সিটি’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি পাওয়ার দাবি করেছিলেন কণ্ঠশিল্পী ও সংসদ সদস্য মমতাজ বেগম। গত শনিবার এক অনুষ্ঠানে তাকে সম্মানসূচক ‘ডক্টরেট অব মিউজিক’ ডিগ্রি প্রদান করা হয়েছে বলে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানান মমতাজ। কিন্তু সংবাদ পর্যবেক্ষণ বিষয়ক সাইট বিডি ফ্যাক্টচেকের অনুসন্ধানে এক বিস্ময়কর তথ্য উঠে এসেছে। বিডি ফ্যাক্টচেক বিভিন্ন সূত্র পরীক্ষা করে জানায়, মমতাজকে ডক্টরেট ডিগ্রি দেওয়া বিশ্ববিদ্যালয়টি ভুয়া!
শনিবার ১০ এপ্রিল ভারতের তামিলনাড়ুর গ্লোবাল হিউম্যান পিস ইউনিভার্সিটি এ সম্মাননা দিয়েছে বাংলাদেশের লোকগানের শিল্পী ও সাংসদ মমতাজকে। একটি বার্তায় তারা উল্লেখ করে, শিল্পী হিসেবে ৭০০টির বেশি একক অ্যালবামের রেকর্ড, সুদীর্ঘ ৩০ বছর বাংলা গানকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরা ও সমাজসেবা ছাড়াও নানামুখী কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত রেখে নিজেকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন মমতাজ। যে কারণে তারা বিশেষ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শনিবার তাকে ‘ডক্টর অব মিউজিক’ পদক প্রদান করে। মমতাজের হাতে এই সম্মাননা তুলে দেন বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান পি ম্যানুয়েল। একই সময়ে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেছেন চেন্নাইয়ের সাবেক জেলা জজ থিরু এজে মুরুগানানথাম, তামিলনাড়ুর আধ্যাত্মিক ধর্মগুরু খলিফা মাস্তান সাহেব ক্বাদিরি, কেরালা ডক্টর এ পি জে আবদুল কালাম ইনস্টিটিউট অব বিজনেস ম্যানেজমেন্ট পরিচালক উইলাত কোরাইয়া।
সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি গ্রহণ করতে ১০ এপ্রিল সকালের ফ্লাইটে ভারতে রওনা হন মমতাজ। যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতা শেষে গত ১২ এপ্রিল তিনি দেশে ফিরেছেন।
তবে মমতাজকে যে প্রতিষ্ঠানের তরফ থেকে ‘ডক্টরেট অব মিউজিক’ প্রদান করা হয়েছে সেই গ্লোবাল হিউম্যান পিস ইউনিভার্সিটি নামে কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম ভারতের মোট ৯৭৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় পাওয়া যায়নি। সংবাদ পর্যবেক্ষণ বিষয়ক সাইট বিডি ফ্যাক্টচেক এ তথ্য দিয়েছে।
বিডি ফ্যাক্টচেকের অনুসন্ধান বলছে, গ্লোবাল হিউম্যান পিস বিশ্ববিদ্যালয় ভারতের ইউজিসি অ্যাক্ট-১৯৫৬ অনুযায়ী কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ই নয় এবং এটি কোনো ডিগ্রিও প্রদান করতে পারে না। ভারতের ৯৭৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় নেই এ বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম।
গ্লোবাল হিউম্যান পিস ইউনিভার্সিটির নামে একটি ওয়েবসাইট পাওয়া গেছে। যা ঘেটে এর স্থায়ী ক্যাম্পাসের কোনো ঠিকানা পাওয়া যায়নি। তবে তাদের কিছু আঞ্চলিক কেন্দ্রের ঠিকানা দেওয়া আছে। এই ঠিকানাগুলো গুগল ম্যাপে সার্চ করে এই সম্পর্কিত কোনো কিছু পা্ওয়া যায়নি। বিশ্ববিদ্যালয়টির আঞ্চলিক কেন্দ্র হিসেবে কলকাতার একটি ঠিকানা ব্যবহার করা হলেও এই ঠিকানায় বিশ্ববিদ্যালয়টির কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।
মমতাজের উল্লেখ করা গ্লোবাল হিউম্যান পিস ইউনিভা’র্সিটির অফিসিয়াল ওয়েব সাইটে গিয়ে এর কোনো প্রতিষ্ঠা সন ও তারিখ উল্লেখ পাওয়া যায়নি। বিশ্বের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটের ডোমেইন ডট এডু (.edu) দিয়ে থাকলেও এর নামের শেষে রয়েছে ডট ওআরজি (.org). যা কেবল সংগঠন সমূহের ক্ষেত্রেই ব্যবহার করা হয়।
গ্লোবাল হিউম্যান পিস ইউনিভার্সিটির ওয়েবসাইট ঘেটে বিডি ফ্যাক্টচেক আরও বলছে, এখান থেকে কোনো আন্ডারগ্রাজুয়েট ও গ্রাজুয়েট ডিগ্রি দেওয়া হয় না। শুধু কিছু অনলাইনভিত্তিক কোর্সের লিংক দেওয়া আছে। তবে সম্মানসূচক পিএইচডি ডিগ্রি দেওয়া হয় অনেকগুলো বিষয়ে। বিশ্বে এমন কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নাই যেখানে আন্ডারগ্রাজুয়েট ও গ্রাজুয়েট ডিগ্রি না দিয়ে শুধু সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি দেওয়া হয়।
গ্লোবাল হিউম্যান পিস ইউনিভার্সিটি’র বিরুদ্ধে টাকার বিনিময়ে ডিগ্রি দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এমনকি ওয়েবসাইটের প্রশ্নাবলি পাতায় বলা হয়েছে, চ্যারিটি কিংবা গবেষণা উন্নয়ন ব্যয়ের ফান্ড যোগাড় করার জন্য তারা সম্মানসূচক পিএইচডি ডিগ্রি প্রদান করে।
এদিকে ভারতের বেশ কিছু সংবাদ মাধ্যমে গত বছরের সেপ্টেম্বর প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, আন্তর্জাতিক গ্লোবাল পিস বিশ্ববিদ্যালয় নামে একটি প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থের বিনিময়ে ডক্টরেট ডিগ্রি বিক্রয় করা হয়। ২৬ সেপ্টেম্বর এমন একটি অনুষ্ঠান বন্ধ করে স্থানীয় পুলিশ। সেখান থেকে দু’জনকে পুলিশ হেফাজতেও নেওয়া হয়েছিল।
তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রিগুলি অর্থের জন্য লোকদের কাছে বিক্রি করা হয়। স্থানীয় একটি হোটেলে ভারতের জাতীয় মানবাধিকার শান্তি কাউন্সিল এবং আন্তর্জাতিক গ্লোবাল পিস বিশ্ববিদ্যালয় এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল। হরিহার বিধায়ক রামাপ্পা এই অনুষ্ঠানের প্রধান অ’তিথি ছিলেন।
অনুষ্ঠান পণ্ড করে দেওয়া পু’লিশ কর্মকর্তা জানিয়েছিলেন, বিধায়কও এই ডিগ্রির প্রার্থী ছিলেন। রাজ্য জুড়ে এবং তামিলনাড়ু ও অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে মোট ১৪২ জন প্রার্থী এই ডিগ্রি অর্জনের জন্য জড়ো হয়েছিল। বেশিরভাগ প্রার্থী ডিগ্রির জন্য ২০,০০০ টাকা থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থ প্রদান করেছিলেন।
এদিকে এমন অভিযোগের ভিত্তিতে দেশের ‘ফোক সম্রাজ্ঞী’ মমতাজ জাতীয় এক দৈনিককে বলেন, ‘আমার কাছে বিশ্ববিদ্যালয়টি ভুয়া মনে হয়নি। আর ভুয়া বলে যে বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম আসছে সেটা এ বিশ্ববিদ্যালয় নয়।’
মমতাজ আরও বলেন, ‘আমাকে প্রতিষ্ঠানটি প্রপার ওয়েতে সম্মানসূচক ডিগ্রি প্রদান করেছে। আমি ওখানে উপস্থিত হয়ে এটা গ্রহণ করেছি। ওই আয়োজনে শত শত মানুষ ছিলেন। আমার হাতে এই সম্মাননা তুলে দেন বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান পি ম্যানুয়েল। একই সময়ে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেছেন চেন্নাইয়ের সাবেক জেলা জজ থিরু এজে মুরুগানানথাম ও তামিলনাড়ুর আধ্যাত্মিক ধর্মগুরু খলিফা মাস্তান সাহেব। সেখানে হাজির হয়ে বিষয়টি কোনোভাবেই ভুয়া মনে হয়নি আমার কাছে।’
কীভাবে ও কী প্রক্রিয়ায় এই ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেছেন? এমন প্রশ্নে মমতাজের উত্তর, ‘আমি নিজে তো চাইনি। তারা আমাকে খুঁজে নিয়েছেন। আমার সারা পৃথিবীতে একমাত্র সংগীতশিল্পী হিসেবে প্রকাশিত আট শতাধিক অ্যালবামের বিশ্ব রেকর্ডসহ একাধিক অর্জন খুঁজে বের করে তারা আমাকে ডেকে এই ডিগ্রি দিয়েছেন।’
অন্তর্জালে ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে এই ব্যাপারটি নিয়ে। যদিও এ প্রসঙ্গে সংগীতশিল্পী ও সংসদ সদস্য মমতাজের ভাষ্য, ‘সমালোচনা তো মানুষ করবেই। কেউ এগিয়ে গেলে, পেছনে…।’
মমতাজ তিন দশকের বেশি সময় ধরে পেশাদার শিল্পী হিসেবে কাজ করছেন। সংগীতজীবনে সাত শতাধিক একক অ্যালবাম প্রকাশিত হয়েছে তার। ২০০০ সালে হানিফ সংকেতের আমন্ত্রণে জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’তে গান করেন তিনি। মোহাম্মদ রফিকউজ্জামানের কথায় ও সোহেল আজিজের সুরে ‘রিটার্ন টিকিট’ গানটি গেয়েছিলেন সে সময়। এরপরই রাতারাতি সারা দেশের শ্রোতাদের কাছে পৌঁছে যান তিনি। ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে সাংসদ নির্বাচিত হন মমতাজ। ২০১৮ সালে মানিকগঞ্জ-২ আসন থেকে নির্বাচিত হন এই শিল্পী। তার আগে ২০০৯ সালে নবম জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত মহিলা আসনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কর্তৃক সংসদ সদস্য মনোনীত হন।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭১৯
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ