ব্যাংক থেকে টাকা বের করতে এবার ভিন্ন কৌশলে এগোচ্ছেন দেশের শীর্ষ খেলাপিরা। খেলাপি হওয়ার কারণে নিজেরা ঋণ নিতে ব্যর্থ হয়ে উত্তরসূরিদের নামে ভিন্ন ব্যবসায়ী গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নেওয়ার পাঁয়তারা করছেন তাঁরা। এরই মধ্যে চট্টগ্রামভিত্তিক তিনটি বড় গ্রুপের খেলাপিদের উত্তরসূরিরা ভিন্ন গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করে কয়েকটি ব্যাংকে ঋণ নেওয়ার আবেদনও করেছেন। তবে তাঁদের ঋণ দেওয়ার বিষয়ে সতর্ক রয়েছে ব্যাংকগুলো। বিশ্লেষকরা বলছেন, এটা শীর্ষ খেলাপিদের ব্যাংক থেকে আবার ঋণ বের করে নেওয়ার ভিন্ন কৌশল। সতর্ক না হলে ব্যাংকগুলো আবার ঝুঁকির মধ্যে পড়বে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সাবেক মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমেদ চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, এটা খেলাপিদের ব্যাংক থেকে ঋণ বের করে নেওয়ার আরেকটি কৌশল। ব্যাংকগুলো একটু সতর্ক হলেই এটা হয়তো আটকানো সম্ভব হবে। তবে তাঁরা কিন্তু বসে থাকবেন না। কিছুদিন পর অন্য কোনো কৌশল ঠিকই বের করবেন। তিনি আরো বলেন, ব্যাংক কম্পানি আইনে তাঁদের ঋণ দেওয়া যাবে কি যাবে না, এ বিষয়ে সরাসরি কিছু বলা নেই। কিন্তু যারা ঋণ অনুমোদন ও বিতরণ করবে, তারা কেওয়াইসি করার সময়ই দেখতে পারে এই নতুন গ্রুপগুলো কিভাবে সৃষ্টি হলো, এদের পূর্বসূরি কারা বা তাদের পুঁজির উৎস কী। সেটা যদি পূর্বসূরিদের টাকায় করা হয়ে থাকে, তাহলে সেটাও ব্যাংকেরই টাকা। সেই টাকা আদায় না করে আবার ঋণ দিতে উৎসাহিত হলে ব্যাংকগুলোই ঝুঁকির মধ্যে পড়বে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চট্টগ্রামের আলোচিত এসএ গ্রুপ, বলাকা গ্রুপ ও ইলিয়াস ব্রাদার্সের কাছে সরকারি-বেসরকারি বেশ কয়েকটি ব্যাংকের পাওনা প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকা। এই টাকা আদায়ে আদালতে মামলা করা হলেও তা প্রায় এক দশক ধরে বিচারাধীন। এই গ্রুপগুলোর উত্তরসূরিরাই এখন ভিন্ন গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করে অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, বাপ-দাদার প্রতিষ্ঠিত গ্রুপের টাকায় ভিন্ন গ্রুপ প্রতিষ্ঠা এবং তাঁদের অফিস, গুদাম, কারখানা, জমি ইত্যাদি স্থাবর ও অস্থাবর সব সম্পত্তি ভোগ করলেও উত্তরসূরিরা এর দায় নিতে নারাজ।
নিয়মানুযায়ী কোনো ব্যক্তি বা গ্রুপ ঋণখেলাপি হলে নতুন কোনো ঋণ নিতে পারেন না। এমনকি কোনো জাতীয় নির্বাচনেও অংশগ্রহণ করতে পারেন না। তাই নতুন ঋণ পাওয়ার জন্য ব্যবসায়ী গ্রুপগুলো খেলাপি ঋণের কিস্তি পরিশোধ করে থাকে। সূত্র বলছে, খেলাপের কারণে এই গ্রুপগুলোও নতুন ঋণ নিতে পারছে না। আবার বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ নীতিমালার আওতায় ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্টে ১০ বছরের জন্য ঋণ পুনঃ তফসিলের সুযোগও কাজে লাগাননি কেউ কেউ। তাই কৌশল হিসেবে গ্রুপগুলোর ভালো প্রতিষ্ঠানগুলো হস্তান্তরের মাধ্যমে ভিন্ন গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করে উত্তরসূরিদের মাধ্যমে ব্যবসা পরিচালনা করছেন এবং ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার পাঁয়তারা করছেন।
দেশের শীর্ষ খেলাপিদের মধ্যে অন্যতম এসএ গ্রুপের চেয়ারম্যান শাহাবুদ্দিন আলম ১৮টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা খেলাপি। এই ঋণ আদায়ে শাহাবুদ্দিনের বিরুদ্ধে শতাধিক মামলা দায়ের করা হয়েছে। ২০১৮ সালের ১ অক্টোবর তাঁকে একটি মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। পরে তিনি জামিনে বের হয়ে ছেলে সাজ্জাদ আরেফিনের নামে মুশকান গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করেন। গ্রুপটি এরই মধ্যে নতুন ঋণের জন্য উত্তরাসহ কয়েকটি বাণিজ্যিক ব্যাংকে আবেদন করেছে। ব্যাংকাররা বলেছে, এসএ গ্রুপ হলো এমন একটি সংস্থা, যা দেশের ব্যাংকিং খাতকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে। আগের দায় থেকে নিজেকে রক্ষা করে নতুন ব্যাংকঋণ পাওয়ার কৌশল হিসেবে নতুন গ্রুপটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। জানতে চাইলে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকারর্স বাংলাদেশের সাবেক চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এগুলো হতেই পারে না। আমাদের ব্যাংকারদেরও দেখতে হবে এরা কারা। যদি তারা আইনের ফাঁকফোকরে বের হতেও চায়, আমাদের দায়িত্ব হবে এটা আটকানো। নতুন ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে শুধু সতর্ক হলেই হবে না, প্রয়োজনে ব্যাংক কম্পানি আইন সংশোধন করে তাদের বর্জন করতে হবে।’ চট্টগ্রামের আলোচিত আরেক গ্রুপ হলো বলাকা গ্রুপ, যার কর্ণধার নুরুন নবী। এই গ্রুপের কাছে বিভিন্ন ব্যাংকের পাওনা প্রায় ৮০০ কোটি টাকা, যা আগেই খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। মালিক নুরুন নবী ব্যাংকের টাকা ফেরত না দিয়ে ছেলে সাফাত বিন নবীর নামে ড্রিম গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করেছেন। বলাকা গ্রুপ এবং এর সহায়ক প্রতিষ্ঠানগুলোর গৃহীত ঋণ নিয়ে এই গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করা হয়। ব্যাংকের নথিতে বলাকা গ্রুপের ঠিকানাটি নিব হাউস, আগ্রাবাদ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। বলাকা গ্রুপের ঠিকানায় ড্রিম গ্রুপের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে।
রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকের এমডি মোহাম্মদ শামস-উল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এটা অবাক করার মতো একটা বিষয়। আমরা এই গ্রুপগুলোকে দেওয়া আগের ঋণই ফেরত পাচ্ছি না। এখন ভিন্ন নামে গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করার অর্থই হচ্ছে নতুন করে ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার চেষ্টা। কিন্তু আমি মনে করি, তাদের নতুন করে কোনোক্রমেই ঋণ দেওয়া ঠিক হবে না। এদের যেকোনোভাবে আটকাতে হবে। সব ব্যাংকেরই এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।’
শীর্ষ খেলাপিদের তালিকার আরেক আলোচিত গ্রুপ ইলিয়াস ব্রাদার্স। একসময় দেশের ভোগ্য পণ্য ব্যবসায় নেতৃত্ব দেওয়া গ্রুপটি দেশের সরকারি-বেসরকারি ১৫টি ব্যাংকে এক হাজার কোটি টাকার ঋণখেলাপি। জানা যায়, ইলিয়াস ব্রাদার্সের মালিকদের তৃতীয় প্রজন্ম, এখন ইলিয়াস ব্রাদার্সের মালিক মোহাম্মদ ইলিয়াসের নাতি মোহাম্মদ শোয়েব রিয়াদের নেতৃত্বে এই গ্রুপের নাম এমইবি শিল্প কমপ্লেক্স নামে পরিবর্তন করা হয়েছে।
জানা যায়, এমইবি বর্তমানে বিটুমিন আমদানিসহ বেশ কয়েকটি খাতে ব্যবসা পরিচালনা করছে। বোতলজাত পানি, ভোজ্য তেল ও ভোগ্য পণ্যের ব্যবসা বর্তমানে বন্ধ রয়েছে। তবে শোয়েব তাঁর পূর্বসূরিদের নেওয়া ব্যাংকঋণের দায় নিতে রাজি নন বলে ব্যাংক কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।
সম্প্রতি টিআইবির এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, একক ব্যক্তি বা গ্রুপ একটি ব্যাংক থেকে সর্বোচ্চ কী পরিমাণ ঋণ গ্রহণ করতে পারবে, তা একক বৃহত্তম ঋণসীমা নীতিমালায় নির্ধারিত হলেও সার্বিকভাবে ব্যাংকিং খাতে ব্যক্তি ও গ্রুপের সর্বোচ্চ ঋণসীমা উল্লেখ না থাকার সুযোগে ঋণগ্রহীতারা, বিশেষত ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিরা বিভিন্ন কৌশল ও যোগসাজশের মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ বের করে নিচ্ছেন, যার উল্লেখযোগ্য অংশ পরবর্তী সময়ে খেলাপি হয়ে পড়ছেন।
সূত্র : কালের কন্ঠ, পৃষ্ঠা ১ / ০৪ নভেম্বর ২০২০
আপনার মতামত জানানঃ