কোভিড-১৯ থেকে সেরে ওঠা প্রতি তিনজনের একজন ছয় মাসের মধ্যে মস্তিষ্কের বা স্নায়বিক রোগে আক্রান্ত হতে পারে বলে সম্প্রতি এক গবেষণায় জানা গেছে। দুই লাখ ত্রিশ হাজারের বেশি আমেরিকান কোভিড আক্রান্তদের উপর এই গবেষণা করা হয়।
গত মঙ্গলবার বিজ্ঞানীরা জানান, এই গবেষণার পর ধারণা করা হচ্ছে, করোনা পরবর্তী পৃথিবীর বিশাল এক জনগোষ্ঠী জর্জরিত হবে মানসিক ও স্নায়বিক রোগে।
এই গবেষণার সাথে সংশ্লিষ্টরা জানান, এটা নিশ্চিত নয় কীভাবে করোনা ভাইরাস মানুষের মানসিক অবস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে, যেমন করোনা আক্রান্তদের দুশ্চিন্তা ও হতাশাগ্রস্ত হবার প্রবণতা কয়েকগুণ হারে বেড়ে যায়।
তবে আক্রান্তদের উপর এই গবেষণায় তারা ১৪ টি রোগ পর্যালোচনা করেছে। যার মধ্যে আক্রান্তদের মধ্যে দুশ্চিন্তা এবং হতাশার প্রবণতা ছিল খুব বেশি।
কোভিড পরবর্তী সময়ে স্ট্রোক, ডিমেনশিয়া (এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির বুদ্ধি, স্মৃতি ও ব্যক্তিত্ব লোপ পায়) এবং অন্যান্য স্নায়বিক রোগ খুব কম চোখে পড়লেও গবেষকদের মতে কোভিড-১৯ এ আক্রান্তদের মধ্যে যাদের শারিরীক অবস্থা মারাত্মক ছিল, তাদের মধ্যে এই প্রবণতা অনেক বেশি।
ব্রিটেইনের অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির সাইকিয়াট্রিস্ট ম্যাক্স টাকুয়েট বলেন, অন্যান্য ফ্লু বা শ্বাসতন্ত্রের রোগের থেকে কোভিড-১৯ এ আক্রান্তদের মধ্যে মস্তিষ্কজনিত এবং স্নায়বিক রোগ বেশি দেখা যায়।
তিনি আরও বলেন, এই গবেষণা থেকে যদিও এর জীবতাত্ত্বিক ও মনস্তাত্ত্বিক সংযোগ জানা যায়নি। তবে এমন কিছু ঘটা রোধ করতে এবং আক্রান্তদের চিকিৎসার জন্য দ্রুত আরও গবেষণা প্রয়োজন।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা কোভিড-১৯ থেকে সেরে ওঠা রোগীদের মধ্যে মস্তিষ্কজনিত এবং মানসিক রোগে আক্রান্ত হবার প্রবল সম্ভাবনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। গত বছর কোভিড-১৯ এ আক্রান্তদের উপর একই গবেষকদের এক গবেষণায় জানা যায়, কোভিড থেকে সেরে ওঠা ২০% রোগীদের মধ্যে তিনমাসের মধ্যে মানসিক রোগ দেখা যায়।
নতুন গবেষণাটি ল্যানসেট সাইকিয়াট্রি জার্নালে সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত ২ লাখ ৩৬ হাজার ৩৭৯ জন রোগীর উপর এই গবেষণা চালানো হয়। যাদের অধিকাংশই আমেরিকান। এই গবেষণায় জানা যায়, এর প্রায় ৩৪% রোগীর মধ্যে ছয় মাসের ভিতর স্নায়বিক ও মানবিক রোগের লক্ষণ দেখা গেছে।
বিজ্ঞানীরা বলেন, অন্যান্য ফ্লু ও শ্বাসকষ্টজনিত রোগের চেয়ে কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে এর প্রবণতা বেশি। মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হবার ক্ষেত্রে কোভিড-১৯ বিশেষভাবে দায়ী।
গবেষকেরা দেখতে পান, ফ্লু থেকে সেরে ওঠা ব্যক্তিদের চেয়ে করোনায় আক্রান্ত হওয়া ব্যক্তিদের স্নায়বিক ও মানসিক অসুস্থতার ঝুঁকি ৪৪ শতাংশ বেশি।
১৭% রোগীর মধ্যে দুশ্চিন্তা এবং ১৪% রোগীর মধ্যে বিষণ্নতা দেখা গেছে। যেসব রোগীরা করোনা আক্রান্তকালীন সময়ে ইনটেনসিভ কেয়ারে ভর্তি ছিলেন, তাদের ৭% রোগীর ছয় মাসের মধ্যে স্ট্রোকের ঝুঁকি আছে এবং ২% রোগীর ডিমেনশিয়া।
যদিও একজন রোগীর ক্ষেত্রে করোনা পরবর্তী সময়ে মানসিক রোগে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা কম, তবে একটা বিশাল জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে এই অবস্থা উদ্বেগজনক হয়ে উঠতে পারে।
কেইস স্টাডি
করোনা ভাইরাস সংক্রমণের পর দু’বার স্ট্রোকের শিকার হয়েছিলেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ সংক্রান্ত পরিচালক পল মিলরি। স্ট্রোকের পর তার চিকিৎসা করেছিলেন কনসালট্যান্ট নিউরোলজিস্ট ডা. অরবিন্দ চন্দ্রদেবা।
তিনি বলেন, তিনি যখন বাড়ি ফিরতে হাসপাতাল থেকে বের হবেন ঠিক তখন পলকে নিয়ে এ্যাম্বুলেন্সটি আসে। পলের মুখে তখন একটা ভাবলেশহীন অভিব্যক্তি, তিনি শুধু এক পাশে দেখতে পাচ্ছিলেন, তিনি কীভাবে মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে হয়, বা তার পাসকোড কী এসব মনে করতে পারছিলেন না।
দ্বিতীয় স্ট্রোকের পর পলের মস্তিষ্কের একটা অংশে রক্ত পৌঁছাতে পারছিল না। ডা. চন্দ্রদেবা বলেন, রক্ত জমাট বাঁধার পরিমাণ মাপার একটা সূচক আছে যাকে বলা হয় ডি-ডাইমার। সুস্থ মানুষের ক্ষেত্রে এটা হয় ৩০০-রও কম। কিন্তু স্ট্রোকের রোগীদের ক্ষেত্রে তা ১০০০-এ উঠে যায়। কিন্তু পল মিলরির ক্ষেত্রে এটা ৮০,০০০ ছাড়িয়ে গিয়েছিল যা প্রায় অবিশ্বাস্য।
তিনি বলেন, “আমি কখনও এমন ব্যাপার দেখিনি। করোনাভাইরাস সংক্রমণের প্রতিক্রিয়ায় তার শরীরে এমন একটা কিছু হয়, যাতে তার রক্ত জমে আঠালো হয়ে গিয়েছিল”।
ড. চন্দ্রদেবার হাসপাতাল এন এইচ এন এন-এ দু সপ্তাহের মধ্যে ৬ জন কোভিড-১৯ আক্রান্ত লোককে ভর্তি করা হয়, যাদের স্ট্রোক হয়েছে। তাদের প্রত্যেকের দেহে রক্ত গুরুতরভাবে জমাট বেঁধে গিয়েছিল।
এর একটা কারণ হলো করোনাভাইরাস সংক্রমণের পর দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার অতিমাত্রায় সক্রিয় হয়ে ওঠা। যাতে দেহে ও মস্তিষ্কে প্রদাহ সৃষ্টি হয়।
ডাক্তাররা ভেবেছিলেন ৬৪ বছর বয়স্ক পল মিলরি দু’দফা স্ট্রোকের পর হয়তো বাঁচবেন না, বা পঙ্গু হয়ে যাবেন। তার স্ত্রী ও মেয়েরাও তাই ভেবেছিলেন। কিন্তু তিনি ভালোভাবেই সেরে উঠেছেন। তিনি এখনও একাধিক ভাষায় কথা বলতে পারেন ভালোভাবেই, কিন্তু আগের মত দ্রুতগতিতে পড়তে পারেন না, এবং কখনো কখনো তিনি নানা জিনিস ভুলে যাচ্ছেন।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৭২৪
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগীতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগীতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগীতার অনুরোধ জানাচ্ছি।
[wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ