দেশে করোনা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। বিগত দুইদিনের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত প্রেস বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, এ দুদিনেই দেশে পাঁচ সহস্রাধিক করে করোনা রোগী শনাক্ত করা হয়েছে।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য বিভাগ জানিয়েছে যে দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ দ্রুত হারে বাড়ছে এবং এই মুহূর্তে অন্তত ২৯টি জেলা করোনাভাইরাসের উচ্চ সংক্রমণের ঝুঁকিতে রয়েছে।
এসব জেলার মধ্যে রয়েছে ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, ফেনী, চাঁদপুর, নীলফামারী, সিলেট, টাঙ্গাইল, গাজীপুর, কুমিল্লা, নোয়াখালী, মাদারীপুর, নওগাঁ, রাজশাহী ইত্যাদি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা সাংবাদিকদের বলেন যে, গত কিছুদিন ধরে বাংলাদেশে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে এবং সংক্রমণের মাত্রা “খুব দ্রুত বাড়ছে”।
তিনি বলেন, “মার্চের ১৩ তারিখে সংক্রমণের মাত্রা উচ্চ ছিল ৬টি জেলায়, ২০ তারিখে দেখা গেছে ২০টি জেলা ঝুঁকিতে আছে। আর মার্চের ২৪ তারিখে দেখা গেছে করোনাভাইরাস সংক্রমণের হার উচ্চ এমন জেলার সংখ্যা ২৯টি। ফলে বোঝাই যাচ্ছে, সংক্রমণের হার দ্রুত বাড়ছে।”
করোনাভাইরাস থেকে ঝুঁকির মাত্রা প্রতি সপ্তাহেই বিশ্লেষণ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। বিভিন্ন জেলা থেকে পাওয়া তথ্য, রোগীর সংখ্যা, সংক্রমণের মাত্রা – এসবের ওপর ভিত্তি করে ঝুঁকিপূর্ণ জেলা চিহ্নিত করে অধিদপ্তর।
করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে গত ২৯ মার্চ সরকার ১৮ দফা নতুন নির্দেশনা ঘোষণা করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, সব ধরণের সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় অনুষ্ঠানে জনসমাগম সীমিত করা।
বস্তুত ১৮ দফা জরুরি নির্দেশনার সবক’টিতে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে বারবার আহ্বান জানানো সত্ত্বেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়ে জনগণের উদাসীনতা লক্ষ করা গেছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, জনগণের অসতর্কতা ও উদাসীনতার কারণেই দেশে সংক্রমণ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। গত এক বছরে বিশ্বে করোনাভাইরাসের ২০ হাজারের বেশি মিউটেশন হয়েছে। বর্তমানে দেশে করোনাভাইরাসের ইউকে ভ্যারিয়েন্ট বেশি ছড়াচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে।
এটির মানুষ থেকে মানুষে ছড়িয়ে পড়ার ক্ষমতা অনেক বেশি, যা প্রায় ৭০ গুণ। এ অবস্থায় স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যাপারে উদাসীন হলে পরিস্থিতি যে আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে, তা বলাই বাহুল্য।
এক গবেষণায় দেখা গেছে, করোনার টিকার দুই ডোজ নেওয়ার অন্তত ১৪ দিন পর মানবদেহে প্রকৃত প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে ওঠে।
প্রতিদিনই লাফিয়ে বাড়ছে শনাক্ত ও মৃত্যু। রাজধানীর করোনা নির্ধারিত সব হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা মিলছে না। সাধারণ শয্যাও খালি নেই অনেক হাসপাতালে।
ফলে রোগীর স্বজনদের একটি শয্যার জন্য হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ছুটতে হচ্ছে। প্রয়োজনে রোগীকে অক্সিজেন দিতে না পারায় দুই-তিনদিনের মধ্যে তাদের অবস্থা খারাপ হচ্ছে। শ্বাসকষ্টসহ তাদের কাউকে বাড়িতে ফেরত নেওয়া হচ্ছে। সেখানে পরিবারের সদস্যদের সংক্রমিত করছেন তিনি। অনেকেই বাসায়, কেউ কেউ হাসপাতালেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন। এরপরও অধিকাংশ স্থানে মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মানছে না।
মুখে মাস্ক নেই, সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করছেন না, জনসমাগম দেখলে সেদিকেই ছুটছে উৎসুক জনতা। এসবের সঙ্গে কমছে টিকা নেওয়ার হার। টিকাদান কর্মসূচি শুরুর দিকে গড়ে এক লাখ বা তারও বেশি লোক টিকা নিলেও বর্তমানে সেটি ৬০ থেকে ৭০ হাজারে নেমে এসেছে।
এছাড়া সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ায় প্রতিদিন পরীক্ষার জন্য হাসপাতালে বাড়ছে ভিড়। সকাল থেকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়েও অনেকে পরীক্ষা করাতে পারছেন না।
এদিকে করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ার প্রেক্ষাপটে যুক্তরাজ্য বাদে পুরো ইউরোপ ও আরও ১২টি দেশ থেকে বাংলাদেশ প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।
আজ বৃহস্পতিবার(০১ এপ্রিল) এই ঘোষণা দেওয়া হয়। ৩ এপ্রিল থেকে এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর থাকবে আগামী ১৮ এপ্রিল পর্যন্ত।
বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এতথ্য জানানো হয়।
এতে বলা হয়, এয়ারলাইন্সগুলো তালিকাভুক্ত ১২টি দেশের ট্রানজিট প্যাসেঞ্জারদের বহন করতে পারবেন তবে সংশ্লিষ্ট যাত্রীদেরকে ট্রানজিটের সময় বিমানবন্দরেই থাকতে হবে।
অন্যান্য যাত্রীদের ক্ষেত্রে ৭২ ঘণ্টা আগে করা করোনা নেগেটিভ সার্টিফিকেট বাধ্যতামূলকভাবে প্রদর্শন করতে হবে এবং বাংলাদেশে আসার পর ১৪ দিন বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে।
কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ব্যাপকহারে বাড়ছে, তাই এই পরিস্থিতি সামলাতে ৩রা এপ্রিল থেকে সাময়িক সময়ের জন্য এই নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে।
ইউরোপ বাদে যে ১২টি দেশ থেকে বাংলাদেশে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে সেগুলো হলো- আর্জেন্টিনা, বাহরাইন, ব্রাজিল, চিলি, জর্ডান, কুয়েত, লেবানন, পেরু, কাতার, সাউথ আফ্রিকা, তুরস্ক ও উরুগেয়ে।
এদিকে যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের যেকোনো দেশ থেকে বাংলাদেশে আসা যাত্রীদের ১৪ দিনের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। সরকার নির্ধারিত প্রতিষ্ঠানে বা হোটেলে কোয়ারেন্টিনে থাকার খরচও তাদের বহন করতে হবে।
দেশে ও বর্হিবিশ্বে করোনা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি।
এসব দেশ থেকে আসা যাত্রীদের করোনাভাইরাসের টিকা নেওয়া থাকলেও বাধ্যতামূলকভাবে কোয়ারেন্টিনের এ নিয়ম প্রযোজ্য হবে।
সংস্থাটির এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, কোয়ারেন্টিন শেষে পিসিআর পরীক্ষার যেসব যাত্রীর করোনা নেগেটিভ রিপোর্ট আসবে তাদেরকে ছেড়ে দেওয়া হবে।
এতে আরও বলা হয়েছে, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় দেশগুলো ছাড়া অন্য যেকোনো দেশ থেকে বাংলাদেশে আসলে সেখানে স্বাস্থ্য পরীক্ষার পর করোনার কোনো উপসর্গ দেখা না গেলে কঠোরভাবে ১৪ দিনের হোম কোয়ারেন্টিনে থাকতে হবে। যদি কারো শরীরে করোনার উপসর্গ দেখা যায় তাহলে তাদেরকে নিজ খরচে সরকার অনুমোদিত হোটেল বা সরকারি স্থাপনায় বাধ্যতামূলকভাবে ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিনে থাকতে হবে।’
করোনার ভ্যাকসিন নেওয়ার পরও সব যাত্রীকে বাংলাদেশে আসার আগে করোনার পিসিআর পরীক্ষায় নেগেটিভ সার্টিফিকেট নিতে হবে এবং তা বিমানবন্দরে দেখাতে হবে।
ফ্লাইট ছাড়ার ৭২ ঘণ্টা আগে পিসিআর পরীক্ষা করাতে হবে বলেও ঘোষণায় উল্লেখ করা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা সংক্রমণ আমদানির ক্ষেত্রে কেবল সরকারের সতর্কতা বাড়ালেই হবে না, দেশের অভ্যন্তরে ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়াটাও নিয়ন্ত্রণে আনার সতর্কতা বাড়াতে হবে। দেশের পরিস্থিতি দেখলে এখনো মনে হবে না যে দেশে করোনা এতটা ভয়াবহ রুপ ধারণ করেছে। দেশের বিভিন্ন জায়গাতেই লঙ্ঘন হচ্ছে করোনা বিধি। দেশের অভ্যন্তরে করোনা সক্রমণ রোধে সরকারকে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে আগাতে হবে বলে মনে করেন তারা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩১১
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগীতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগীতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগীতার অনুরোধ জানাচ্ছি।
[wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ