চীনের শিনজিয়াং প্রদেশে উইঘুর সংখ্যালঘু মুসলিমদের ওপর চীনের ব্যাপক অত্যাচার নির্যাতন সইতে না পেরে অনেক পিতামাতাই দাদা-দাদির কাছে সন্তান রেখে পালিয়ে গেছেন। কোনো কোনো পিতামাতাকে চীন কর্তৃপক্ষ অন্যায়ভাবে আটক করে জেলে পুরে রেখেছে। আর পিতামাতাহীন শিশুদের জোর করে পাঠাচ্ছে সরকার নিয়ন্ত্রিত এতিমখানায়।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। আজ শুক্রবার (১৯ মার্চ) এ খবর প্রকাশ করেছে বিবিসি নিউজ।
প্রতিবেদন অনুসারে, এক মিলিয়নের বেশি সংখ্যালঘু উইঘুর সম্প্রদায়ের মানুষকে বন্দি করে রেখেছে চীন। যাদের মধ্যে অধিকাংশই মুসলমান। তাদের দিয়ে সেখানে জোরপূর্বক শ্রম খাটানো, নারীদের ওপর যৌন নির্যাতন ও ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটছে।
বিবিসি জানিয়েছে, অঞ্চলটি থেকে পালিয়ে বিদেশে আশ্রয় নেয়া কয়েকজন নির্যাতিত মানুষের বরাত দিয়ে রিপোর্টটি করা হয়েছে। হুমকির মুখে ওই নারীরা তাদের সন্তানদের নিজ দেশে দাদা-দাদির কাছে রেখে এসেছে। কিন্তু ওই শিশুগুলোকে জোর করে ধরে নিয়ে এতিমখানায় পাঠাচ্ছে চীনা কর্তৃপক্ষ।
অ্যামনেস্টি জানিয়েছে, মিহরিবান কাদের এবং আবলিকিম মেমতিনিন নামের দুই উইঘুর নারী পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয়ে ২০১৬ সালে ইতালিতে পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করেন। তাদের চার সন্তানকে দাদা-দাদির কাছে রেখে যান। কিন্তু দাদিকে ক্যাম্পে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় এবং দাদাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। এমতাবস্থায় অন্য আত্বীয়রা সন্তানদের দেখভালোর দায়িত্ব নেয়নি।
২০১৯ সালের নভেম্বরে এই দুই নারী ইতালিতে বৈধভাবে থাকার অনুমতি পান। একইসঙ্গে সন্তানদেরও দেশটিতে নিয়ে আসার জন্য বলে কর্তৃপক্ষ। কিন্তু শিশুদের আটকে রেখেছে চীনা পুলিশ এবং সরকার নিয়ন্ত্রিত এতিমখানায় পাঠিয়ে দিয়েছে।
মিহরিবান কাদের বলেন, বর্তমানে আমার সন্তানরা চীন সরকারের হাতে বন্দি। জীবিতকালে তাদের আর দেখতে পাবো কিনা তা নিয়ে আমি সন্দিহান।
আরেক দম্পতি ওমর ও মেরিয়েম ফারুহ জানিয়েছেন, ২০১৬ সালে দুই সন্তানকে রেখে তুরস্ক পাড়ি জমান। কয়েক দিন পর তাদেরকেও এতিমখানায় নিয়ে যাওয়া হয়।
পরিবারের সম্মতি ছাড়াই এতিমখানায় আটকে রাখা সব উইঘুর শিশুকে মুক্তি দেওয়ার জন্য চীনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।
এদিকে সম্প্রতি চীনে উচ্চপর্যায়ের একটি জরিপ বিবিসি দেখতে পেয়েছে। এতে এ তথ্য পাওয়া গেছে যে, শিনজিয়াং প্রদেশের হাজার হাজার উইঘুর এবং আরো নানা জাতিগত সংখ্যালঘুদের তাদের বাড়ি থেকে অনেক দূরে কাজের জন্য পাঠিয়ে দিচ্ছে চীনা কর্তৃপক্ষ। আর তাদের আদি আবাসভূমিতে এর ফলে তাদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে।
চীনা সরকার বলছে, গ্রামীণ এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা বেকারত্ব এবং দারিদ্র দূর করার লক্ষ্যে মানুষের আয় বাড়াতেই এসব চাকরি ও বদলির পরিকল্পনা করা হয়েছে। কিন্তু বিবিসির পাওয়া সাক্ষ্যপ্রমাণে আভাস পাওয়া যায়, এই নীতিতে জোর খাটানোর উচ্চ ঝুঁকি রয়েছে এবং গত কয়েকবছরে শিনজিয়াং প্রদেশজুড়ে যেসব পুনঃশিক্ষণ শিবির গড়ে তোলা হয়েছে— তার পাশাপাশিই এসব চাকরিগুলোর পরিকল্পনা করা হয়েছে সংখ্যালঘুদের জীবনধারা ও চিন্তাভাবনায় পরিবর্তন আনার জন্য।
এই জরিপটি আসলে শুধু চীনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদেরই দেখার কথা। কিন্তু দুর্ঘটনাবশত তা অনলাইনে এসে যায়। চীনের প্রপাগাণ্ডা রিপোর্ট, সাক্ষাৎকার এবং বিভিন্ন কারখানা পরিদর্শনের ওপর ভিত্তি করে বিবিসি যে অনুসন্ধান চালাচ্ছে তার একটি অংশ হচ্ছে এই জরিপটি। উইঘুর শ্রমিকদের বদলির সাথে দুটি বড় পশ্চিমা ব্র্যান্ডের সংযোগ নিয়ে বিবিসি প্রশ্ন তুলেছে। কারণ এ ব্যাপারটা এরই মধ্যেই বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থার সাথে এমনভাবে জড়িয়ে গেছে যে তা নিয়ে আন্তর্জাতিক উদ্বেগ বাড়ছে।
মানবাধিকার ও সমকালীন দাসত্ব বিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞ হচ্ছেন শেফিল্ড হাল্যাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক লরা মার্ফি। তিনি ২০০৪ থেকে শুরু করে বহুবার শিনজিয়াং গেছেন এবং কিছু দিন থেকেছেন। বিবিসিকে তিনি বলছেন, ভিডিওটা সত্যি চমকপ্রদ। চীনা সরকার সবসময়ই বলছে যে লোকেরা স্বেচ্ছায় এসব কর্মসূচিতে যোগ দিচ্ছে। কিন্তু এই ভিডিওতে স্পষ্টভাবে বেরিয়ে এসেছে যে এটা এমন এক পদ্ধতি যেখানে জোর খাটানো হচ্ছে এবং কাউকে এতে বাধা দিতে দেয়া হচ্ছে না।’
অধ্যাপক লরা মার্ফি আরো বলেন, এই ভিডিওতে অন্য যে ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তা হলো অসাধু উদ্দেশ্য । যদিও একে বলা হচ্ছে মানুষের দারিদ্র্য মোচনের কথা, কিন্তু এখানে লোকের জীবনকে বদলে দেওয়া হচ্ছে, পরিবারগুলোকে বিচ্ছিন্ন করা হচ্ছে, জনগোষ্ঠীকে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে নানা জায়গায়, বদলে দেওয়া হচ্ছে তাদের ভাষা, পরিবারকাঠামো— যা আসলে দারিদ্র কমানোর চাইতে তা বরং বাড়িয়ে দিতে পারে।
চীনে প্রায় দেড় কোটি উইঘুর মুসলমানের বাস। শিনজিয়াং প্রদেশের জনসংখ্যার ৪৫ শতাংশই উইঘুর মুসলিম। এই প্রদেশটি তিব্বতের মতো স্বশাসিত একটি অঞ্চল। বিদেশি মিডিয়ার সেখানে প্রবেশের ব্যাপারে কঠোর বিধিনিষেধ রয়েছে। কিন্তু গত বেশ কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন সূত্রে খবর আসছে, সেখানে বসবাসরত উইঘুরসহ ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের ওপর ব্যাপক নিপীড়ন চালাচ্ছে বেইজিং। চীন বরাবরই এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে।
অ্যাক্টিভিস্ট ও জাতিসংঘ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অন্তত দশ লাখ মুসলিমকে শিনজিয়াংয়ের বন্দি শিবিরে আটক রাখা হয়েছে। তারা চীনের বিরুদ্ধে নিপীড়ন, বাধ্যতামূলক শ্রম ও মগজধোলাই করার অভিযোগ এনেছেন। চীন শিনজিয়াংয়ে যে কোনও ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। দেশটির দাবি, শিবিরে কারিগরি প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে এবং কট্টরপন্থার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য এটি প্রয়োজনীয়।
এসডব্লিউ/কেএইচ/২২০৭
আপনার মতামত জানানঃ