গ্রেপ্তারি পরোয়ানায় লেখা জামাল হোসেন। এতে ওভাররাইটিং করে কামাল হোসেন লেখা হয়। এরপর নারায়ণগঞ্জ সদর থানা পুলিশের একটি টিম সৈয়দপুর পশ্চিম এলাকার মৃত সুরুজ মিয়ার ছেলে ও সৈয়দপুর বঙ্গবন্ধু উচ্চ বিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটির সদস্য কামাল হোসেনকে গ্রেপ্তার করে। বুধবার (৩ মার্চ) সংবাদ সম্মেলনে এমন অভিযোগ করে ভুক্তভোগী। তিনি বলেন, গাঁজা উদ্ধারের যে ঘটনায় আমাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে সে ঘটনার সময়ে আমি দক্ষিণ কোরিয়া ছিলাম।
২০১৯ সালের ২০ নভেম্বর মাদক আইনে দুই ব্যক্তিকে দুই বছর করে কারাদণ্ড দেন কুমিল্লার একটি আদালত। তারা হলেন- কুমিল্লার দাউদকান্দির আলমগীর হোসেন ও নারায়ণগঞ্জের চর সৈয়দপুরের জামাল হোসেন। রায় ঘোষণার সময় জামাল হোসেন পলাতক থাকায় তাকে গ্রেপ্তারের জন্য কুমিল্লার পুলিশ সুপারের কার্যালয় থেকে নারায়ণগঞ্জ পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে গ্রেপ্তারি পরোয়ানার কাগজ পাঠানো হয়।
পুলিশ সুপারের কার্যালয় থেকে সেই কাগজ যায় নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায়। কিন্তু থানা থেকে ‘জামাল’ এর নাম ঘষামাজা করে ‘কামাল’ লিখে গত ১৭ ফেব্রুয়ারি তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর কামাল হোসেনকে সাজা ভোগের জন্য কুমিল্লা পাঠানো হলে বেরিয়ে আসে আসল রহস্য। সেখানে গিয়ে জানা যায়, সাজাপ্রাপ্ত প্রকৃত ব্যক্তির নাম জামাল হোসেন। তবে জামাল ও নিরপরাধ কামাল উভয়ের বাবার নাম সুরুজ মিয়া। আর ২০০৯ সালের ২১ এপ্রিল ঘটনার সময় কামাল হোসেন দক্ষিণ কোরিয়ায় ছিলেন। নয় দিন কারাভোগের পর কামাল হোসেন কুমিল্লার যুগ্ম জেলা জজ দ্বিতীয় আদালত থেকে জামিন পান।
এর আগে কামাল হোসেনকে গ্রেপ্তারের পর তাকে নারায়ণগঞ্জের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মাহামুদুল মোহসীনের আদালতে সোপর্দ করা হয়। ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ কপিতে উল্লেখ রয়েছে, ‘রাষ্ট্র বনাম জামাল হোসেন গং’। কিন্তু একই আদেশের নিচের অংশে আসামি হিসেবে কামাল হোসেনের নাম লেখা রয়েছে।
গতকাল নারায়ণগঞ্জ প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে ভুক্তভোগী কামাল হোসেন জানান, ১৯৯৬ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত তিনি দক্ষিণ কোরিয়ায় ছিলেন। ফের ২০০৯ সালে তিনি দক্ষিণ কোরিয়া যান ফিরেন ২০১৩ সালের ৭ নভেম্বর। দেশে ফিরে এলাকায় জমির ব্যবসা করেন সেই সঙ্গে সমাজ সেবামূলক কাজে জড়িত রয়েছেন।
ভুক্তভোগী কামাল হোসেন আরও জানান, আমরা বিষয়টি জানিয়ে পুলিশ সুপারের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছি। গ্রেফতারের সময় সদর মডেল থানা পুলিশ তার কাছে শুধু তার নাম ও তার বাবার নাম জানতে চেয়েছে। গ্রেফতারি পরোয়ানার কোনও কাগজ দেখায়নি। একটি অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ফোনে শুধু একটি গ্রেফতারি পরোয়ানার ছবি দেখিয়েছিল।
এ বিষয়ে পুলিশ সুপার জায়েদুল আলম জানান, আমি এখনও আদালতে কোনও আদেশ পাইনি। পেলে তা তদন্ত করে ব্যবস্থা নিবো।
এর আগে মাদক মামলায় বিনা দোষে ১০ বছরের সাজাপ্রাপ্ত শাহাবুদ্দিন বিহারীর পরিবর্তে আসামি হিসেবে প্রায় ৫ বছর ধরে কারাগারে ছিলেন রাজধানীর পল্লবীর বেনারসী কারিগর মো. আরমান বিহারী। শুধু আসামির বাবার নামের সঙ্গে আরমানের বাবার নামের মিল থাকায় আরমানকে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ।
আদালত জানায়, শুধু বাবার নামের সঙ্গে মিল থাকায় ২০১৬ সালে ২৭ জানুয়ারি পল্লবী থানা পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে যায়। পরে পরিবারের সদস্যদের আবেদন ও শুনানির ভিত্তিতে গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর হাইকোর্ট বিভাগের একটি বেঞ্চ তাকে জেল থেকে মুক্তি দেয়ার আদেশ দেন। ২১ জানুয়ারি,২০২১ গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারের পার্ট-২ থেকে হাইকোর্টের এক আদেশে তাকে মুক্তি দেয়া হয়।
বিস্ফোরক আইনে ২০০৫ সালে রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানায় এক মামলা দায়ের হয়। ওই মামলায় সাতজনকে ককটেল ও দেশীয় অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। তাদের সহযোগীদের ধরতে আসামিদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ডিবির উপ-পরিদর্শক (এসআই) নূরে আলম সিদ্দিকী পল্লবীর বিহারী ক্যাম্পে অভিযান চালায়।
সেখানে ৪০ বোতল ফেনসিডিলসহ শাহাবুদ্দিন বিহারি ও তার দুই সহযোগী আটক করা হয়। এ ঘটনায় পল্লবী থানায় মাদক দ্রব্য আইনে মামলা দায়ের করা হয়। শাহাবুদ্দিনসহ গ্রেপ্তার তিন জনের বিরুদ্ধে ২০০৫ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় পুলিশ। ২০০৭ সালের ৫ মার্চ জামিনে মুক্ত হয় শাহাবুদ্দিন। পরে ২০১১ সালের ১৭ জানুয়ারি আদালতে আত্মসমর্পণ করে আবার আবেদন করে শাহাবুদ্দিন জামিন নেয়। এরপরই শাহাবুদ্দিন ফেরারী হয়। এদিকে তার দুই সহযোগী কারাগারে থেকে যান ।
ওই মামলায় ২০১২ সালের ১ অক্টোবর শাহাবুদ্দিন ও তার দুই সহযোগীর ১০ বছরের জেল ও ৫ হাজার টাকা জরিমানা রায় দেন ঢাকার অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক ফারুক আহম্মদ। এরপর পলাতক শাহাবুদ্দিনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়। ২০১৬ সালের ২৭ জানুয়ারি সকাল সাড়ে ৯টার দিকে পল্লবীর ব্লক-এ, ১০ নম্বর সেকশন এলাকায় অভিযান চালায় পল্লবী থানা পুলিশ। এ অভিযানে পল্লবী থানার তৎকালীন উপ-পরিদর্শক (এসআই) রাসেল একটি চায়ের দোকান থেকে মূল আসামি শাহাবুদ্দিনের বাবার নামের সাথে মিল থাকায় আরমানকে গ্রেপ্তার করেন । এরপর থেকে আরমানকে কাশিমপুর কারাগার-২ এ রাখা হয় ।
আইনজীবি হুমায়ূন কবিরের পল্লবীর এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ৩১ ডিসেম্বর, ২০২০ বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি মহি উদ্দিন শামীমের হাইকোর্ট বেঞ্চ আরমানকে মুক্তি দেয়াসহ তাকে ২০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে পুলিশ মহাপরিদর্শকের প্রতি নির্দেশ দেন।
২০২০ সালে ৩০০ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে বলে জানিয়েছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। যারা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ এবং মাদকবিরোধী অভিযানে, এ ছাড়া বছরজুড়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে নিহত হয়েছে । এতো গেলো দোষীদের কথা। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর বন্দুকের ডগায় অসংখ্য নির্দোষ ব্যক্তি প্রাণ হারিয়েছেন যারা কখনোই তালিকায় আসবে না। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, ঢাকা এবং এর বাইরে যত কারাগার আছে খোঁজ করে দেখলে এমন অসংখ্য কামাল, আরমান জাহালমের সন্ধান পাওয়া যাবে যারা পুলিশের ভুলে, গাফিলতিতে অথবা অর্থের বিনিময়ে বিনাদোষে শাস্তি ভোগ করছেন।
এসডব্লিউ/এমএন/ এফএ/১৬০০
আপনার মতামত জানানঃ