বাংলাদেশে পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড় জমছে। গত কয়েক বছরে শতাধিক পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে খুন, ধর্ষণ, অপহরণ, ছিনতাই, ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায়, মিথ্যা মামলায় সাধারণ মানুষকে ফাঁসিয়ে দেওয়াসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে। এবার দুবাই প্রবাসীকে বিমানবন্দরে যাওয়ার পথে আটকে সর্বস্ব লুটে নেওয়ার অভিযোগে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) বরখাস্তকৃত এসআই মো. আকসাদুজ্জামানকে আটক করেছে ঢাকা মহানগর ডিবি পুলিশ। আজ বৃহস্পতিবার তাকে আদালতে হাজির করার কথা রয়েছে।
বুধবার সকালে ডিবি পুলিশের একটি দল গোপন খবরের ভিত্তিতে রংপুরের মিঠাপুকুর থানার শঠিবাড়ি এলাকায় অভিযান চালিয়ে সিআইডির ওই এসআই আকসাদুজ্জামানকে গ্রেপ্তার করে। তিনি ভারতে পালিয়ে যাচ্ছিলেন। এ নিয়ে ওই ডাকাতির ঘটনায় ৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হলো।
ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মলনে অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার হাফিজ আকতার বলেন, ‘গত ১৯ অক্টোবর অপহরণের পর ডাকাতির ঘটনায় বিমানবন্দর থানায় একটি মামলা হয়। সেই মামলায় ৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়’।
তাদের মধ্যে হাসান রাজা, গাড়ি চালক হারুণ অর রশিদ ওরফে সজীব, অটোরিকশা চালক জোনাব আলী এবং কায়ছার মাহমুদ ওরফে জাকির হোসেন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। সেই জবানবন্দি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সিআইডির এসআই আকসাদুজ্জামানের নেতৃত্বে এই ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আকসাদুজ্জামান জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে’।
ডিবির দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জাতীয় এক দৈনিককে বলেন, বিমানবন্দর থানার একটি ডাকাতির মামলায় সিআইডির ওই কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ডিবি পরিচয়ে ডাকাতি-ছিনতাইকারী চক্রের হোতা ছিলেন তিনি। এর আগে গ্রেপ্তার এক আসামি আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে তার নাম বলেছেন। এ ছাড়া সিআইডির এক গাড়িচালকও সাক্ষী হিসেবে ছিনতাই-ডাকাতিতে তার সম্পৃক্ততার বিবরণ দিয়েছেন।
সূত্র জানায়, গত বছরের ১৯ আগস্ট মাদারীপুরের বাসিন্দা রোমান নামে এক ব্যক্তি ভোরে দুবাই যাওয়ার উদ্দেশে ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যাচ্ছিলেন। টিকাটুলী থেকে অটোরিকশায় বিমানবন্দর যাওয়ার পথে তাকে অনুসরণ করে একটি হায়েস গাড়ি ও তিনটি মোটরসাইকেল। তারা বিমানবন্দরের আগে কাওলা এলাকায় গিয়ে অটোরিকশাটিকে আটকায়। তার পর রোমানকে মারধর করে লাগেজসহ গাড়িতে তুলে নেয়।
পরে তাকে গাড়িতে তুলে হাতে হাতকড়া পরানো হয়। বাঁধা হয় চোখ ও হাত-পা। রোমানের লাগেজে থাকা পাঁচ হাজার ইউএস ডলার ও দুই হাজার দিরহাম ও ২০ হাজার টাকা লুটে নিয়ে ডেমরা স্টাফ কোয়ার্টার এলাকায় তাকে নামিয়ে দেওয়া হয়। এ ঘটনায় পরদিন ২০ আগস্ট বিমানবন্দর থানায় রোমান মামলা করেন। মামলাটি থানা পুলিশের পাশাপাশি ছায়া তদন্ত শুরু করে ডিবির বিমানবন্দর জোনাল টিম। সড়কে থাকা সিসিটিভি ফুটেজ ও তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে গোয়েন্দা পুলিশ জানতে পারে এ চক্রটির সঙ্গে সিআইডির একজন এসআই জড়িত।
আকসাদুজ্জামান নামে ওই এসআই সিআইডির অফিসিয়াল গাড়ি (ঢাকা মেট্রো ১৯-২২৩৭) নিয়ে ডাকাতিতে নেতৃত্ব দেন। পরে একে একে গ্রেপ্তার করা হয় সিন্ডিকেটের ছয় সদস্য। তাদের মধ্যে হাসান রাজা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। তিনি জবানবন্দিতে সিআইডির এসআইর নেতৃত্বে ডাকাতি করার পুরো বিষয় তুলে ধরেন। এ ছাড়া মাইক্রোবাসের চালক হারুনুর রশীদ সজীবও আদালতে সাক্ষী হিসেবে ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন। তিনিও চক্রের হোতা হিসেবে এসআই আকসাদুজ্জামানের কথা বলেন।
ডিবি বলছে, পেশাদার ডাকাত দলের সদস্যদের নিয়ে অপরাধী চক্র গড়ে তুলে মাঝে মধ্যেই প্রবাসীদের টার্গেট করে সর্বস্ব লুটে নিতেন এসআই আকসাদ। সোর্সের মাধ্যমে তিনি প্রবাসী টার্গেট ঠিক করতেন।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি সূত্র বলছে, আকসাদকে তার সোর্স এক ব্যক্তি ১০ লাখ টাকা নিয়ে বিদেশ যাওয়ার তথ্য জানান। প্রতি উত্তরে এসআই আকসাদ ১০ লাখ রিয়াল নাকি ডলার তা জানতে চান। সোর্স টাকা বলায় তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে এত ছোট টাকার কাজ করবেন না বলে জানিয়ে দেন। ডিবির তদন্ত সংশ্লিষ্টরা পুরো বিষয়টি জানার পরও আকসাদকে এ মামলায় গ্রেপ্তার দেখায়নি। তবে বিষয়টি জানিয়ে সিআইডিতে একটি চিঠি পাঠিয়ে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা।
পেশাদার ডাকাত দলের সদস্যদের নিয়ে অপরাধী চক্র গড়ে তুলে মাঝে মধ্যেই প্রবাসীদের টার্গেট করে সর্বস্ব লুটে নিতেন এসআই আকসাদ। সোর্সের মাধ্যমে তিনি প্রবাসী টার্গেট ঠিক করতেন।
সম্প্রতি একটি ফোনালাপের অডিও ছড়িয়ে পড়ার পর এ ঘটনায় সিআইডির সঙ্গে গোয়েন্দা পুলিশের কর্মকর্তাদের জড়িয়ে পড়ার বিষয়টি সামনে আসে। ওই অডিওতে এক নারী ও এক পুরুষের কথোপকথনে কোটি টাকার বেশি লেনদেনের কথা এসেছে।
ওই অডিও ক্লিপে ডিবির এক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ১ কোটি ৪২ লাখ টাকা ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ করেছেন এসআই আকসাদুজ্জামানের স্ত্রী তাহমিনা আক্তার। আর অভিযুক্ত কর্মকর্তা হলেন ডিবির অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার কায়সার রিজভী কোরায়শী। অডিওতে তাহমিনা আক্তার ডিবি কর্মকর্তা কোরায়শীকে এক কোটি ২৮ লাখ টাকার পাশাপাশি তাকে আরও ব্যক্তিগতভাবে ১৪ লাখ টাকা দেওয়ার কথা বলেন। এডিসি কায়সার রিজভী কোরায়শীকে পুরো টাকা স্যারদের কাছে দেওয়া হয়েছে জানিয়ে এখান থেকে কিছু ফেরত নেওয়ার ব্যবস্থার কথা বলেন। একই সঙ্গে তিনি বারবার সাক্ষাতে কথা ও অফিসে দেখা করতে বলেন।
আলোচনায় আসা অডিও ক্লিপে এক কোটি ৪২ লাখ টাকা কেন ডিবির কর্মকর্তাকে দেওয়ার অভিযোগ করছেন এসআই আকসাদের স্ত্রী? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে জানা গেছে, প্রবাসীর সর্বস্ব লুটের ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া আসামিদের ছাড় দেওয়ার জন্য এ টাকা জোগাড় করা হয়েছিল। সিআইডির এসআইর ঘনিষ্ঠ একজন জানান, মামলা থেকে ছাড়া পেতে আসামিরা সবাই এ টাকা দিয়েছিল। এর মধ্যে মোশারফ ৩৩ লাখ, সেলিমও প্রায় সমপরিমাণ, আমির হোসেন ১৩-১৪ লাখ, রিজু মিয়া ৬-৭ লাখ, মাওলা ৫ লাখ, রিপন ৩-৪ লাখ টাকা দেন। গত বছরের ২৬ ও ২৭ নভেম্বর খিলগাঁও এলাকায় আকসাদের বাসায় এ টাকা হস্তান্তর করা হয়েছে।
বিভাগীয় মামলার তদন্ত শেষে সম্প্রতি এসআই আকসাদকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। এ কারণে তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে ঘুষ দেওয়ার বিষয়টি ফাঁস করে দেন। পুরো বিষয়টি তিনি ডিএমপি কমিশনার, পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকেও জানিয়েছেন।
এদিকে অডিও ক্লিপে ডিবি কর্মকর্তার ঘুষ গ্রহণের বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়া অভিযুক্ত এসআই আকসাদ এমন ফৌজদারি অপরাধে জড়িত থাকার পরও এত দিন কেন তাকে গ্রেপ্তার করা হয়নি সে বিষয়টি নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
এদিকে ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ অস্বীকার করে এডিসি কোরায়শি বলেছেন, লুটের মামলা থেকে বাঁচতে এই ‘সাজানো অডিও টেপ তৈরি করেছেন’ সিআইডি কর্মকর্তা আকসাদুর।
তবে সিআইডির উপপরিদর্শক আকসাদুজ্জামানের দাবি, ‘এটা তার স্ত্রীর সঙ্গে মামলার তদন্ত দেখভালকারী ডিবি কর্মকর্তা কায়সার রিজভী কোরায়শির কথোপকথন’।
বৃহস্পতিবার ডিবির সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে হাফিজ আকতার বলেন, ‘একটি অডিও ফাঁস হয়েছে। সেখানে বড় অংকের টাকা লেনদেনের কথা বলা হয়েছে। মামলার তদন্তের পাশাপাশি সেই টাকা কোথা থেকে এল, আমাদের কোনো কর্মকর্তা জড়িত আছে কিনা— সব বিষয় আমরা খতিয়ে দেখব’।
সাম্প্রতিক সময়ে পুলিশের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি ফৌজদারি অপরাধে জড়িত থাকার দায়ে মামলা হয়েছে এবং বিচার চলছে। অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় পুলিশের অপরাধ কাজে অধিক হারে জড়িয়ে পড়ার জন্য দীর্ঘদিনের ঘুণে ধরা সিস্টেমকে দায়ী করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলেন, ঔপনিবেশিক আমলের কাঠামো থেকে পুলিশ বাহিনী এখনো বের হতে পারেনি। আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তৈরি করা যায়নি তাদের কাঠামো। ১৮৬১ সালের আইন দিয়ে পুলিশ পরিচালিত হচ্ছে। এত দিনেও কাঠামোগত সংস্কার করা যায়নি। বিচ্ছিন্নভাবে না দেখে মূল সমস্যা খতিয়ে দেখতে হবে। আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে আমাদের। ব্যক্তিবিশেষকে দোষারোপ করে লাভ নেই। পুরো সিস্টেমটা নিয়ে ভাবতে হবে। বিশেষ করে বিচার ব্যবস্থার বিভিন্ন ঘাট, প্রসিকিউসন, তদন্ত ব্যবস্থা আছে।
তারা বলেন, বিসিএস দিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু ভালো অফিসার ও কাজ দেখালে হবে না, জবাববদিহিতা স্বচ্ছতা জরুরি। মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের কর্ম পরিবেশ নিয়েও ভাবতে হবে। স্থানীয় এমপি, অর্থশালীদের সঙ্গে ওসিদের একটা আঁতাতের সম্পর্ক থাকে। তারা একজন আরেকজনকে প্রটেকশন দেয়। আর সাধারণ মানুষ বঞ্চিত হয়। ওসি, এসআই লেভেলে সংস্কার জরুরি বলে মনে করেন তারা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬১৭
আপনার মতামত জানানঃ