শীত কমার সঙ্গে সঙ্গে রাজধানীসহ সারাদেশে বাড়ছে মশার উপদ্রব। কর্তৃপক্ষের মশক নিধন কর্মসূচি থাকা সত্ত্বেও রাজধানীতে কিউলেক্স মশার উপদ্রব অতি মাত্রায় বেড়েছে। দিন-রাত মশার কামড়ে অতিষ্ঠ নগরবাসী। জনমনে এডিস মশার আতঙ্ক কাজ করছে, এ জন্য যে কোনো মশার বৃদ্ধিতেই মানুষের আতঙ্ক বেড়ে যায়। বছরের অন্য যে কোনও সময়ের চেয়ে ঢাকায় কিউল্যাক্স মশা বেড়েছে প্রায় চারগুণ। আগে যেখানে প্রতি ডিপ-এ (মশার ঘনত্ব বের করার পরিমাপক) মশার ঘনত্ব ছিল ১০ থেকে ১৫টি, সেখানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫০টির মতো। ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় জরিপ চালিয়ে এ তথ্য জানিয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা।
মশা বৃদ্ধির কারণ হিসেবে সিটি করপোরেশনের অবহেলা ও অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসকেই দায়ী করছেন কীটতত্ববিদরা। তারা বলছেন, বছরজুড়ে যেখানে মশা নিধন পরিচালনা করার কথা সেখানে ডেঙ্গু কমতে থাকার পর দুই সিটি করপোরেশনে কোনও কাজই হয়নি। মশার ওষুধ নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করছেন খোদ কাউন্সিলররাই।
এদিকে সিটি করপোরেশন মশক নিয়ন্ত্রণে নানা কার্যক্রম চালানোর কথা থাকলেও নগরবাসীর অভিযোগ, তেমন কোনো কার্যক্রম চালাচ্ছে না তারা। সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে মশার উত্পাতে থাকা যাচ্ছে না। ঢাকা দক্ষিন সিটি করপোরেশনের ৪৭ নম্বর ওয়ার্ডের রাব্বি আহমেদ রানা জানান, সন্ধ্যা হলেই মশার জন্য বাইরে বের হওয়া মুশকিল হয়ে যায়। অন্যদিকে উত্তর সিটি করপোরেশনের ৫৩ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা অনিক বলেন, বিমানবন্দর এলাকায় দেখা যায়, বিকাল হলেই মশা হাত দিয়ে সরিয়ে রাস্তায় হাঁটতে হচ্ছে। এমন মারাত্মক অবস্থা আগে কখনো দেখিনি।
অভিজাত এলাকার বাসিন্দারাও মশার উপদ্রবে অতিষ্ঠ। বছরের ডিসেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত কিউলেক্স মশার প্রজনন মৌসুম। এ বিষয়ে প্রতি বছরের এ সময় প্রায় একই চিত্র লক্ষ করা যায়। এ মশার প্রজননস্থলগুলো সঠিকভাবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে এসব মশার উপদ্রব কমিয়ে আনা সম্ভব।
সম্প্রতি মশা বেড়ে যাওয়ায় সিটি করপোরেশনের কার্যক্রমের ওপর সন্দেহ বাড়ছে নাগরিকদের। তাদের দাবি, যে ওষুধ ছিটানো হচ্ছে তা কোনও কাজ করে না। মশার ওষুধের কার্যকারিতা নিয়ে কাউন্সিলররাও নগর ভবনকে জানিয়েছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সিটি করপোরেশনের কমকর্তা বলেন, আমরা সকাল-বিকাল মশা নিধনে কর্মীদের নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। কিন্তু আশানুরূপ ফল পাচ্ছি না। উল্টো জনগণ ওষুধ ছিটাতে যাওয়া কর্মীদের নিয়ে তাচ্ছিল্যের স্বরে করে কথা বলে। বাসিন্দারা বলে- ওষুধের মধ্যেই মশা ডিম পারে। ওষুধ ছিটায়ে লাভ নেই। চরম বিপাকে আছি আমরা। কিন্তু কোনোভাবেই বুঝতে পারছি না, সমস্যা ওষুধে নাকি মশায়।
এদিকে মশার ওষুধের কার্যকরিতা প্রসঙ্গে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) বলছে, তাদের ওষুধ যথেষ্ট কার্যকর। আর কিছুদিন অপেক্ষা করলেই মশার লাগামহীন উপদ্রব নিয়ন্ত্রণে আসবে। এ বিষয়ে ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সেলিম রেজা বলেন, নগরবাসীর অভিযোগকে আমরা অস্বীকার করছি না। কিন্তু আমরা যে হাত গুটিয়ে বসে আছি তাও কিন্তু নয়। নগরবাসী হয়তো লক্ষ্য করছে, আমাদের নিয়মিত কার্যক্রমের কারণে কিন্তু গত বছর ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা দিলেও তা মাথাচাড়া দিতে পারেনি। ঠিক আমরা এবারও সফল হব।’
তিনি বলেন, আমাদের যে চতুর্থ প্রজন্মের লার্ভিসাইড কীটনাশক ওষুধ রয়েছে সেটির প্রয়োগও অব্যাহত রয়েছে। এই ওষুধটি যথেষ্ট কার্যকরী। পাশাপাশি সম্প্রতি ওয়াসা কাছ থেকে যেসব খালের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব আমরা পেয়েছি সেগুলো যদি সচল করা যায় তখন মশার এমন উপদ্রব থাকবে না।’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার গণমাধ্যমকে বলেন, শুরু থেকেই ওয়ার্ডগুলোতে জনপ্রতিনিধি ও নাগরিকদের সম্পৃক্ত করে ক্র্যাশ প্রোগাম চালানোর দরকার ছিল। বছরজুড়ে দুই সংস্থার এই কাজে অবহেলা ছিল। মশা নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে প্রতি সাত দিন অন্তর ড্রেন, ডোবা ও নোংরা এলাকা পরিষ্কার করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, আমরা ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় জরিপ করে দেখেছি, বছরের অন্য যে কোনও সময়ের তুলনায় এখন মশার ঘনত্ব তিন থেকে চারগুণ বেড়েছে। মশার প্রজননস্থলগুলো পরিষ্কার করে এ উপদ্রব কমিয়ে আনা সম্ভব। জরুরি পদক্ষেপ না নিলে মার্চের পর থেকে আরও বাড়তে থাকবে।
চলতি বছরের ১ জানুয়ারি ৬ লাখ ৪০ হাজার লিটার অ্যাডাল্টিসাইডিং ওষুধের জন্য টেন্ডার আহ্বান করে ডিএসসিসি। তাতে প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয় ১২ কোটি ৪১ লাখ ৬০ হাজার টাকা। কিন্তু প্রতিটি কোম্পানি ‘অতিরিক্ত’ দর দেওয়ায় তা বারবার রি-টেন্ডার করে ডিএসসিসি। প্রায় চার দফায় টেন্ডার দিয়ে গতবছরের অক্টোবরের দিকে ওষুধ ফরমুলেশনের কাজ করতে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান চূড়ান্ত করে সংস্থাটি। এই দীর্ঘ সময় সংস্থার কাছে ওষুধই ছিল না। অলস সময় কাটিয়েছিল মশককর্মীরা।
মশক নিধনে যেখানে প্রতিটি ওয়ার্ডে কমপক্ষে ৪০ জন কর্মী রাখার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের, সেখানে ১৩-১৮ কর্মী রয়েছে সিটি করপোরেশনে। এদের মধ্য থেকে আবার ১০-১২ জনকে রেখে বাকিদের সচিব দফতরে বদলি করা হয়েছে। ডেঙ্গুর এই মৌসুমে কর্মী কমানোকে চরম অবহেলা হিসেবে দেখছেন কীটতত্ত্ববিদ ও নাগরিকরা।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মশক নিধনে রাজধানীর অভিজাত এলাকাগুলোতে যে রকম তৎপরতা লক্ষ করা যাচ্ছে, অন্য এলাকায়, বিশেষ করে সিটি করপোরেশনের নতুন অন্তর্ভুক্ত এলাকাগুলোতে তেমন তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না। মশার ওষুধ ছিটানোর ব্যাপারে সব এলাকায় সমান দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন। যেহেতু মশা নানা রোগের ভাইরাস ছড়ায়, সেহেতু মশার কামড় থেকে সুরক্ষাই সেসব রোগ থেকে দূরে থাকার সবচেয়ে ভালো উপায়। এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষ আরও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেবে এটাই প্রত্যাশা।
এসডব্লিউ/এমএন/ এফএ/১৩২৫
আপনার মতামত জানানঃ