চলতি বছরের শুরুতে বিভিন্ন ব্যাংকের পরিচালক ও শীর্ষ কর্মকর্তাদের অনিয়ম-দুর্নীতির তথ্য নিয়ে আলোচনার মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক সব ব্যাংকের পরিচালক, ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এবং তার নিচের দুই পদের কর্মকর্তাদের কোথায় কোন ব্যবসা ও আয়ের উৎস আছে, তার তথ্য প্রতিবছর নিজ নিজ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের কাছে জমা দিতে নির্দেশ দেয়। তারা যদি পারিবারিক সূত্রে সম্পদ বা ব্যবসায়ের অংশীদার হন, সে তথ্যও জমা দিতে বলা হয়।তার পরপরই ওই একইদিনে একই কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের তথ্য চেয়ে আদেশ করে হাইকোর্ট। এনিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক বিব্রতকর অবস্থায় থাকলেও সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকরা বিদেশে অর্থ পাচারসহ বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির সাথে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনেক কর্মকর্তা জড়িত রয়েছে বলে মনে করেন। শুধু তাই নয়, বন্ধকী জমি জোরপূর্বক দখল করার অভিযোগও আসে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক উপ-ব্যবস্থাপকের বিরুদ্ধে।
তিনি সাইদুল ইসলাম তাহের। যে নামটি রাজশাহীর অনেক ব্যাংক কর্মকর্তার কাছে একটি আতঙ্কের নাম। আনুষ্ঠানিকভাবে, তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের রাজশাহী অফিসের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার। তবে কয়েক বছর ধরেই রাজশাহী শহরে রিয়েল এস্টেট ব্যবসায় সঙ্গেও জড়িত তিনি। এই পেশাটিই তার সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডের পরিচয় বহন করছে।
গত বছর তাহের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে তার অবস্থানের ক্ষমতা দেখিয়ে আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের রাজশাহী শাখার একজন ঋণ খেলাপীর বন্ধকী সম্পত্তি কেনার চেষ্টা করেছিলেন। জমির মালিক তার কাছে সেই সম্পত্তি বিক্রি করতে রাজি না হওয়ায় তিনি মামলা করে হয়রানি এবং অন্যান্য আগ্রহী গ্রাহককে হুমকি দিয়ে তাড়ানোরও চেষ্টাও করছেন। এতেও কাজ না হওয়ায় একটি বেসরকারি ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপককে বন্ধকি জমিটি পাইয়ে দেয়ার প্রস্তাবও দিয়েছেন তিনি। যদিও আইন অনুযায়ী কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তা কোনোভাবেই এ ধরনের কার্যকলাপে জড়াতে পারেন না।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি বিশেষ পরিদর্শন প্রতিবেদনে সাইদুল ইসলাম তাহেরের এ কার্যকলাপের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের রাজশাহী শাখার খেলাপি গ্রাহক জনতা ট্রেডার্স ও জনতা ব্রিকসের বন্ধকি সম্পত্তি দখলচেষ্টার অভিযোগ ওঠার পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবিরের নির্দেশনায় একটি দল পরিদর্শনে গিয়ে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে ওই প্রতিবেদন তৈরি করে।
পরিদর্শন প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের রাজশাহী অফিসে কর্মরত উপ-ব্যবস্থাপক মো. সাইদুল ইসলাম তাহের বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রভাব খাটিয়ে আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি গ্রাহক জনতা ট্রেডার্স ও জনতা ব্রিকসের বন্ধকি সম্পত্তি কিনতে চান। কিন্তু অন্যান্য গ্রাহকের তুলনায় মূল্য কম দেয়ায় মালিকরা তার কাছে সম্পত্তি বিক্রি করতে রাজি হননি। এ কারণে মালিকদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা ও অন্যান্য আগ্রহী গ্রাহকদের হুমকি দিয়েছেন তাহের। তার কারণেই অন্য গ্রাহকের কাছে জমিটি বিক্রি করতে পারেননি মালিক। তাহেরের কাছে ওই জমি বিক্রি না করার কারণগুলোর মধ্যে কম দাম প্রস্তাব এবং অতিরিক্ত দুই বিঘা জমির দাবি অন্যতম।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, সাইদুল ইসলাম তাহেরের কন্যা সাদিয়া তাসনিম এবং স্ত্রী হাসিনা পারভীনের নামে ভিন্ন ব্যাংকে কোটি টাকার লেনদেন করা হয়েছে। গত বছরের নভেম্বর মাসে আইএফআইসি ব্যাংকে মেয়ের হিসাবে এক কোটি ৩০ লাখ টাকা জমা করেন তাহের। এছাড়া মেয়ে ও স্ত্রীর নামে বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে প্রায় তিন কোটি টাকার স্থিতি পেয়েছে পরিদর্শক দল।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শনে সবশেষে উল্লেখ করা হয়, সাইদুল ইসলাম তাহের জমি ক্রয়-বিক্রয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তিনি এবং আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের রাজশাহী শাখা ব্যবস্থাপক নাজমুল হুদা যৌথভাবে জনতা ব্রিকস এবং জনতা ট্রেডার্সের বন্ধকি জমি মুনাফার আশায় ক্রয়ে আগ্রহী হন।
রাজশাহীর এক ব্যাংক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে অনলাইন ভিত্তিক এক দৈনিককে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে জমি কেনাবেচার সঙ্গে জড়িত সাইদুল ইসলাম তাহের। রাজশাহীর প্রতিটি ব্যাংকের প্রত্যেকটি শাখার ম্যানেজারের কাছে তিনি ত্রাসের মতো। যেহেতু বাংলাদেশ ব্যাংক আমাদের নিয়ন্ত্রণ সংস্থা, তাই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের আমরা সম্মান করি। কিন্তু এ সম্মানের অপব্যবহার করে আসছেন তিনি।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে সাইদুল ইসলাম তাহের ওই দৈনিককে বলেন, ব্যাংকের কোনো জমির বিরুদ্ধে আদালতে মামলা থাকলে থার্ড পার্টি (তৃতীয় পক্ষ) অ্যাগ্রিমেন্টের মাধ্যমে ক্রয়-বিক্রয় করা যায়। এলাকার লোকজন চাপাচাপি করায় আমি ওই জমি কিনতে রাজি হয়েছিলাম। কিন্তু অন্য গ্রাহক আমার চেয়ে বেশি দাম বলায় (আল-আরাফাহ ইসলামী) ব্যাংকের ম্যানেজার জমি আমার কাছে হস্তান্তর করেননি।
তিনি বলেন, এ কারণে আমিও কোনো দাবি রাখিনি। দাবি না রেখেই চলে এসেছি। আমি মনে করি আমি নিরপরাধ। এ বিষয়ে যে তদন্ত হয়েছে তার ফলাফল এখন পর্যন্ত আমার অজানা। তদন্তের পর কী ধরনের সিদ্ধান্ত আসবে সেটা পুরোপুরি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যাপার।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেন, সম্পত্তি কেনা অপরাধ নয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্ষমতার অপব্যবহার করা অপরাধ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তা হিসাবে নিজের দায়িত্বে অবহেলা করে ব্যবসা করা নৈতিকতা নয়।তারা মনে করেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের উপ-ব্যবস্থাপক সাইদুল ইসলাম তাহের স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতার মতোই ক্ষমতার অপব্যবহার করে জমি দখলের চেষ্টা করেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচয় ব্যবহার করে তার এই দখলদারির ভূমিকা বাংলাদেশের সার্বিক পরিস্থিতিই তুলে ধরে বলে মনে করেন তারা। তারা মনে করেন, যে যেভাবে পারছে ক্ষমতার অপব্যবহার কিংবা অপকৌশলে নিজের সম্পদের পাহাড় গড়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। এটা আমাদের নৈতিক অবক্ষয় হিসাবেই দেখতে চান সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।
এসডব্লিউ/জেএন/কেএইচ/১৩০৩
আপনার মতামত জানানঃ