মহামারি করোনার কারণে সবচেয়ে বেশি চাপ যাচ্ছে অর্থনীতিতে। করোনায় বৈশ্বিক লেনদেন ও বাজার থমকে যাওয়ায় অর্থনীতিতে এই চাপ বাড়তে থাকে। মহামারীর প্রভাব থেকে আর্থিক খাতকে সুরক্ষা দিতে বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এসব পদক্ষেপ করোনা পরিস্থিতিতেও দেশের ব্যাংক খাতকে মোটামুটি স্থিতিশীল রেখেছে। কিন্তু রফতানি গতিতে না ফেরায় সংকটে পড়েছে দেশের পোশাক ও বস্ত্র খাত। একইসাথে চাপে পড়তে যাচ্ছে দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা রফতানিমুখী এই খাতটি। আন্তর্জাতিক ঋণমান সংস্থা মুডি’স-এর পর্যবেক্ষণে এমনি তথ্য উঠে এসেছে।
প্রতিকূল অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে ২০২০ সালের শুরু থেকে ব্যাংক ঋণ পরিশোধের বাধ্যবাধকতা স্থগিত করেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সরকারের নির্দেশনায় ঋণগ্রহীতাদের জন্য ঘোষিত ডেফারেল সুবিধা বা পেমেন্ট হলিডে কার্যকর ছিল বিদায়ী বছরজুড়ে।
করোনাভাইরাসের প্রকোপ শুরু হওয়ার পরিস্থিতিতে ঋণ পরিশোধ না করলেও কোনো গ্রাহক খেলাপি হবেন না, এমনকি ঋণের মানেরও অবনমন হবে না—এই সুযোগ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। পাশাপাশি খেলাপি কোনো গ্রাহক ঋণ শোধ করলে তার জন্য খেলাপিমুক্ত হওয়ার সুযোগও রাখা হয়। ২০২০ সালজুড়ে এই সুযোগ পান ব্যাংকের গ্রাহকেরা। কেউ কেউ এই সুযোগ গ্রহণ করলেও অনেক গ্রাহক ঋণ পরিশোধে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। এতে অনেক ব্যাংকও সমস্যায় পড়ে। কারণ, কাগজে-কলমে ঋণ ও সুদ হিসাব করলেও বাস্তবে টাকার দেখা পায়নি ব্যাংকগুলো। এর পরিপ্রেক্ষিতেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক গ্রাহকদের খেলাপি না হওয়ার সুযোগ নতুন করে আর না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়।
করোনা পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক গত বছর ঋণ পরিশোধের সময়সীমা শিথিল করার পাশাপাশি বিরূপমানে শ্রেণীকরণ (ডাউনগ্রেডিং) বন্ধ করে রাখে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত। মুডি’স বলছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঘোষিত এসব সুবিধার কারণেই দেশে গত বছর খেলাপি ঋণের হার ছিল তুলনামূলক কম। ২০২০ সালের প্রথম নয় মাসে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) দেশে খেলাপি ঋণের হার ছিল ৮ দশমিক ৯ শতাংশ। যেখানে আগের বছরের একই সময়সীমায় এ হার ছিল ১২ শতাংশ।
তবে গত মাসের শেষে অশ্রেণীকৃত মেয়াদি ঋণ ছাড়া অন্য কোনো ক্ষেত্রে এ সুবিধা আর না বাড়ানোর ঘোষণায় ঋণগ্রহীতাদের চাপ বাড়বে বলে জানিয়েছে মুডি’স। মুডি’স বলছে, বিশেষ এ সুবিধা উঠে যাওয়ায় এখন ঋণগ্রহীতাদের সময়মতো কিস্তি পরিশোধের চাপ বাড়বে। এতে মহামারীতে চাপে পড়া ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর চ্যালেঞ্জ বেড়ে যেতে পারে।
গত বছর আশঙ্কাজনক শ্লথতার মধ্যে ছিল দেশের রফতানি খাত। বিশেষ করে তৈরি পোশাক (আরএমজি) ও টেক্সটাইলের মতো রফতানি শীর্ষ খাতগুলো ধুঁকেছে সবচেয়ে বেশি। গত বছরের প্রথম নয় মাসে বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক ও টেক্সটাইল খাতের রফতানি কমেছে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৯ দশমিক ৮ শতাংশ। অথচ মহামারীর আগ মুহূর্তে ২০১৯-এর শেষেও দেশে মোট বিতরণকৃত ব্যাংকঋণের ১৯ দশমিক ৪ শতাংশই ছিল আরএমজি ও টেক্সটাইল খাতে দেয়া।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনা মহামারীর কারণে রফতানিমুখী পোশাক খাতের বেচাকেনা কমেছে। এর ধারাবাহিকতায় চাপের মুখে পড়ে গিয়েছে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি। সরকারি প্রণোদনার অর্থে সাময়িকভাবে পতন ঠেকানো সম্ভব হলেও মহামারী পূর্ববর্তী অবস্থানে ফেরেনি দেশের তৈরি পোশাক ও বস্ত্র খাত। রয়ে গেছে করোনাকালীন চ্যালেঞ্জ। ফলে এ খাতের ব্যবসায়ীদের জন্য নির্ধারিত সময় মেনে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করা কঠিন।
তারা মনে করেন, এই সুবিধা বন্ধ করে দেওয়া সঠিক সিদ্ধান্ত। তবে এসএমই ও পোশাক খাতের জন্য সুবিধাটা রাখতে পারলে ভালো হতো। কারণ, এই দুই খাত এখনো লড়াই করে যাচ্ছে। করোনা এখনো শেষ হয়ে যায়নি। আর ঋণের মেয়াদ সব ক্ষেত্রে বাড়ানোর সুযোগ দিলে ভালো হয়। কারণ, মেয়াদি ঋণে ছাড় পেলে চলতি মূলধন ঋণে পাবে না কেন? তারা বলেন, এখন বাজারে অনেক তারল্য। কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত বছর ব্যাংকগুলোকে যে টাকা দিয়েছে, তা তুলে নিলে ভালো হয়। এতে বাজারে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসবে। ব্যাংকগুলোও ঋণ আদায়ে তৎপরতা বাড়াবে।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) চেয়ারম্যান মো. নজরুল ইসলাম মজুমদার বণিক বার্তাকে বলেন, ইউরোপে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ চলছে। সংক্রমণ ঠেকাতে লকডাউনসহ নানা পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। সেখানকার খুচরা বাজারও বন্ধ। এরই প্রভাব পড়ছে রফতানি খাতে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এরই মধ্যে নেয়া পদক্ষেপগুলো ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। তবে করোনার সংক্রমণ পুরোপুরি কেটে গিয়েছে, এখনই তা ভাবার সুযোগ নেই। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আগামীতে প্রয়োজনীয় আরো পদক্ষেপ নেয়ার বিষয়ে ভাবতে হবে। বিজিএমইএসহ অন্যান্য বাণিজ্য সংগঠন আমাদের কাছে বেশকিছু দাবি জানিয়েছে। এসব বিষয়েও উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৩০
আপনার মতামত জানানঃ