বন্দরনগরী চট্টগ্রামে সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী ১৩ হাজার সিএনজিচালিত অটোরিকশা বাতিল প্রক্রিয়া শুরু হয় ২০১৮ সালে। সম্পূর্ণ বিনা মূল্যে এসব অটোরিকশা ভাঙার নিয়ম থাকলেও অবৈধভাবে মালিকদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে ৬০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত। সিএনজি অটোরিকশা স্ক্র্যাপিং করতে বিআরটিএ শীর্ষ কর্মকর্তাদের যোগসাজশে শত কোটি টাকার অবৈধ বাণিজ্য করেছে চট্টগ্রামের আট নতুন অটোরিকশা বিক্রয়কারী ডিলার প্রতিষ্ঠান।
দেশে সিএনজি অটো রিকশা চলাচল শুরুর পর বিআরটিএ থেকে সেগুলোর চলাচলের সময়সীমা (ইকোনমিক লাইফ) ধরা হয়েছিল নয় বছর। পরে মালিকদের দাবির মুখে তিন দফায় আরও ছয় বছর বাড়িয়ে ১৫ বছর করা হয়। বিআরটিএ সূত্রে জানা যায়, ২০০১ সাল থেকে ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীতে ১৩ হাজার করে ২৬ হাজার সিএনজিচালিত অটোরিকশা নিবন্ধন দেয় বিআরটিএ। এসব গাড়ির মেয়াদকাল নির্ধারণ করা হয়েছে ১৫ বছর করে। যে কারণে পরিবেশগত ক্ষতির প্রভাবমুক্ত হতে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে ইতোমধ্যে ঢাকায় নিবন্ধিত ১৩ হাজার সিএনজি ইতোমধ্যে স্ক্র্যাপ করে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে।
চট্টগ্রামে ইকোনমি লাইফ (আয়ুষ্কাল) পেরিয়ে যাওয়া ১৩ হাজার সিএনজি চালিত অটোরিকশার মধ্যে ১২ হাজার স্ক্র্যাপিং সম্পন্ন করেছে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ)। শেষ দফায় ৩১জানুয়ারি ২০২১, রোববার পর্যন্ত প্রায় চার হাজার গাড়ি স্ক্র্যাপকরণ কাজ শেষ হয়েছে। সীমাবদ্ধ জনবলের মধ্যে এবং কোভিড প্রাদুর্ভাবে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করে এসব সিএনজি অটোরিকশা স্ক্র্যাপ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিআরটিএ কর্মকর্তারা।
জানা গেছে, অনিশ্চয়তা ও ভোগান্তি এড়াতে শেষ পর্যন্ত দালাল ও ডিলার প্রতিষ্ঠানের শরণাপন্ন হতে হচ্ছে মালিকদের। এসব অটোরিকশা থেকে ন্যূনতম ৬০ হাজার থেকে সর্বোচ্চ দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত হাতিয়ে নিয়েছে দালাল চক্র। চলতি বছর সর্বশেষ আরো এক হাজার অটোরিকশা স্ক্র্যাপ করা হবে। এরই মধ্যে ডিলার প্রতিষ্ঠানগুলো স্ক্র্যাপিংয়ের জন্য বুকিং কার্যক্রমও শুরু করেছে ।
চট্টগ্রামের হাটহাজারীর বালুচরায় বিআরটিএর চট্টগ্রাম কার্যালয়ে প্রায় প্রতিটি অটোরিকশাই দালালের মাধ্যমে চুক্তি করে স্ক্র্যাপিংয়ের জন্য নিয়ে আসা হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিআরটিএ এলাকায় অপেক্ষারত মালিক ও চালকরা জানিয়েছেন, প্রতিটি সিএনজি অটোরিকশা স্ক্র্যাপিংয়ের সর্বনিম্ন দর হচ্ছে ৬০ হাজার টাকা। এছাড়া যেসব অটোরিকশার কাগজপত্রে জটিলতা রয়েছে সেগুলোর জন্য ৮০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত দিতে হচ্ছে ডিলারদের। অর্থ প্রদানের পর সেলফোনের মাধ্যমে বিশেষ কোড নম্বর বিআরটিএ কার্যালয়ে পাঠালে ওই অটোরিকশা নির্ধারিত দিনে দ্রুততম সময়ের মধ্যে ভেঙে ফেলা হয়। আর যারা ডিলার বা দালালদের মাধ্যমে যাননি, নানা অজুহাতে তাদের ফেরত পাঠিয়ে দেয়া হয়।
চট্টগ্রাম বিআরটিএ’র উপ-পরিচালক (প্রকৌশল) শহীদুল্লাহ বলেন, নষ্ট করার পর ওই সিএনজি অটোরিকশার নিবন্ধন নম্বর সার্ভার থেকে মুছে দেওয়া হয়। পরবর্তীতে নষ্ট করা গাড়ির মালিক নতুন অটোরিকশা কিনলে সেটির জন্য নতুন নম্বরের আবেদন করবেন। পরিবেশবান্ধব নগরী গড়তে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা মোতাবেক মেয়াদোত্তীর্ণ এসব অটোরিকশা স্ক্র্যাপিং করা হচ্ছে। স্ক্র্যাপ করার পর ওইসব গাড়ির মালিকদের নতুন গাড়ি প্রতিস্থাপনপূর্বক নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চট্টগ্রামের সিএনজি অটোরিকশা স্ক্র্যাপিংয়ের সঙ্গে যুক্ত পাঁচলাইশ থানাধীন বাদুড়তলা এলাকার বেশ কয়েকটি মোটরস শো-রুম ডিলার প্রতিষ্ঠান। এছাড়া নগরীর সর্বমোট ৮-১০টি ডিলার প্রতিষ্ঠান বিআরটিএর সঙ্গে যোগসাজশে অটোরিকশা স্ক্র্যাপিংয়ের অনৈতিক বাণিজ্যে যুক্ত রয়েছে। এগুলো হলো ইমাম ডেন্টিং, জাফর অ্যান্ড কোম্পানি, রাজামিয়া অ্যান্ড সন্স, এসবি করপোরেশন, গাউসিয়া ট্রেডার্স, মেসার্স দিলু মিয়া, বিসমিল্লাহ এন্টারপ্রাইজ, মঞ্জুর অ্যান্ড কোম্পানি। মূলত যানবাহন কেনাবেচার সঙ্গে যুক্ত থাকায় ডিলার প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে বিআরটিএর সখ্যতার কারণে নিরাপদ হিসেবে ডিলাররা এসব লেনদেনে সহযোগিতা করছে।
নগরীর পাহাড়তলী এলাকার নুরুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) লিখিত অভিযোগ করেছেন। অভিযোগপত্রে তিনি উল্লেখ করেছেন, চারটি সিএনজি অটোরিকশা (চট্টমেট্রো-থ-১২-১১৩৯, চট্টমেট্রো থ-১২-০৭৪৮, চট্টমেট্রো থ-১২-১১৩৯ ও চট্টমেট্রো থ-১২-১০৩৩) স্ক্র্যাপ করতে বিআরটিএ কার্যালয়ে যোগাযোগ করেন। এরপর দালালরা প্রতিটি অটোরিকশা ধ্বংস করার জন্য ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা দাবি করে। এসব ঘটনায় নুরুল ইসলাম চট্টগ্রাম বিআরটিএর সহকারী প্রকৌশলী মো. তৌহিদুল হোসেন, পরিদর্শক মো. জামাল উদ্দিন ও অফিস পিয়ন মো. নুরুল ইসলামের নামে অভিযোগ দায়ের করেন।
বিআরটিএ চট্টগ্রাম মেট্রো সার্কেলের সহকারী পরিচালক (ইঞ্জিনিয়ারিং) তৌহিদুল ইসলাম বলেন, আমাদের সীমাবদ্ধ জনবল রয়েছে। নিয়মিত কাজের মাঝামাঝি সিএনজি অটোরিকশাগুলো স্ক্র্যাপিং ও নতুন নিবন্ধন দেওয়া হচ্ছে। এসব কাজে ঝক্কিও কম নয়। তারপরেও চট্টগ্রামের প্রায় ১২ হাজার অটোরিকশা ইতোমধ্যে স্ক্র্যাপ করে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। ২০০৫ সালের তৈরি আরো এক হাজার অটোকিশা রয়েছে। যেগুলো মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পাওয়ার পর স্ক্র্যাপিং করা যাবে।
এদিকে অটোরিকশা ভাঙার ক্ষেত্রেও রয়েছে বিআরটিএর নানান অনিয়ম। পরিবেশ দূষণ রোধে এসব অটোরিকশা ধ্বংস করা হলেও একটি পুরনো অটোরিকশার প্রায় ৭০-৮০ শতাংশ যন্ত্রাংশই অক্ষত রেখে দেয়া হচ্ছে। ধ্বংসের সময় শুধু লোহার কয়েকটি পাত গুঁড়িয়ে দেয়া হলেও মূল ইঞ্জিন ও চেসিস, পুরনো টায়ার অক্ষত রাখা হয়। যা পরবর্তী সময়ে পুরনো যন্ত্রাংশ হিসেবে খোলাবাজারে বিক্রি করা সম্ভব।
চালক ও মালিকদের অভিযোগ, ধ্বংসপ্রাপ্ত একটি অটোরিকশার ওজন অন্তত ৫০০ কেজি। বর্তমান বাজারমূল্যে পুরনো লোহার দামের হিসাবে ধ্বংস করা অটোরিকশাটির দাম অন্তত ১৫-২০ হাজার টাকা হওয়ার কথা। কিন্তু বিআরটিএ প্রাঙ্গণেই স্থানীয় দালালরা এক-দেড় হাজার টাকায় এসব অটোরিকশা জোর করে মালিকদের কাছ থেকে কিনছে।
চট্টগ্রাম বিভাগের বিআরটিএর উপপরিচালক (প্রকৌশল) মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ বণিক বার্তাকে বলেন, নিয়ম মেনেই চট্টগ্রামের অটোরিকশাগুলো পর্যায়ক্রমে ভেঙে ফেলা হচ্ছে। কেউ যাতে ভোগান্তির মধ্যে না পড়েন সেজন্য নিয়ম মেনে বিআরটিএ কার্যালয়ের সামনে ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে স্ক্র্যাপিং করা হচ্ছে। এতে কোনো অনিয়ম বা ভোগান্তি হচ্ছে না। কেউ যদি বিআরটিএ কার্যালয়ের বাইরে কারো সঙ্গে নিয়মবহির্ভূতভাবে আর্থিক লেনদেন করে তাতে আমাদের কিছু করার নেই।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, চট্টগ্রাম বিআরটিএ কার্যালয় নিয়ে গাড়ি চালক ও মালিকদের হয়রানি ও দুর্নীতির অভিযোগের শেষ নেই, টাকা ছাড়া কোন কাজই হয় না। গাড়ির রেজিস্ট্রেশন, ফিটনেস, চালক লাইসেন্স ও মালিকানা বদলসহ কোন কাজই বাড়তি টাকা ছাড়া করা যায় না। শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা একই জায়গায় ৫ থেকে ৭ বছর যাবত্ কর্মরত থাকলেও তাদের বদলি করা হয় না। অসাধু কর্মকর্তাদের কাছে পরিবহন সেক্টরের লোকেরা জিম্মি হয়ে পড়েছেন।
এসডব্লিউ/বিবি/ এফএ/১৬০০
আপনার মতামত জানানঃ