কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনস (সিএফআর)–এর সাম্প্রতিক বিশ্লেষণী প্রতিবেদন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতা নিয়ে নতুন করে আলোচনা উসকে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে প্রভাবশালী এই থিংক ট্যাঙ্ক তাদের ‘প্রিভেন্টিভ প্রায়োরিটিজ সার্ভে ২০২৬’-এ বাংলাদেশে সম্ভাব্য সংঘাতের শঙ্কাকে ‘মাঝারি’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। যদিও এটি যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি কৌশলগত স্বার্থের দিক থেকে উচ্চ ঝুঁকির তালিকায় নেই, তবু প্রতিবেদনের ভাষ্য অনুযায়ী এই সংঘাত গুরুতর কিংবা বৃহৎ মানবিক সংকটে রূপ নিতে পারে—যা বাংলাদেশসহ পুরো অঞ্চলের জন্য গভীর উদ্বেগের বিষয়।
সিএফআর তাদের মূল্যায়নে একটি ‘রিস্ক অ্যাসেসমেন্ট ম্যাট্রিক্স’ ব্যবহার করেছে, যেখানে সম্ভাব্য সংঘাতগুলোকে দুটি মানদণ্ডে বিচার করা হয়। একদিকে রয়েছে সংঘাত ঘটলে তা যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থে কতটা প্রভাব ফেলতে পারে, অন্যদিকে রয়েছে সেই সংঘাত বাস্তবে ঘটার সম্ভাবনা কতটা। এই দুই মানদণ্ডের ভিত্তিতে বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলের ঝুঁকিকে টায়ার ওয়ান, টায়ার টু ও টায়ার থ্রি—এই তিন শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে। টায়ার ওয়ানে রয়েছে এমন সংঘাত, যেগুলোর সম্ভাবনাও বেশি এবং যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থে প্রভাবও বড়। টায়ার টুতে রয়েছে মাঝামাঝি ধরনের ঝুঁকি। আর টায়ার থ্রি হলো এমন সংঘাত, যেখানে হয় প্রভাব কম কিন্তু সম্ভাবনা মাঝারি, অথবা প্রভাব মাঝারি কিন্তু সম্ভাবনা কম, কিংবা উভয়ই কম।
বাংলাদেশকে এই তালিকায় টায়ার থ্রি ক্যাটাগরিতে রাখা হয়েছে। সিএফআর–এর বিশ্লেষণ অনুযায়ী, বাংলাদেশে সম্ভাব্য সংঘাত যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থে তুলনামূলকভাবে কম প্রভাব ফেলবে, কিন্তু এর ঘটার সম্ভাবনা মাঝারি মাত্রার। এই ‘মাঝারি সম্ভাবনা’ শব্দবন্ধটিই আসলে সবচেয়ে বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ এটি ইঙ্গিত দেয় যে সংঘাতের আশঙ্কা নিছক কল্পনা নয় বা দূরবর্তী সম্ভাবনাও নয়; বরং বর্তমান রাজনৈতিক ও সামাজিক গতিপ্রবাহ অব্যাহত থাকলে অস্থিরতা সহিংস রূপ নিতে পারে।
প্রতিবেদনটি স্পষ্টভাবে রাজনৈতিক ও ধর্মভিত্তিক সহিংসতার ক্রমবর্ধমান প্রবণতাকে এই ঝুঁকির প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ক্রমেই বেশি সংঘাতমুখী হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক আস্থাহীনতা, সহনশীলতার অভাব এবং নির্বাচনকেন্দ্রিক দ্বন্দ্ব প্রায় নিয়মিত সহিংসতায় রূপ নিচ্ছে। বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির ওপর দমনমূলক নীতির অভিযোগ, গ্রেপ্তার, মামলা ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে বাধা দেওয়ার অভিযোগ রাজনৈতিক অচলাবস্থাকে আরও ঘনীভূত করছে। এই প্রেক্ষাপটে সিএফআর মনে করছে, শাসনব্যবস্থা দুর্বল হতে থাকলে এবং জাতীয় নির্বাচন বিলম্বিত বা প্রশ্নবিদ্ধ হলে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠতে পারে।
ধর্মভিত্তিক সহিংসতার প্রসঙ্গটিও প্রতিবেদনে গুরুত্বের সঙ্গে এসেছে। বাংলাদেশ ঐতিহাসিকভাবে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্য পরিচিত হলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা, মন্দির ভাঙচুর কিংবা ধর্মীয় ইস্যুতে সহিংস প্রতিক্রিয়ার ঘটনা দেশটির সামাজিক বুননকে চাপের মুখে ফেলেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া গুজব, উসকানিমূলক বক্তব্য এবং ধর্মীয় অনুভূতিকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের প্রবণতা পরিস্থিতিকে আরও নাজুক করে তুলছে। সিএফআর–এর বিশ্লেষণে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে, এই ধরনের সহিংসতা যদি রাজনৈতিক অস্থিরতার সঙ্গে মিলে যায়, তবে তা বৃহত্তর সংঘাতে রূপ নেওয়ার ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
যদিও যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের দিক থেকে বাংলাদেশকে ‘কম প্রভাবশালী’ হিসেবে দেখা হয়েছে, তবু মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে ঝুঁকির মাত্রা মোটেও কম নয়। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে সংঘাত দেখা দিলে তা গুরুতর বা বৃহৎ মানবিক সংকট তৈরি করতে পারে। বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ দেশ হওয়ায় সামান্য মাত্রার সহিংসতাও এখানে ব্যাপক মানুষের জীবনে প্রভাব ফেলতে পারে। অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতি, জীবন ও সম্পদের ক্ষতি, অর্থনৈতিক কার্যক্রমে স্থবিরতা এবং সামাজিক অস্থিরতা—সব মিলিয়ে সংঘাতের খেসারত দিতে হবে সাধারণ মানুষকেই।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিও এই ঝুঁকির আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ একটি মাত্রা। গত এক দশকে দেশটি উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে, দারিদ্র্য হ্রাস পেয়েছে, তৈরি পোশাক শিল্পসহ রপ্তানি খাতে বিস্তার ঘটেছে। কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সহিংসতা এই অর্জনগুলোকে ঝুঁকির মুখে ফেলতে পারে। বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমে যাওয়া, সরবরাহব্যবস্থায় বিঘ্ন এবং আন্তর্জাতিক বাজারে নেতিবাচক ভাবমূর্তি অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদি চাপ সৃষ্টি করতে পারে। সিএফআর–এর মতো আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিবেদনে সংঘাতের আশঙ্কা উঠে আসা মানেই বিশ্ব সম্প্রদায় বিষয়টি নজরে রাখছে—এটি বাংলাদেশের জন্য একটি সতর্কবার্তা।
প্রতিবেদনটি যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থকে কেন্দ্র করে তৈরি হলেও এর বিশ্লেষণ বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাস্তবতার সঙ্গে গভীরভাবে সংযুক্ত। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশ হয়তো সরাসরি নিরাপত্তা ঝুঁকি নয়, কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতা, আঞ্চলিক বাণিজ্য এবং মানবিক মূল্যবোধের দিক থেকে দেশটির গুরুত্ব অনস্বীকার্য। তাছাড়া বাংলাদেশে বড় ধরনের মানবিক সংকট তৈরি হলে তার প্রভাব সীমান্ত পেরিয়ে আশপাশের দেশগুলোতেও পড়তে পারে, যা শেষ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
সিএফআর–এর এই মূল্যায়নকে তাই শুধু একটি বিদেশি থিংক ট্যাঙ্কের মতামত হিসেবে দেখলে চলবে না। এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব, নীতিনির্ধারক এবং নাগরিক সমাজের জন্য একটি আয়নার মতো কাজ করতে পারে। রাজনৈতিক মতভেদ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার স্বাভাবিক অংশ হলেও তা সহিংসতায় রূপ নেওয়া কোনোভাবেই টেকসই নয়। একইভাবে ধর্মীয় পরিচয়কে বিভাজনের হাতিয়ার বানালে সমাজের ভেতরের সহনশীলতা ভেঙে পড়ে, যার ফল ভোগ করতে হয় দীর্ঘ সময় ধরে।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক দিক হলো, প্রতিবেদনে জাতীয় নির্বাচন বিলম্বিত হওয়ার সম্ভাবনাকে অস্থিরতা বৃদ্ধির একটি বড় কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। নির্বাচন কোনো দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দু। এটি প্রশ্নবিদ্ধ হলে বা দীর্ঘদিন ঝুলে থাকলে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা বাড়ে, বৈধতার সংকট তৈরি হয় এবং সহিংসতার ঝুঁকি তীব্র হয়। সিএফআর–এর বিশ্লেষণ ইঙ্গিত দিচ্ছে, বাংলাদেশে এই অনিশ্চয়তা যদি দীর্ঘস্থায়ী হয়, তবে সংঘাতের সম্ভাবনা আর ‘মাঝারি’ পর্যায়ে সীমাবদ্ধ নাও থাকতে পারে।
এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের সামনে চ্যালেঞ্জ একাধিক। একদিকে রাজনৈতিক সংলাপ ও অংশগ্রহণমূলক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আস্থার সংকট কমানো, অন্যদিকে ধর্মীয় ও সামাজিক সহিংসতার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়া। শাসনব্যবস্থাকে আরও কার্যকর ও জবাবদিহিমূলক করা ছাড়া এই ঝুঁকি মোকাবিলা করা কঠিন। সিএফআর–এর প্রতিবেদনে সরাসরি কোনো নীতিপরামর্শ দেওয়া না হলেও এর অন্তর্নিহিত বার্তা পরিষ্কার—বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে পরিস্থিতি আরও অবনতি হতে পারে।
সব মিলিয়ে, ‘প্রিভেন্টিভ প্রায়োরিটিজ সার্ভে ২০২৬’-এ বাংলাদেশের অবস্থান একদিকে যেমন স্বস্তির—কারণ এটি টায়ার ওয়ান বা টায়ার টুর মতো উচ্চ ঝুঁকির তালিকায় নেই—অন্যদিকে তেমনি গভীর সতর্কতারও। মাঝারি সম্ভাবনার সংঘাত মানে এখনো পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার সুযোগ আছে। কিন্তু সেই সুযোগ কাজে লাগাতে না পারলে রাজনৈতিক ও ধর্মভিত্তিক সহিংসতা যে বৃহত্তর মানবিক সংকটে রূপ নিতে পারে, সে বিষয়ে সিএফআর–এর এই প্রতিবেদন একটি স্পষ্ট সতর্ক সংকেত দিয়ে গেছে।
আপনার মতামত জানানঃ