বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের বর্তমান চিত্রটি প্রথম নজরে স্বস্তিদায়ক মনে হতে পারে। ব্যাংকে টাকার অভাব নেই, বরং উদ্বৃত্ত তারল্যের পাহাড় জমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর শেষে যেখানে ব্যাংকগুলোর হাতে অতিরিক্ত তারল্য ছিল প্রায় দুই লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা, ২০২৫ সালের জুনে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় দুই লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকায়। কাগজে–কলমে এই সংখ্যা অর্থনীতির স্থিতিশীলতার ইঙ্গিত দেয়। কিন্তু সংখ্যার আড়ালে লুকিয়ে আছে এক ধরনের অচলাবস্থা, যা ধীরে ধীরে পুরো অর্থনীতিকে গ্রাস করছে।
এই বিপুল পরিমাণ অর্থ বাস্তব উৎপাদনশীল খাতে প্রবাহিত হচ্ছে না। নতুন শিল্পকারখানা গড়ে উঠছে না, বড় কোনো বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে না, কর্মসংস্থানের নতুন সুযোগও তৈরি হচ্ছে না। ব্যাংকে টাকা জমছে, কিন্তু সেই টাকা ঘুরছে না। অর্থনীতির ভাষায় এটিই ‘অলস তারল্য’—যেখানে অর্থ আছে, কিন্তু গতি নেই। এই গতি না থাকাই এখন দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় সংকেত হয়ে উঠছে।
বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি এই স্থবিরতার সবচেয়ে স্পষ্ট প্রতিফলন। ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে মাত্র ৬ দশমিক ২৯ শতাংশে, যা গত চার বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। এক বছর আগেও এই হার ছিল ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ। এই পতন কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়; বরং এটি উদ্যোক্তাদের মানসিক অবস্থার ধারাবাহিক অবনতির ফল। বিনিয়োগ মানে শুধু পুঁজি নয়, বিনিয়োগ মানে ঝুঁকি নেওয়ার সাহস। সেই সাহসটাই এখন দুর্বল হয়ে পড়েছে।
উচ্চ সুদের হার বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করার একটি বড় কারণ। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে গিয়ে সুদের হার দীর্ঘদিন তুলনামূলক উচ্চ পর্যায়ে রাখা হয়েছে। ফলে ঋণ নিয়ে নতুন প্রকল্প শুরু করলে লাভের সম্ভাবনা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, নীতিগত পরিবর্তনের আশঙ্কা, বৈশ্বিক অর্থনীতির মন্দাভাব এবং ব্যাংক খাত সংস্কার নিয়ে চলমান আলোচনার অনিশ্চিত ফলাফল। উদ্যোক্তারা যখন সামনে ছয় মাস বা এক বছরের চিত্র স্পষ্ট দেখতে পান না, তখন তারা স্বাভাবিকভাবেই বড় সিদ্ধান্ত থেকে পিছিয়ে যান।
এই অনিশ্চয়তার মাঝেও একটি বিষয় চোখে পড়ার মতো—ব্যাংকে আমানত বাড়ছে। ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর শেষে দেশের ব্যাংকিং খাতে মোট আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৯ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা। মাত্র তিন মাসে আমানত বেড়েছে প্রায় ৩৭ হাজার কোটি টাকা। অনেকেই এটিকে আস্থার ফিরতি লক্ষণ হিসেবে দেখছেন। সুদের হার তুলনামূলক বেশি হওয়ায় এবং নগদ অর্থ হাতে রাখার ঝুঁকি বিবেচনায় মানুষ আবার ব্যাংকে টাকা রাখছে। এটি নিঃসন্দেহে একটি ইতিবাচক দিক।
কিন্তু এখানেই সৃষ্টি হয়েছে সবচেয়ে বড় দ্বন্দ্ব। এই আমানত বিনিয়োগে রূপান্তরিত হচ্ছে না। ব্যাংকের ভেতরে টাকা জমছে, কিন্তু সেই টাকা বাস্তব অর্থনীতিতে প্রবেশ করছে না। ফলে ব্যাংকগুলোর হাতে তারল্য বাড়ছে, অথচ অর্থনীতির গতি বাড়ছে না। এই পরিস্থিতিতে ব্যাংকগুলোর আচরণও বদলে গেছে। ঝুঁকি এড়ানোর প্রবণতা বেড়েছে। তারা শিল্প বা বেসরকারি উদ্যোক্তাকে ঋণ দেওয়ার চেয়ে সরকারি ট্রেজারি বিল ও বন্ডে বিনিয়োগকে বেশি নিরাপদ মনে করছে। কারণ সেখানে ঝুঁকি কম, আয় নিশ্চিত। কিন্তু এর ফলে অর্থনীতির জন্য যে ঋণপ্রবাহ দরকার, সেটি আরও সংকুচিত হচ্ছে।
এই অবস্থার প্রভাব ব্যাংকগুলোর নিজের ওপরও পড়ছে। সাম্প্রতিক অনিরীক্ষিত হিসাব বলছে, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বেশ কয়েকটি ব্যাংকের মুনাফা কমেছে। কারণ ব্যাংকের মূল ব্যবসাই হলো ঋণ দেওয়া ও সেই ঋণ থেকে আয় করা। যখন ঋণ বিতরণ কমে যায়, তখন মুনাফাও কমে। একদিকে ব্যাংকের হাতে অলস টাকা জমছে, অন্যদিকে আয় কমছে—এই বৈপরীত্য ব্যাংক খাতের জন্য দীর্ঘমেয়াদে ভালো লক্ষণ নয়।
সরকারি ঋণনীতিও এই পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলছে। সরকার সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংক থেকে তুলনামূলক কম ঋণ নিয়েছে। বরং বেশি সুদ দিয়েও সঞ্চয়পত্রের ওপর নির্ভরতা বাড়িয়েছে। ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত সরকারের নিট অভ্যন্তরীণ ঋণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা, আর একই সময়ে সঞ্চয়পত্রের স্থিতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকায়। স্বল্পমেয়াদে এটি সরকারের জন্য সুবিধাজনক হলেও, ব্যাংকিং ব্যবস্থায় জমে থাকা অলস তারল্যের সমস্যার স্থায়ী সমাধান এতে হচ্ছে না।
অবশ্য অর্থনীতির সব সূচকই যে নেতিবাচক, তা নয়। প্রবাসী আয়ের প্রবাহ কিছুটা স্বস্তি এনে দিয়েছে। ২০২৪–২৫ অর্থবছরের শুরুতে রেমিটেন্স বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩০ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন ডলারে, যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ২৭ শতাংশ বেশি। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও বেড়ে প্রায় ৩১ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। বিশ্বব্যাংকসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো এই প্রবণতাকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছে।
কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই ইতিবাচক সংকেতগুলো এখনো বিনিয়োগকারীদের মন পুরোপুরি বদলাতে পারছে না। কারণ বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত শুধু অর্থনৈতিক সূচক দেখে নেওয়া হয় না। বিনিয়োগের জন্য দরকার নীতির স্থিরতা, রাজনৈতিক পরিবেশের পূর্বানুমানযোগ্যতা এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে একটি পরিষ্কার ধারণা। এই জায়গাগুলোতেই এখন সবচেয়ে বড় ঘাটতি।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ব্যাংক খাতের ভেতরের বৈষম্য। সব ব্যাংকের হাতে উদ্বৃত্ত তারল্য নেই। সরকারি ও বড় বেসরকারি ব্যাংকের হাতে যেখানে অতিরিক্ত টাকা জমছে, সেখানে কিছু শরিয়াহভিত্তিক ও বিশেষায়িত ব্যাংক এখনও তারল্য সংকটে ভুগছে। এই অসম চিত্র সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন তোলে—যদি কিছু ব্যাংকে সমস্যা থাকে, তাহলে পুরো ব্যবস্থাই কি নিরাপদ? এই সন্দেহ আস্থার সংকটকে আরও গভীর করে।
এই প্রেক্ষাপটে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের অবস্থান সবচেয়ে নাজুক। অথচ এই খাতেই সবচেয়ে বেশি কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা। ঝুঁকি এড়ানোর প্রবণতায় ব্যাংকগুলো বড় ও পরিচিত গ্রাহকদের দিকে ঝুঁকছে। ফলে নতুন বা মাঝারি উদ্যোক্তারা ঋণ পেতে হিমশিম খাচ্ছেন। একদিকে উদ্যোক্তারা নিরাপদ সময়ের অপেক্ষায়, অন্যদিকে ব্যাংকগুলো নিরাপদ গ্রাহকের সন্ধানে। মাঝখানে পড়ে যাচ্ছে সম্ভাবনাময় উদ্যোগগুলো।
যদি এই অলস টাকা দীর্ঘদিন ব্যাংকের ভেতরে আটকে থাকে, তাহলে তার সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব ধীরে ধীরে আরও গভীর হবে। কর্মসংস্থান বাড়বে না, মানুষের আয় বাড়বে না, ভোগ কমবে। কাগজে–কলমে অর্থনীতি শক্ত দেখালেও বাস্তবে সাধারণ মানুষ সেই শক্তির সুফল পাবে না। এতে সামাজিক অসন্তোষও বাড়তে পারে।
অনেকে মনে করেন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে বিনিয়োগও ফিরবে। হয়তো ফিরবে। কিন্তু অভিজ্ঞতা বলে, আস্থা একবার নড়ে গেলে শুধু সময় দিলেই তা ফেরে না। দরকার ধারাবাহিক নীতি, দৃশ্যমান সংস্কার এবং সিদ্ধান্ত ও বাস্তবতার মধ্যে মিল। বিনিয়োগকারীরা এখন শুধু ঘোষণায় বিশ্বাস করেন না; তারা কাজের প্রতিফলন দেখতে চান।
সবশেষে বলা যায়, ব্যাংকিং খাতে বিপুল অর্থ জমে থাকা নিজেই কোনো সমস্যা নয়। সমস্যা তখনই, যখন এই অর্থ কার্যকরভাবে ব্যবহৃত হয় না। অর্থনীতির শক্তি শুধু টাকার পরিমাণে নয়, তার প্রবাহ ও গতিশীলতায়। যদি এই অলস তারল্যকে উৎপাদনশীল খাত, নতুন বিনিয়োগ এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির দিকে প্রবাহিত করা না যায়, তাহলে আজ যে পরিসংখ্যানগুলো স্বস্তির মনে হচ্ছে, সেগুলোই একসময় অর্থনীতির জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াতে পারে। দেশে অর্থের অভাব নেই। সবচেয়ে বড় সংকট হলো আস্থার। সেই আস্থা ফিরিয়ে আনাই এখন নীতিনির্ধারকদের সবচেয়ে বড়
আপনার মতামত জানানঃ