ইতিহাস, ধর্ম ও শিল্প—এই তিনের সংযোগস্থলে দাঁড়িয়ে যিশু খ্রিস্টের চেহারা নিয়ে যে প্রশ্নটি বারবার ফিরে আসে, তা হলো: তিনি আসলে দেখতে কেমন ছিলেন? দুই হাজার বছরের বেশি সময় ধরে পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ যিশুকে চিনে এসেছে মূলত শিল্পীদের আঁকা ছবির মাধ্যমে—দীর্ঘদেহী, শুভ্র ত্বক, লম্বা বাদামি চুল, নীল চোখ, শান্ত ও করুণ দৃষ্টি। এই চেহারাটি এতটাই পরিচিত যে অনেকের কাছে এটিই যেন যিশুর “স্বাভাবিক” রূপ। অথচ ইতিহাসের চোখে তাকালে দেখা যায়, এই চিত্রটি বাস্তবতার চেয়ে ইউরোপীয় কল্পনার প্রতিফলনই বেশি।
যিশু ছিলেন প্রথম শতাব্দীর একজন ইহুদি, জন্ম ও বেড়ে ওঠা মধ্যপ্রাচ্যের গ্যালিলি অঞ্চলে। ইতিহাসবিদদের কাছে এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সূত্র। কারণ কোনো মানুষের চেহারা বোঝার ক্ষেত্রে তার ভৌগোলিক অবস্থান, জাতিগত পরিচয়, জলবায়ু ও সমসাময়িক সমাজ বাস্তবতা বড় ভূমিকা রাখে। সেই সময়কার মধ্যপ্রাচ্যের ইহুদিদের শারীরিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে প্রত্নতাত্ত্বিক ও নৃতাত্ত্বিক গবেষণায় একটি মোটামুটি স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। তারা সাধারণত ছিলেন খাটো গড়নের, গায়ের রঙ শ্যামবর্ণ বা তামাটে, চুল ও চোখের রঙ গাঢ়—কালো বা গাঢ় বাদামি। প্রখর সূর্যের নিচে কাজ করা মরুভূমি ও আধা-মরুভূমির মানুষের শরীর এমনই হওয়ার কথা।
বাইবেলে যিশুর চেহারা নিয়ে আশ্চর্যজনকভাবে প্রায় কিছুই বলা হয়নি। চারটি গসপেল তাঁর জীবন, শিক্ষা, নৈতিকতা ও মৃত্যুকে কেন্দ্র করে লেখা হলেও কোথাও তাঁর উচ্চতা, গায়ের রঙ, চুলের দৈর্ঘ্য কিংবা মুখাবয়বের বিস্তারিত বর্ণনা নেই। ইতিহাসবিদ জোয়ান ই. টেলরের মতে, এই নীরবতাই অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। যিশুর প্রথমদিককার অনুসারীদের কাছে তাঁর বাহ্যিক চেহারা গুরুত্বপূর্ণ ছিল না; গুরুত্বপূর্ণ ছিল তাঁর কথা, তাঁর শিক্ষা, তাঁর ভাবনা। একজন ধর্মগুরুকে তখন বিচার করা হতো তাঁর দর্শন দিয়ে, চেহারা দিয়ে নয়।
এই তথ্যের অভাবই পরবর্তী শতাব্দীগুলোতে কল্পনার জায়গা তৈরি করে দেয়। খ্রিস্টধর্ম যখন ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল পেরিয়ে ইউরোপে বিস্তৃত হতে শুরু করে, তখন স্থানীয় সংস্কৃতি ও শিল্পধারার প্রভাব যিশুর প্রতিচ্ছবিতেও পড়তে থাকে। রোমান ও গ্রিক শিল্প ঐতিহ্যে দেবতা ও বীরদের যেভাবে উপস্থাপন করা হতো, ধীরে ধীরে যিশুকেও সেভাবেই আঁকা হতে থাকে। মধ্যযুগে বাইজানটাইন সাম্রাজ্যের সময়ে যিশুর একটি নির্দিষ্ট রূপ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে—লম্বা চুল ও দাঁড়ি, গম্ভীর দৃষ্টি, রাজকীয় ব্যক্তিত্ব। এই রূপটি শুধু ধর্মীয় নয়, রাজনৈতিকও ছিল। একজন অপরাজেয় সম্রাটের মতো যিশুকে দেখানো হতো, যিনি পার্থিব ক্ষমতার ঊর্ধ্বে।
আধুনিক কালে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ব্যবহার করে যিশুর সম্ভাব্য চেহারা বোঝার চেষ্টা নতুন মাত্রা পায়। ২০০১ সালে বিবিসির একটি তথ্যচিত্রের জন্য ব্রিটিশ ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ রিচার্ড নিভ প্রথম শতাব্দীর মধ্যপ্রাচ্যের তিনটি ইহুদি খুলি বিশ্লেষণ করে একটি ত্রিমাত্রিক মুখাবয়ব পুনর্গঠন করেন। এটি যিশুর আসল মুখ—এমন দাবি কেউ করেননি, তবে এটি ছিল ঐ সময়কার একজন সাধারণ ইহুদি পুরুষের সম্ভাব্য চেহারা। সেই মুখ ইউরোপীয় যিশুর ছবির সঙ্গে খুব একটা মেলে না। সেখানে দেখা যায় চওড়া নাক, ঘন ভ্রু, ছোট চুল, শ্যামবর্ণ ত্বক এবং শ্রমজীবী মানুষের মতো শক্ত গড়ন।
এই ধারণাকে আরও জোরালো করেন ব্রাজিলীয় ফরেনসিক শিল্পী সিসারো মোরায়েস। তিনি বলেন, যিশু নিশ্চিতভাবেই শ্যামবর্ণের ছিলেন, কারণ ওই অঞ্চলের মানুষের ত্বকের রঙ এমনই। তাঁর মতে, দীর্ঘ সময় সূর্যের নিচে কাটানো মানুষের ত্বক ফর্সা হওয়ার কোনো কারণ নেই। চুলের ক্ষেত্রেও প্রচলিত ধারণার সঙ্গে ঐতিহাসিক বাস্তবতার পার্থক্য স্পষ্ট। বাইবেলের অন্যান্য অংশ ও সমসাময়িক রোমান সমাজের রীতিনীতি থেকে জানা যায়, তখন পুরুষদের মধ্যে ছোট চুল রাখাই ছিল স্বাভাবিক। এমনকি প্রেরিত পল নিজেই লিখেছেন, পুরুষের জন্য লম্বা চুল রাখা গ্লানিকর। ফলে যিশুর লম্বা ঢেউখেলানো চুল আসলে পরবর্তী কালের শিল্পীসুলভ কল্পনা।
তবে যিশুর প্রতিচ্ছবি কেবল ঐতিহাসিক তথ্যের ফল নয়, এটি একটি সাংস্কৃতিক দর্পণও। বিভিন্ন অঞ্চলে খ্রিস্টধর্ম ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে যিশুর চেহারাও সেই অঞ্চলের মানুষের মতো হয়ে উঠেছে। ইথিওপিয়ার গির্জার চিত্রকলায় যিশু কালো, আফ্রিকান বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন। চীনের ম্যাকাও অঞ্চলের শিল্পকর্মে তাঁর চোখ সরু, পোশাক চীনা ধাঁচের। লাতিন আমেরিকায় কোথাও কোথাও তাঁকে দেখা যায় স্থানীয় আদিবাসীদের মতো চেহারায়। এর মাধ্যমে একটি গভীর সামাজিক সত্য প্রকাশ পায়—মানুষ ঈশ্বরকে নিজের মতো করেই কল্পনা করতে চায়।
সমাজবিজ্ঞানী ফ্রান্সিসকো রিবেইরো নেটোর মতে, সমস্যাটা নীল চোখ বা ফর্সা ত্বকের যিশু আঁকায় নয়; সমস্যাটা হলো, যখন এই একটি রূপকেই “স্বাভাবিক” বা “সত্য” বলে ধরে নেওয়া হয়। তখন সেটি ক্ষমতা ও আধিপত্যের প্রতীক হয়ে ওঠে। ইউরোপীয় যিশুর ছবি দীর্ঘদিন ধরে বিশ্বজুড়ে প্রাধান্য পাওয়ার পেছনে ইউরোপের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ঔপনিবেশিক প্রভাব বড় ভূমিকা রেখেছে। ধর্মীয় প্রতীকও যে ক্ষমতার কাঠামোর বাইরে নয়, যিশুর চেহারা তার একটি স্পষ্ট উদাহরণ।
ইতিহাসবিদ আন্দ্রে লিওনার্দো শেভিতারিস মনে করেন, যিশুর “এথনিক” বা জাতিগত চেহারা খোঁজার এই আধুনিক প্রচেষ্টা আসলে ইউরোপীয়করণের দীর্ঘ ইতিহাসের এক ধরনের প্রতিক্রিয়া। মানুষ এখন জানতে চায়, যিশু ছিলেন একজন বাস্তব মানুষ হিসেবে কেমন—একজন শিক্ষক, একজন ইহুদি, একজন মধ্যপ্রাচ্যের মানুষ। এই অনুসন্ধান বিশ্বাসকে খাটো করার জন্য নয়; বরং যিশুকে তাঁর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে ফিরিয়ে আনার প্রয়াস।
শেষ পর্যন্ত প্রশ্নটি হয়তো এই নয় যে যিশু দেখতে ঠিক কেমন ছিলেন। বরং প্রশ্নটি হলো, আমরা কেন তাঁর চেহারা নিয়ে এত আগ্রহী। হয়তো কারণ, চেহারা আমাদের কাছে পরিচয়ের একটি সহজ ভাষা। কিন্তু ইতিহাস আমাদের মনে করিয়ে দেয়, যিশুর গুরুত্ব তাঁর মুখাবয়বে নয়, তাঁর বাণীতে। দুই হাজার বছর পরেও যেসব কথা মানুষকে আলোড়িত করে, তা তাঁর ত্বকের রঙ বা চোখের গড়ন নয়, বরং ন্যায়, করুণা ও ভালোবাসার শিক্ষা। ইতিহাসের চোখে যিশুর “আসল চেহারা” তাই কোনো নির্দিষ্ট মুখ নয়, বরং একজন মানুষের, যিনি তাঁর সময় ও সমাজের ভেতর দাঁড়িয়ে মানবতার কথা বলেছিলেন।
আপনার মতামত জানানঃ