আনিস আলমগীরের গ্রেফতারকে ঘিরে যে প্রশ্নটি সবচেয়ে বেশি ঘুরে ফিরে আসছে, তা হলো—এই ঘটনাটি কি কেবল একটি আইনি প্রক্রিয়া, নাকি এর মধ্য দিয়ে সরকারের সমালোচনা না করার একটি স্পষ্ট বার্তা দেওয়া হলো। একজন সিনিয়র সাংবাদিককে রাতভর গোয়েন্দা পুলিশ কার্যালয়ে আটকে রেখে পরে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মামলায় গ্রেফতার দেখানো নিছক একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখার সুযোগ খুব কমই আছে। কারণ এই গ্রেফতারের প্রেক্ষাপট, অভিযোগের ধরন এবং সাম্প্রতিক সময়ের সামগ্রিক সাংবাদিক নিপীড়নের চিত্র একসঙ্গে মিলিয়ে দেখলে বিষয়টি গভীর উদ্বেগের জন্ম দেয়।
আনিস আলমগীর দীর্ঘদিন ধরে সাংবাদিকতায় যুক্ত একজন পরিচিত মুখ। ২০০৩ সালে ইরাক যুদ্ধ কাভার করার মাধ্যমে তিনি জাতীয়ভাবে পরিচিতি পান। পরবর্তীতে তিনি বিভিন্ন গণমাধ্যমে কাজ করার পাশাপাশি সাংবাদিকতার শিক্ষকতা করেছেন। সাম্প্রতিক সময়ে টেলিভিশন টকশো ও সামাজিক মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকারের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত ও কার্যক্রম নিয়ে তিনি প্রকাশ্যে সমালোচনা করছিলেন। এই সমালোচনাই তাকে আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে আসে এবং একই সঙ্গে সামাজিক মাধ্যমে নানা ধরনের আক্রমণের মুখে ফেলে।
রোববার সন্ধ্যায় ঢাকার ধানমন্ডির একটি জিম থেকে তাকে ডিবি অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়। বলা হয়েছিল, ডিবি প্রধান তার সঙ্গে কথা বলবেন। কিন্তু বাস্তবে তাকে রাতভর আটকে রাখা হয় এবং পরদিন সন্ত্রাসবিরোধী আইনে করা একটি মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। ওই মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে, তিনি সামাজিক মাধ্যম ও টকশোতে বসে ‘নিষিদ্ধ সংগঠন আওয়ামী লীগকে ফিরিয়ে আনার প্রোপাগান্ডা’ চালিয়েছেন। এই অভিযোগের ভাষা ও আইনের প্রয়োগ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বিভিন্ন মহলে। কারণ মত প্রকাশ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষণকে সরাসরি সন্ত্রাসবিরোধী আইনের আওতায় এনে ফেলা হলে, ভবিষ্যতে যেকোনো সমালোচনাই অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়।
এই গ্রেফতারের ঘটনায় মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র উদ্বেগ ও নিন্দা জানিয়েছে। তারা বলেছে, একজন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইন প্রয়োগ আইনটির উদ্দেশ্য ও পরিধির স্পষ্ট অপপ্রয়োগ। সম্পাদক পরিষদও একই সুরে বলেছে, এ ধরনের আচরণ অতীতের স্বৈরাচারী শাসনামলে সাংবাদিকদের ওপর রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের স্মৃতি উসকে দেয়। একজন সাংবাদিককে অভিযোগ ছাড়াই ডেকে নিয়ে আটকে রাখা এবং পরে কঠোর আইনে গ্রেফতার দেখানো কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
এই ঘটনাটি এমন এক সময়ে ঘটলো, যখন অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছে যে সংবাদমাধ্যম ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা সম্পূর্ণভাবে সুরক্ষিত। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে সবাইকে মন খুলে সমালোচনার আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু বাস্তব চিত্র ভিন্ন বলেই মনে করছেন অনেকেই। বিভিন্ন মানবাধিকার ও গণমাধ্যম পর্যবেক্ষক সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের আগস্টের পর থেকে শত শত সাংবাদিক মামলা, গ্রেফতার, হামলা ও হয়রানির শিকার হয়েছেন। শুধু গ্রেফতার নয়, অনেক সাংবাদিকের বিরুদ্ধে হত্যা মামলার মতো গুরুতর অভিযোগও আনা হয়েছে, যেগুলোর পক্ষে বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ নেই বলে অভিযোগ উঠেছে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ তাদের এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, কর্তৃত্ববাদের পতনের পরও গণমাধ্যম পরিস্থিতির কাঙ্ক্ষিত উন্নতি হয়নি। বরং আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, গোয়েন্দা তৎপরতা এবং বিচার ব্যবস্থায় পুরনো কর্তৃত্ববাদী চর্চার ধারাবাহিকতা রয়ে গেছে। এই প্রেক্ষাপটে আনিস আলমগীরের গ্রেফতারকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখার সুযোগ নেই বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
অনেকের মতে, এই গ্রেফতার সাংবাদিক সমাজের জন্য একটি ভয়ের বার্তা তৈরি করছে। বার্তাটি এমন হতে পারে—সরকারের সমালোচনা করলে তার মূল্য দিতে হতে পারে। মানবাধিকার সংগঠক নূর খান লিটন মনে করেন, স্বৈরাচারী আমলে কণ্ঠরোধের জন্য যেসব কৌশল ব্যবহার করা হতো, সেগুলোরই পুনরাবৃত্তি দেখা যাচ্ছে, যেখানে মবের চাপ এবং রাষ্ট্রীয় শক্তির ব্যবহার একসঙ্গে কাজ করছে। এতে করে মত প্রকাশের পরিসর আরও সংকুচিত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
দৈনিক মানবজমিনের সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী এই পরিস্থিতিকে দুর্ভাগ্যজনক বলে মন্তব্য করেছেন। তার ভাষায়, চব্বিশের পরিবর্তনের পর তিনি মত প্রকাশের স্বাধীনতা প্রত্যাশা করেছিলেন, কিন্তু এমন ঘটনা তাকে আতঙ্কিত করছে। তার আশঙ্কা, সরকার প্রধান যদি এ বিষয়ে দৃষ্টি না দেন, তাহলে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যেতে পারে।
অন্যদিকে সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে, যাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে তারা কেউ কেউ ‘স্বৈরাচারের দোসর’ বা ‘পূর্ববর্তী সরকারের সুবিধাভোগী’। কিন্তু সমালোচকরা বলছেন, এই ধরনের ট্যাগিং নিজেই ভিন্নমত দমনের একটি কৌশল। একজন সাংবাদিকের কাজ হলো প্রশ্ন করা, বিশ্লেষণ করা এবং ক্ষমতার জবাবদিহি নিশ্চিত করা। সেই কাজকে যদি রাষ্ট্রদ্রোহ বা সন্ত্রাসের সঙ্গে এক করে দেখা হয়, তাহলে গণতান্ত্রিক সমাজের ভিত্তিই দুর্বল হয়ে পড়ে।
আনিস আলমগীরের গ্রেফতার তাই কেবল একজন ব্যক্তির আইনি সমস্যার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি বাংলাদেশের গণমাধ্যম স্বাধীনতা, বাকস্বাধীনতা এবং রাষ্ট্র ও নাগরিকের সম্পর্ক নিয়ে বড় প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। এই গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে আদৌ কি সমালোচনা না করার একটি বার্তা দেওয়া হলো—এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে অনেকেই অতীতের ভয়ের সংস্কৃতির কথা স্মরণ করছেন। ইতিহাস বলছে, ভয়ের পরিবেশে টেকসই সংস্কার কিংবা গণতান্ত্রিক চর্চা সম্ভব নয়। তাই এই ঘটনাকে কীভাবে মোকাবিলা করা হবে, সেটিই নির্ধারণ করবে ভবিষ্যতে বাংলাদেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতার বাস্তব চিত্র কোন পথে এগোবে।
আপনার মতামত জানানঃ