গত দেড় বছরে বাংলাদেশে মানবাধিকারের আলোচনায় একটি অদ্ভুত কিন্তু ভয়ংকর বাস্তবতা ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হাতে গুম কিংবা “ক্রসফায়ার”-এর মতো ঘটনা আগের সরকারের সময়ের তুলনায় কম শোনা গেলেও, তার জায়গা দখল করছে অন্য রকম কিছু সংকট—অজ্ঞাতনামা লাশ, কারা ও নিরাপত্তা হেফাজতে মৃত্যু এবং মব সন্ত্রাস। মানবাধিকার সংগঠকরা বলছেন, দৃশ্যপট বদলেছে, কিন্তু সহিংসতা ও দায়মুক্তির সংস্কৃতি আদতে কমেনি; শুধু তার ধরন পাল্টেছে।
ঢাকার আশপাশে কিংবা বড় শহরের বাইরে নদী, ডোবা, সড়কের পাশ বা পরিত্যক্ত জায়গা থেকে নিয়মিত অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধার হওয়ার সংবাদ এখন আর বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের হিসাব অনুযায়ী, শুধু অক্টোবর মাসেই এমন লাশের সংখ্যা ছিল ৬৬টি, এর আগের মাসে ৫২টি। অনেক মৃতদেহের শরীরে আঘাতের চিহ্ন, গলাকাটা ক্ষত, হাত-পা বাঁধা কিংবা বস্তাবন্দি অবস্থার মতো আলামত পাওয়া গেছে। পরিচয় অজানা থাকায় এসব মৃত্যুর প্রকৃত কারণ, জড়িত ব্যক্তি কিংবা বিচার—সবকিছুই এক ধরনের অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে।
মানবাধিকার কর্মীদের মতে, অজ্ঞাত লাশ বাড়ার অর্থ কেবল লাশের সংখ্যা বাড়া নয়; এর মানে হলো সমাজে হত্যাকাণ্ড বেড়েছে, অথচ রাষ্ট্র সেই মৃত্যুর দায় নিরূপণ ও জবাবদিহির ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। নূর খান লিটনের ভাষায়, আগে বুলেটবিদ্ধ লাশ পাওয়া যেত, এখন অনেক সময় বুলেটের চিহ্নও নেই—কিন্তু লাশ পাওয়া যাচ্ছে। এই “নতুন শঙ্কা” রাষ্ট্রীয় সহিংসতার বাইরেও এক ধরনের বেপরোয়া সহিংস বাস্তবতার ইঙ্গিত দেয়।
এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কারা ও পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর সংখ্যা। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য বলছে, গত ১৫ মাসে কারা হেফাজতে মারা গেছেন অন্তত ১১২ জন। অন্য মানবাধিকার সংস্থাগুলোর হিসাবেও সংখ্যাটি কাছাকাছি। এসব মৃত্যুর অনেক ক্ষেত্রেই পরিবার অভিযোগ করছে অবহেলা, নির্যাতন বা অস্বাভাবিক পরিস্থিতির কথা। কিন্তু অধিকাংশ ঘটনায় তদন্ত ধীরগতির, আর দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা খুব কমই দৃশ্যমান।
অন্যদিকে মব সন্ত্রাস এমন এক বাস্তবতায় পরিণত হয়েছে যেখানে “জনতার” নামে সহিংসতাকে অনেক সময় সামাজিক ন্যায়বিচার হিসেবে হাজির করা হচ্ছে। মানবাধিকার সাপোর্ট সোসাইটির হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত গণপিটুনি ও মব সহিংসতার ঘটনায় অন্তত ১৪০ জন মারা গেছেন। এর শিকার হয়েছেন চোর বা ছিনতাইকারী বলেও পরিচিত মানুষ যেমন, তেমনি রাজনৈতিক কর্মী, এমনকি সাবেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারাও।
বিশেষ করে ধর্মীয় সংখ্যালঘু, সুফি-মাজারকেন্দ্রিক ধারার মানুষ এবং বাউল শিল্পীদের ওপর হামলার ঘটনা মানবাধিকার পরিস্থিতিকে আরও উদ্বেগজনক করে তুলেছে। একের পর এক মাজারে হামলা, কবরস্থানে ভাঙচুর, এমনকি মৃতদেহ কবর থেকে তুলে আগুনে পোড়ানোর মতো ঘটনা সমাজকে নাড়িয়ে দিয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে বারবার বলা হয়েছে, মাজার ও দরগার নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু কুমিল্লা বা রাজবাড়ীর মতো জায়গায় ধারাবাহিক হামলার ঘটনাগুলো সেই আশ্বাসের সঙ্গে বাস্তবতার ফারাকই বেশি চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়।
মানবাধিকার সংগঠক সাইদুর রহমান মনে করেন, মব এখন একটি কার্যকর হাতিয়ার হয়ে উঠেছে—রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, ধর্মীয় সংখ্যালঘু কিংবা প্রান্তিক সংস্কৃতির মানুষদের ভয় দেখানো ও দমন করার জন্য। আদালত চত্বরে আইনজীবীদের মুখে বাউলদের বিরুদ্ধে হত্যার স্লোগান ওঠার ঘটনাকে তিনি মানবাধিকার পরিস্থিতির নগ্ন প্রতিচ্ছবি হিসেবে দেখেন। তার মতে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নীরবতা কিংবা দেরিতে হস্তক্ষেপ এই সহিংসতাকে এক ধরনের বৈধতা দেয়।
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের সময় মানবাধিকার প্রশ্নে মানুষের প্রত্যাশা ছিল বড়। আগের ১৫ বছরের দমন-পীড়ন, গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার অবসান ঘটবে—এমন আশা অনেকেই করেছিলেন। হিউম্যান রাইটস ওয়াচও বলেছিল, সেই আমলের ভয়াবহতার কিছুটা অবসান ঘটেছে। কিন্তু একই সঙ্গে তারা অভিযোগ তোলে, রাজনৈতিক বিরোধীদের দমনে এখনও নির্বিচার আটক চলছে এবং কাঠামোগত সংস্কার হয়নি।
বাস্তবতা হলো, গুম বা ক্রসফায়ারের মতো “রাষ্ট্রীয় ব্র্যান্ডেড” সহিংসতা কমলেও সমাজে সহিংসতার সামগ্রিক মাত্রা কমেনি। বরং মব সহিংসতা, অজ্ঞাত খুন আর হেফাজতে মৃত্যুর মাধ্যমে এক ধরনের ছায়া-সহিংসতা বিস্তার লাভ করেছে, যেখানে দায় নির্দিষ্ট করা কঠিন, আর বিচার আরও কঠিন।
সরকারের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল অবশ্য বলেন, মানবাধিকার সংস্কারের জন্য অনেক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে—গুম সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সনদে স্বাক্ষর, অতীতের অপরাধের বিচার এবং কিছু প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ তার উদাহরণ। তার যুক্তি, মানবাধিকার একটি সংস্কৃতির বিষয়; এক রাতের মধ্যে তা বদলানো যায় না। পরবর্তী রাজনৈতিক সরকার এগুলোকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিলে ধীরে ধীরে পরিস্থিতির উন্নতি হবে।
কিন্তু মানবাধিকার কর্মীদের প্রশ্ন, সেই ধীরগতির সংস্কারের মাঝে প্রতিদিন পাওয়া লাশগুলোর দায় নেবে কে? মামলা নিয়ে বাণিজ্য, রাজনৈতিক ট্যাগ দিয়ে মানুষকে হেনস্তা, বাড়িঘর দখল বা মবের হাতে বিচার—এসব কি কেবল অতীতের ফ্যাসিবাদী মানসিকতার রেশ, নাকি বর্তমান সময়ের প্রশাসনিক ব্যর্থতাও এতে যুক্ত?
মানুষের নিরাপত্তাবোধ শুধু আইন বা পরিসংখ্যানে নির্ভর করে না; নির্ভর করে দৃশ্যমান ন্যায়বিচার আর জবাবদিহির ওপর। যখন একটি দেশের নাগরিক দেখে, লাশ পাওয়া যাচ্ছে কিন্তু পরিচয় মিলছে না, দোষী ধরা পড়ছে না; যখন দেখে, জনতা কাউকে মারলেও শাস্তি এড়িয়ে যায়—তখন মানবাধিকার কেবল কাগুজে প্রতিশ্রুতি হয়ে থাকে।
বাংলাদেশের বর্তমান মানবাধিকার সংকট তাই একমাত্রিক নয়। এটি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা, সামাজিক সহিংসতা এবং দীর্ঘদিনের দায়মুক্তির সংস্কৃতির মিলিত ফল। গুম কমেছে—এটুকু স্বস্তির খবর হলেও, অজ্ঞাত মৃত্যু আর মব সন্ত্রাস বেড়ে যাওয়ায় সেই স্বস্তি টেকসই হচ্ছে না। মানবাধিকার সংগঠকরা বলছেন, যদি এখনই আইনের শাসন দৃশ্যমানভাবে প্রতিষ্ঠা করা না যায়, তবে সহিংসতার এই নতুন রূপ ভবিষ্যতে আরও গভীর সংকট তৈরি করবে।
শেষ পর্যন্ত প্রশ্নটি একই থেকে যায়—মানুষ কি সত্যিই আগের চেয়ে বেশি নিরাপদ? নাকি সহিংসতা শুধু মুখোশ বদলেছে? উত্তরটা লুকিয়ে আছে সেই অজ্ঞাতনামা লাশগুলোর নীরবতায়, যেগুলো প্রতিদিন কোনো না কোনো নদী, সড়ক বা পরিত্যক্ত জায়গা থেকে তুলে আনা হচ্ছে, কিন্তু যাদের গল্প শোনা যাচ্ছে না।
আপনার মতামত জানানঃ