চট্টগ্রাম বন্দরের সমকালে উন্নয়ন নিয়ে যে বিতর্ক হয়, তা কোনো কেবল অবকাঠামোগত বিতর্ক নয়; এটি দেশের অর্থনীতির এক সমগ্র ধারণাকে নিয়ে প্রশ্ন তোলার চেষ্টা। বন্দর কেবল জাহাজ থামানোর জায়গা নয়—এটি আমাদের বৈদেশিক বাণিজ্য, রপ্তানি প্রতিযোগিতা, লজিস্টিক খরচ, এবং আত্মবিশ্বাসের প্রতিচ্ছবি। আজ যে বাস্তবতা চোখে আসে, তা সহজভাবে বলা যায়—বন্দর যদি দ্রুত ও দক্ষ না হয়, পুরো দেশই লজিস্টিক বাধাপ্রবাহে আটকে যাবে। ২০২৫ সালে চট্টগ্রাম বন্দর প্রায় ৩.৩ মিলিয়ন টিইইউ হ্যান্ডল করেছে—এটি বড় একটি সংখ্যাও বটে; তবু আঞ্চলিক প্রতিযোগীতার মানদণ্ডে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। সিঙ্গাপুর বছরে প্রায় ৩৭ মিলিয়ন টিইইউ হ্যান্ডল করে, কলম্বো ৭.২ মিলিয়ন টিইইউ; তুলনা করলে বোঝা যায়, আমাদের সক্ষমতা কীভাবে সীমাবদ্ধ।
বন্দর কাজ করছে কিন্তু কার্যকারিতা ঠিক নেই—এটাই সমস্যার মূলে থাকা বাস্তবতা। ওভারঅল কার্যক্ষমতা, টার্মিনালে ক্রেন উৎপাদনশীলতা, সার্ভিস আপটাইম—এসব সূচকে এখনই উন্নতি আনতে না পারলে জাহাজ বহির্নোঙরে অপেক্ষা করবে, খরচ বাড়বে এবং রপ্তানিকারীরা প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা হারাবে। প্রাথমিক পরিমাপে আমাদের টার্মিনাল ক্রেন মুভ ১৮–২১ মুভ/ঘণ্টা, যেখানে আন্তর্জাতিক মান ৩৫–৪৫। অন্যদিকে এনসিটির আপটাইম মাত্র ৬০–৭০ শতাংশ—এটা বোঝায় যন্ত্রাংশ, রক্ষণাবেক্ষণ ও অপারেশনাল সংস্কৃতির ত্রুটি কত গভীর। ফলাফলে জাহাজকে ৭ থেকে ১০ দিন বহির্নোঙরে অপেক্ষা করাতে হচ্ছে, প্রতিদিনের অতিরিক্ত খরচ দিনপ্রতি ১২–২০ হাজার ডলার পর্যন্ত উঠছে—এবং বার্ষিক ভিত্তিতে আমাদের ব্যবসায়ীরা ১.৫ থেকে ২ বিলিয়ন ডলারের অতিরিক্ত ব্যয় বহন করছে। কোথায় যে অতিরিক্ত টাকার বোঝা পড়ে? সরাসরি পণ্যের মূল্য ও রপ্তানি প্রতিযোগিতার ওপর।
এই বাস্তবতা সামলাতে সরকার যখন বিদেশি অপারেটর আনার কথা ভাবছে—পিপিপি বা জিটুজি মডেলে—তাহলে সেটি একটি কেবল অর্থনৈতিক পছন্দ নয়, বরং নীতি, স্বাধীনতা, ও নিরাপত্তার প্রশ্নও বটে। বিদেশি অপারেটরের সাথে অংশীদারিত্বের সুবিধা স্পষ্ট—দক্ষ অপারেশন, আধুনিক টেকনোলজি, গ্লোবাল শিপিং নেটওয়ার্কে প্রবেশ, টার্মিনাল উৎপাদনশীলতা বাড়ানো ইত্যাদি। আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা বলে যে নির্ভরযোগ্য অপারেটররা সাধারণত ৩০–৫০ শতাংশ দক্ষতা বাড়াতে পারে; জাহাজ অপেক্ষার সময় কমে; তথ্যভিত্তিক অপারেশন আসে এবং দীর্ঘমেয়াদে রাজস্ব বাড়ে। যদি এনসিটি বা এলসিটিতে বিনিয়োগ করে টার্মিনাল থ্রুপুট বাড়ে, তাহলে পোর্ট ফি, কাস্টমস রেভিনিউ এবং অন্যান্য আয় বাড়বে—এতে সরকারের রাজস্বও বাড়ার কথা।
তবে কোনোরকম চুক্তি স্বাক্ষর করার আগে আমাদের দেখতে হবে—কী দিচ্ছি, কী পাচ্ছি। ‘নিরাপত্তা’ ও ‘সার্বভৌমত্ব’ শব্দগুলো এ ক্ষেত্রে প্রচলিত হলেও বাস্তবে মালিকানা ও কার্যকর নিয়ন্ত্রণের মধ্যে পার্থক্য আছে। যে প্রস্তাবটি নিশ্চয় করবে যে বন্দরের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ বিদেশিদের হাতে চলে যাবে, তা গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু যদি অপারেটরের এখতিয়ার শুধুই টার্মিনাল ম্যানেজমেন্ট সীমাবদ্ধ থাকে, আর বন্দরের মালিকানা, নিরাপত্তা ও কৌশলগত নিয়ন্ত্রণ সরকার ও কর্তৃপক্ষের হাতে থাকে—তাহলে সেটিই বাস্তবে ‘সার্বভৌমত্ব রক্ষা’ এবং কার্যক্ষমতা বাড়ানোর মধ্যে সমান্তরাল সমাধান। অর্থাৎ মালিকানা রাখতে পারি, কিন্তু অপারেশন দক্ষ হতে পারি—এটাই বাস্তবপন্থী ব্যবস্থা।
চুক্তির স্বচ্ছতা নিয়ে জনগণের উদ্বেগ লজিক্যাল। পিপিপি বা জিটুজি চুক্তির ক্ষেত্রে সবকিছু প্রকাশ করা সম্ভব নয়—বাণিজ্যিক গোপনীয়তার কথা আছে—তবু অল্পতম গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জনগণের জানার অধিকার নেই বলেই ভোগ করা যাবে না। দেশ কী পরিমাণ লাভ পাবে? স্থানীয় পেশাজীবীদের ভূমিকা কতটুকু নিশ্চিত করা হবে? অপারেটরের কেপিআই (Key Performance Indicators) কী হবে? মোট বিনিয়োগ কত? রেভিনিউ শেয়ারের হার কেমন হবে? এগুলো জনগণের সামনে স্পষ্ট হওয়া আবশ্যক। কারণ, একে ‘বন্দর উন্নয়ন’ বললেই জনগণের সর্বজনীন স্বার্থ স্পর্শ করে—আর সেই স্বার্থে জনসচেতনতা ও জবাবদিহিতা অত্যন্ত জরুরি।
আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ পাঠ হলো—বন্দর শুধুই ক্রেন বসিয়ে উন্নত হয় না; পুরো সাপ্লাই চেইনকে একসঙ্গে আধুনিক করতে হবে। কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স, আইসিডি গেট, রাস্তাঘাট, রেল সংযোগ, কনটেইনার বহির্গমনের গতিশক্তি—এসব যদি অপরিবর্তিত থাকে, তাহলে টার্মিনালের উন্নয়ন আংশিকই কাজ করবে। কাস্টমস যেখানে ৩০–৪০ ঘণ্টা নেয়, ভিয়েতনামে যেখানে লাগে ১২–১৮ ঘণ্টা—এ পার্থক্য কমালে রপ্তানির গতি বাড়ে। অদক্ষ কাস্টমস ও দুর্বল রুট-নেটওয়ার্ক থাকলে বন্দরের উন্নয়ন অর্ধেকই অপচয়। এ কারণেই বন্দর সংস্কারের একটা আন্তঃসংযোগী নীতি দরকার—টেকনিক্যাল, প্রশাসনিক ও অবকাঠামোগত সমন্বয় না হলে লাভ সীমিত থাকবে।
বন্দর উন্নয়নে ‘পায়রা সিন্ড্রোম’ নামক একটি সতর্কিকাঠি রয়েছে—অর্থাৎ বড় অবকাঠামো বানিয়ে রেখে তা ব্যবহার না হওয়া বা দুর্নীতির শিকার হওয়া। পায়রার মতো উদাহরণ থেকে শিক্ষা নেয়াড়া জরুরি। যারা পায়রা দেখেছে, তারা জানে যে শুধু ইমারত বানালে বা টার্মিনাল বানালেcargo flow নিশ্চিত হবে না; বিশ্বস্ত অপারেটর ও নিশ্চিত বাজার সংযোগ না থাকলে বিনিয়োগ শূন্যের কোঠায় নেমে যেতে পারে। এজন্য অপারেটরের গ্লোবাল নেটওয়ার্ক থেকে শিপিং লাইন নিয়ে আসা, নিজস্ব কার্গো ফ্লো নিশ্চিত থাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এলসিটি ও এনসিটির জন্য প্রস্তাবিত অপারেটররা যদি তাদের নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে নির্দিষ্ট কার্গো ফ্লো আনতে পারেন, তাহলে সেই ঝুঁকি অনেক কমে যাবে।
আবার নিরাপত্তা ও কূটনৈতিক বিবেচনাও আছে। যে দেশের অপারেটরগুলো নির্বাচিত হবে, তাদের সঙ্গে আমাদের কূটনৈতিক সম্পর্ক, ভিসা-প্রবাহ এবং নিরাপত্তা ব্যাক-আপ ইত্যাদি বিষয়গুলোও সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। এক দেশের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা তৈরি করা উচিত নয়—এই কারণে একাধিক দেশীয় বা বৈদেশিক অপারেটরকে অংশীদারি হিসেবে রাখা ভালো; এতে প্রতিযোগিতা থাকবে, বেস্ট প্র্যাকটিস আসবে এবং একক ঝুঁকি কমে।
চট্টগ্রাম বন্দরের রূপান্তর শুধু পোর্ট প্রজেক্ট নয়; এটি দেশের পরবর্তী অর্থনৈতিক রূপান্তর। যদি বন্দরের সক্ষমতা বাড়ে, লজিস্টিক খরচ কমে—আমরা রপ্তানি বাড়িয়ে তুলতে পারি; ফলত রপ্তানি প্রবৃদ্ধি বছরে ৫–৮ বিলিয়ন ডলার বাড়ানোর সম্ভাবনাও সক্রিয় হয়। লজিস্টিক খরচ জিডিপির ০.৮–১.৫ শতাংশ কমলেই দেশের ব্যবসার প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা ব্যাপকভাবে বাড়বে। এছাড়া যদি বাধ্যতামূলকভাবে স্থানীয় পেশাজীবীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যায়, এবং শ্রমিকদের দক্ষতাও উন্নত করা হয়, তাহলে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি ও স্থানীয় মানসিকতাও লাভবান হবে।
তবে শেষ কথা হলো—বন্দর উন্নয়নকে আমরা কোনো রাজনীতিক আবেগ বা ক্ষণস্থায়ী স্লোগানে মোড়াবো না, বরং ডেটা-ভিত্তিক নীতিতে অগ্রসর হতে হবে। সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে দরকার: স্পষ্ট কেপিআই, স্বচ্ছতা, কোর্ট-চallenges-এর সম্ভাব্যতা বিবেচনা, মালিকানা ও নিরাপত্তার সীমারেখা নির্ধারণ, এবং পুরো সাপ্লাই চেইনকে আপগ্রেড করার একটি সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা। যদি এই শর্তগুলো মানা হয়, বিদেশি অংশীদারিত্ব উদ্বৃত্তী নয়—বরং আমাদের বন্দরের সক্ষমতা ও দেশের আর্থিক সম্ভাবনাকে বহুগুণ বাড়াতে পারে। অন্যথায়, অন্ধে অন্ধে চুক্তি করলে সেটি ভবিষ্যতে মূল্যবান সম্পদই নষ্ট করে ফেলতে পারে। তাই বর্তমানে সরকারের হাতে যে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তা শুধু একটি প্রকল্প অনুমোদন নয়—এটি দেশের অর্থনীতির পরবর্তী দশকের পথনির্দেশক সিদ্ধান্ত। তথ্য-উপাত্ত ও স্বচ্ছতার আলোকে, দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিযোগীদের তুলনায় আমরা পিছিয়ে যাইনি সেটা নয়, আমরা এখন সুযোগটা ধরতে পারলে সেই পিছিয়ে পড়া উন্নতিতে পরিণত হবে—বন্দরের আধুনিকায়ন যদি সঠিকভাবে ও জবাবদিহিমূলকভাবে পরিচালিত হয়, তা একদিন দেশকে ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির পথে এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবে।
আপনার মতামত জানানঃ