গাজায় যুদ্ধবিরতির ঘোষণা হয়েছিল বিশ্বকে কিছুটা স্বস্তি দেওয়ার জন্য, কিন্তু বাস্তবে সেই স্বস্তি খুব সামান্যই পৌঁছেছে ফিলিস্তিনিদের কাছে। বিস্ফোরণের শব্দ থেমে নেই, ধোঁয়ার কুন্ডলী থামছে না, আর মানুষের আর্তচিৎকার এখনো প্রতিদিন উঠে আসছে ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে। যুদ্ধবিরতির আড়ালে কীভাবে গণহত্যা চলতে পারে—গাজা সেই প্রশ্নের সবচেয়ে নির্মম উদাহরণ হয়ে উঠেছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল স্পষ্ট ভাষায় বলেছে, গাজায় এখনো গণহত্যা অব্যাহত। তারা জানাচ্ছে, মাত্র সাত সপ্তাহে ইসরাইল ৫০০ বার যুদ্ধবিরতির চুক্তি লঙ্ঘন করেছে। এই সংখ্যা মানবজীবনের মর্মান্তিক ক্ষতির প্রতীক, যা যুদ্ধবিরতির কাগুজে প্রতিশ্রুতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
অ্যামনেস্টির সেক্রেটারি জেনারেল অ্যাগনেস কালামার্ডের বিবৃতি আরও তীব্র। তিনি বলেছেন, ইসরাইল নীতিতে কোনো পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়নি; বরং মানবিক সহায়তার ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি করেছে যা ফিলিস্তিনিদের শারীরিকভাবে নিশ্চিহ্ন করার পরিকল্পনার মতো। খাদ্য, পানি, ওষুধ, জ্বালানি—এসবের ওপর অভূতপূর্ব নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হলে যুদ্ধবিরতি থাকা না থাকা অর্থহীন হয়ে যায়। বাঁচার মৌলিক উপকরণগুলোই যখন বন্ধ থাকে, তখন শান্তির ঘোষণা কেবল কাগজে লেখা অক্ষর হয়ে দাঁড়ায়। গাজার মানুষ যে প্রবল সংকটে আছে, তার গভীরতা বোঝার জন্য এই মন্তব্যই যথেষ্ট।
বৃহস্পতিবার সকালে ইসরাইল আবারও বিমান হামলা চালায় গাজার দক্ষিণ এবং মধ্যাঞ্চলে। শরণার্থী শিবিরগুলোতে আশ্রয় নেওয়া মানুষদের ওপর বোমা পড়ে। বুরেইজ শরণার্থী শিবিরে হামলা চালানো হয়, খান ইউনিসের পূর্বাংশও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গাজার সিভিল ডিফেন্স কর্তৃপক্ষ ঘোষণা করেছে, এই হামলাগুলো যুদ্ধবিরতির শর্তের স্পষ্ট লঙ্ঘন। যুদ্ধবিরতির নামে যে বিরতি, তা বাস্তবে কেবল আন্তর্জাতিক রাজনীতির সুবিধার জন্য; ফিলিস্তিনিদের নিরাপত্তা বা মর্যাদা নিশ্চিত করার কোনো বাস্তব প্রচেষ্টা এতে নেই। শরণার্থী শিবিরে যারা আগে বারবার বাড়ি হারিয়েছেন, তারা যুদ্ধবিরতির দিনও নিরাপদ নন—এ বাস্তবতা এই যুদ্ধবিরতির প্রকৃতি সম্পর্কে অনেক কিছু বলে।
শুধু গাজায় নয়, অধিকৃত পশ্চিম তীরেও ইসরাইল অভিযান চালিয়ে বহু ফিলিস্তিনিকে আটক করছে। ক্বালকিলিয়া, তুবাস, হেবরন, তুলকারেম ও নাবলুস—সব জায়গায় একযোগে অভিযান চলছে। তুবাসে রেড ক্রিসেন্ট জানিয়েছে, অভিযান চলাকালে অন্তত ২৫ জনকে মারধর ও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। যুদ্ধবিরতির সময়েও এধরনের দ্বিমুখী চাপ স্পষ্ট করে দেয়—ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে সামরিক, রাজনৈতিক এবং মনস্তাত্ত্বিক সব ক্ষেত্রেই ইসরাইল তাদের তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। একদিকে গাজায় হামলা, অন্যদিকে পশ্চিম তীরে অভিযান—এ যেন একই কৌশলের দুই রূপ, যা ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠীকে সর্বত্র দুর্বল করে দেওয়ার প্রচেষ্টার নাম।
গাজার ভেতরে যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় ধাপ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। তুরস্ক, কাতার ও মিশর মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কায়রোতে আলোচনা করছে। আলোচনায় গাজায় আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতা বাহিনী মোতায়েন, অস্থায়ী আন্তর্জাতিক প্রশাসন এবং পুনর্গঠন পরিকল্পনা নিয়ে কথা চলছে। প্রথম শোনায় এগুলো যতই আশাব্যঞ্জক মনে হোক না কেন, বাস্তবে এ আলোচনার সাফল্যের সম্ভাবনা কতটা, তা নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে। কারণ, মাঠের বাস্তবতা বলে—ইসরাইল তার সামরিক লক্ষ্য এখনো পূর্ণ করেনি। যে অঞ্চলে হাজার হাজার ভবন ধ্বংস হয়ে গেছে, জল পাইপলাইন ধ্বংস, হাসপাতাল ধ্বংস, বিদ্যুৎ সিস্টেম ধ্বংস—এ অঞ্চলে কোনো আন্তর্জাতিক প্রশাসন কাগজে কলমে কাজ করতে পারে, কিন্তু বাস্তবে তার পূর্বশর্তগুলোই অনুপস্থিত।
ইউরোপীয় কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনের ফেলো মোহাম্মদ শেহাদা বলছেন, ইসরাইল এখনো গাজাকে স্থায়ীভাবে বসবাসের অযোগ্য ধ্বংসস্তূপে পরিণত করার পরিকল্পনা ত্যাগ করেনি। তাঁর মন্তব্য শুধু রাজনৈতিক বিশ্লেষণ নয়—গাজার চারপাশের দৃশ্যই এই কথাকে প্রমাণ করে। শিশুদের স্কুল ধ্বংস হয়ে গেছে, হাসপাতালের সিঁড়ি বেয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে শত শত মানুষ, এবং বেসামরিক ভবনগুলো হামলার প্রথম লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে। ইসরাইল দাবি করে হামাসকে নির্মূল না করা পর্যন্ত তারা থামবে না, কিন্তু বাস্তবে হামাসের চেয়ে বেশি নিহত হয়েছে সাধারণ মানুষ—শিশু, নারী, বৃদ্ধ। কোনো সন্ত্রাসী সংগঠন নির্মূলের নামে যখন হাজারো নিরীহ মানুষ মরছে, তখন সেটি যুদ্ধ নয়; এটি লক্ষ্যবিদ্ধ ধ্বংসযজ্ঞ।
দক্ষিণ গাজার ইয়েলো লাইন অঞ্চলে টানেলের ভেতরে কয়েক ডজন হামাস যোদ্ধা আটকে আছে—ইসরাইল বলে অন্তত ২০ জনকে তারা হত্যা করেছে। হামাস বলছে এটি যুদ্ধবিরতির লঙ্ঘন। এই টানেল পরিস্থিতি যুদ্ধবিরতির ভবিষ্যৎকে বড় ঝুঁকিতে ফেলেছে। যুদ্ধবিরতি যে কাগজে আছে, বাস্তবে নেই—গাজায় প্রতিটি নতুন হামলা, প্রতিটি নতুন অভিযান সেটাই প্রমাণ করছে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সতর্ক করেছে—যুদ্ধবিরতি যেন ইসরাইলের নৃশংসতার আড়াল না হয়। বিশ্বশক্তিগুলো যখন পররাষ্ট্রনীতির হিসাবমতে সমীকরণ সাজায়, তখন মানবিক সংকটের গুরুত্ব যেন হারিয়ে যায়। রাজনৈতিক জোট, সামরিক চুক্তি, জ্বালানি বাণিজ্য—এসবের কাছে মানুষের জীবন যেন খুবই তুচ্ছ। কিন্তু গাজায় একেকটি মৃত্যুই একটি পরিবারকে চিরতরে ভেঙে দেয়, একটি প্রজন্মকে মানসিকভাবে ধ্বংস করে দেয়, এবং একটি জাতিকে আরও বেশি অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেয়।
যুদ্ধবিরতির ঘোষণায় বোমা পড়ে না কয়েক ঘণ্টা, কিন্তু খাবার আসে না, পানি আসে না, ওষুধ আসে না। একজন বাবা খাবারের লাইনে দাঁড়িয়ে দিনের পর দিন ফিরে আসছেন খালি হাতে। একজন মা তার শিশুকে দুধ পান করাতে পারছেন না। একজন রোগী অপারেশন থিয়েটারের আলো নিভে যাওয়ায় চিকিৎসা পাচ্ছেন না। যুদ্ধবিরতির প্রকৃত মূল্য তারা দিচ্ছেন, যারা দিনের পর দিন ক্ষুধা–তৃষ্ণায় মৃত্যুর মুখোমুখি।
গাজায় এখনকার যুদ্ধবিরতি এক ধরনের ছদ্ম-শান্তি, যেখানে মৃত্যুর ধরন শুধু পরিবর্তিত হয়েছে—বোমায় নয়, ক্ষুধায়; গুলিতে নয়, পানির অভাবে; ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়ে নয়, চিকিৎসা না পেয়ে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যদি সত্যিই শান্তি চায়, তবে ইসরাইলের ওপর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি করতে হবে, যাতে অবরোধ উঠে যায়, মানবিক সহায়তা পূর্ণমাত্রায় ঢোকে, এবং গাজার মানুষ বাঁচার অধিকার পায়। যুদ্ধবিরতির ঘোষণা মানুষের জীবন বাঁচায় না। বাঁচায় খাবার, পানি, ওষুধ, আশ্রয়, নিরাপত্তা—আর এসবই গাজায় সবচেয়ে বেশি অনুপস্থিত।
গাজার বর্তমান পরিস্থিতি আমাদের দেখায়—যুদ্ধবিরতি কতটা সহজে যুদ্ধের আড়াল হয়ে উঠতে পারে। যদি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় চোখ বন্ধ করে থাকে, তবে যুদ্ধবিরতি কেবল সময় কিনে দেয়, জীবন নয়। গাজা এখন এমন এক বাস্তবতার মধ্যে দাঁড়িয়ে যেখানে মৃত্যু একটি দৈনন্দিন ঘটনা, আর বেঁচে থাকা এক অমানুষিক সংগ্রাম। এই যুদ্ধবিরতির ফাঁকেই নতুন হামলা, নতুন আটক অভিযান, নতুন অবরোধ—সব একসঙ্গে চলতে থাকে, যেন যুদ্ধ আর শান্তির সীমারেখা মুছে গেছে।
গাজা আজ মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে দুঃস্বপ্নের একটি ভূখণ্ড। যুদ্ধবিরতির আড়ালে যদি গণহত্যা চলতেই থাকে, যদি শিশুরা ক্ষুধায় মারা যায়, যদি মানুষ পানি না পায়, যদি শরণার্থী শিবিরে বোমা পড়ে—তবে পৃথিবী কত বড় হওয়া সত্ত্বেও কোথাও নিরাপদ আশ্রয় থাকে না একজন ফিলিস্তিনির জন্য। যুদ্ধবিরতি তখন শান্তির সেতু নয়, বরং ধ্বংসের পথে সাময়িক বিরতি মাত্র। গাজার মানুষ যে অন্ধকারে দিন কাটাচ্ছে, তাতে আলো ফিরিয়ে আনতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এখনই সিদ্ধান্তমূলক ভূমিকা প্রয়োজন, নইলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ইতিহাসকে ক্ষমা করবে না।
আপনার মতামত জানানঃ