বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা এক অনিবার্য আলোচনার বিষয়, কিন্তু সাম্প্রতিক সুপ্রিম কোর্টের রায় এই আলোচনাকে নতুন এক মোড় দিয়েছে। দীর্ঘ চৌদ্দ বছর ধরে বাতিল থাকা এই ব্যবস্থাকে আবারও সংবিধানে ফিরিয়ে দিয়ে সর্বোচ্চ আদালত যেন দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য এক নতুন প্রেক্ষাপট রচনা করল। আদালতের রায় অনুযায়ী, চতুর্দশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে পুনর্বহাল হওয়া এই ব্যবস্থা কার্যকর হবে, যদিও আসন্ন নির্বাচন অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনেই অনুষ্ঠিত হবে বলে আগেই জানিয়েছেন আইনজীবীরা। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে ঘিরে আদালতের এই সিদ্ধান্ত শুধু একটি সাংবিধানিক বিষয় নয়—এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক আস্থাহীনতা, নির্বাচন নিয়ে দীর্ঘদিনের বিতর্ক এবং রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক অবিশ্বাসের গভীর প্রতিচ্ছবি।
এই ব্যবস্থার রেশ শুরু হয়েছিল এরশাদবিরোধী আন্দোলনের পর, যখন দেশ গণতন্ত্রে ফেরার পথে নতুন এক আস্থাসংকটে পড়ে। ১৯৯১ সালের নির্বাচন বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী এক কাঠামোর অধীনে অনুষ্ঠিত হলেও ১৯৯৪ সালের মাগুরা উপনির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ সারা দেশে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। তখনই তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে দাবির কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে আসে—দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৬ সালে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে জন্ম হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার। এই সংশোধনীতে নির্ধারণ করা হয়, নির্বাচিত সরকারের মেয়াদ শেষে তিন মাসের জন্য একটি নিরপেক্ষ ও অরাজনৈতিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করবে এবং তার প্রধান কাজ হবে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করা। এই ব্যবস্থার অধীনে ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের দুটি জাতীয় নির্বাচন তুলনামূলক গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয়, এবং এই দুটি নির্বাচনেই শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের নজির তৈরি হয়।
তবে রাজনৈতিক বাস্তবতা কখনই স্থির থাকে না। ২০০৬ সালে এসে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের পদ্ধতি, প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ নিয়ে বড় ধরনের বিরোধ সৃষ্টি হয়। প্রধান দলগুলোর মধ্যে আস্থাহীনতা এতটাই চরমে পৌঁছায় যে দেশে রাজনৈতিক অচলাবস্থা তৈরি হয় এবং শেষ পর্যন্ত জরুরি অবস্থা জারি হয়। সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে এবং দুই বছরের বেশি সময় ক্ষমতায় থেকে নানা সাংবিধানিক বিতর্ক তৈরি করে। ১/১১ নামে পরিচিত এই সময়টিকে অনেকেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক অন্ধকার অধ্যায় বলেন, কারণ একটি অনির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা যাওয়ার ফলে রাষ্ট্রের নীতি–নির্ধারণী প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা কমে যায়, আর গণতান্ত্রিক ধারাও দীর্ঘসময় বন্ধ থাকে।
এই পটভূমিতে ২০১১ সালে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ত্রয়োদশ সংশোধনীকে বাতিল ঘোষণা করে। বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ বলেছিলেন, এই ব্যবস্থা সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং অগণতান্ত্রিক। এরপর পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা স্থায়ীভাবে বিলোপ করা হয়। এর পরের তিনটি জাতীয় নির্বাচন—২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪—ক্ষমতাসীন দলের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়, যার প্রতিটিই নানাভাবে বিতর্কিত হয়। বিরোধী দলগুলোর অভিযোগ ছিল একই—দলীয় সরকারের অধীনে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিরপেক্ষ নয়, ভোটাররা নিরাপদভাবে ভোট দিতে পারে না, আর নির্বাচনী মাঠে সমান সুযোগ পাওয়া যায় না। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলোরও কেউ কেউ প্রশ্ন তোলেন এসব নির্বাচনের স্বচ্ছতা ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে।
এই প্রেক্ষাপটে ২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পাল্টে যায়, ক্ষমতাসীন দল ক্ষমতাচ্যুত হয়, এবং আবারও সামনে আসে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার প্রশ্ন। দেশের বিরোধী দলগুলোসহ অনেক নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি দাবি করেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। সর্বোচ্চ আদালতের সামনে পুনর্বিবেচনা আবেদনের মাধ্যমে বিষয়টি আবারও ওঠে। আপিল বিভাগের সাত বিচারপতির বেঞ্চ ২১শে অক্টোবর শুনানি শুরু করার পর ১১ই নভেম্বর শুনানি শেষ করে এবং অবশেষে রায় ঘোষণা করেন—সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহাল হবে।
রায়ের তাৎপর্য এখানে শুধু সাংবিধানিক নয়, বরং গভীর রাজনৈতিক। এটি একদিকে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের প্রতি জনগণের আস্থা পুনর্গঠনের প্রচেষ্টা, অন্যদিকে রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক সন্দেহ দূরীকরণের পথও হতে পারে। আদালতের এই রায় নির্বাচন কমিশনের ওপরও নতুন দায়িত্ব চাপায়—আসন্ন চতুর্দশ সংসদ নির্বাচনের আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য কাঠামো প্রস্তুত করা, যাতে সুষ্ঠু প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা যায়। তবে আইনজীবীদের মতে, সময় খুবই কম হওয়ায় আসন্ন নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নয়, বরং বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হবে। ফলে রায়টি কার্যকর হতে সময় লাগবে, এবং এর রাজনৈতিক প্রভাবে আগামী কয়েক বছর ধরে দেশের নির্বাচনী রাজনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসতে পারে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা কেন এত জনপ্রিয় হয়েছিল, তার কারণ খুঁজলে দেখা যায়—বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে গভীর অস্থিরতা ও সন্দেহ প্রবণতা রয়েছে। বহু বছর ধরে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। প্রশাসন, পুলিশ, মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের নিরপেক্ষতা নিয়ে বিরোধী দলের অভিযোগ সবসময়ই ছিল। ফলে একটি নিরপেক্ষ, অরাজনৈতিক, তিন মাসের একটি প্রশাসনিক কাঠামো জনগণের কাছে নিরাপদ মনে হয়েছিল। তবে এই ব্যবস্থার মাঝেও বিতর্ক ছিল, বিশেষ করে ১/১১-এর অভিজ্ঞতা দেখিয়েছে যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নেতৃত্বে সামরিক প্রভাব প্রবেশের সম্ভাবনাও অস্বীকার করা যায় না। তবুও গণতন্ত্রের দিকে এগোতে হলে সুষ্ঠু নির্বাচন অনিবার্য—এ ধারণা থেকেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে অনেকেই প্রয়োজনীয় মন্দ হিসেবে দেখেন।
আদালতের সাম্প্রতিক রায় রাজনৈতিক দলগুলোর সামনে একটি নতুন চ্যালেঞ্জও তৈরি করেছে। একদিকে দলগুলোকে এখন নতুন কাঠামোর অধীনে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে হবে, অন্যদিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গঠন পদ্ধতি, প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচন, প্রশাসনিক ক্ষমতা সীমাবদ্ধ রাখা—এসব নিয়ে আবারও রাজনৈতিক আলোচনা শুরু হতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এতটাই সংঘাতপূর্ণ যে যেকোনো নির্বাচন যদি প্রশ্নবিদ্ধ হয়, তবে তা দেশের স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে। তাই আদালতের রায় শুধু একটি সাংবিধানিক ব্যাখ্যা নয়, বরং এটি দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ পুনর্গঠনেরও একটি সুযোগ।
এই রায়ের ফলে জনগণের মধ্যে নতুন ধরনের আশাবাদ তৈরি হয়েছে যে দেশ আবারও একধরনের নির্বাচনী সংস্কারে প্রবেশ করতে চলেছে। তবে বাস্তবতা হলো, এই পরিবর্তন রাতারাতি কার্যকর হবে না। নির্বাচন সামনে, রাজনৈতিক উত্তেজনা চরমে, এবং আইনগত কাঠামো পুরোপুরি প্রস্তুত নয়—এসব কারণে রায়টি দীর্ঘমেয়াদে বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। এটি ভবিষ্যতের জন্য নতুন পথপ্রদর্শক হতে পারে, যেখানে দলীয় সরকারের বদলে একটি নিরপেক্ষ সরকারের হাতে নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব থাকবে, আর জনগণও নির্ভয়ে ভোট দিতে পারবে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বহুবার আদালত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে, কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহালের এই রায়কে অনেকেই একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা মনে করছেন। এটি একদিকে রাজনৈতিক দলগুলোকে নতুন করে আলোচনার টেবিলে বসতে বাধ্য করবে, অন্যদিকে নির্বাচন কমিশনকেও আরও স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার দিকে মনোযোগী হতে বাধ্য করবে। আর সবশেষে, সবচেয়ে বড় লাভবান হবে সাধারণ ভোটাররা—যারা বছরের পর বছর ধরে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের আশায় ছিলেন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নিখুঁত নয়, এর দুর্বলতা রয়েছে; কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় এটি নির্বাচনী আস্থা পুনরুদ্ধারের একটি কার্যকর কাঠামো হতে পারে। আদালতের রায় সেই পথই খুলে দিয়েছে। এখন দেখার বিষয়, রাজনৈতিক দলগুলো কি এই সুযোগকে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার একটি মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করবে, নাকি নতুন বিতর্কের জন্ম দেবে। তবে একটি বিষয় স্পষ্ট—নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবি আর শুধুই রাজনৈতিক স্লোগান নয়; এটি এখন দেশের সর্বোচ্চ আদালতের অনুমোদন পাওয়া একটি সাংবিধানিক সত্য। এটি বাংলাদেশের গণতন্ত্রের জন্য একটি নতুন সূচনা, আর সামনে কী অপেক্ষা করছে, তা নির্ভর করছে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রজ্ঞা, পরিমিতিবোধ এবং সদিচ্ছার ওপর।
আপনার মতামত জানানঃ