বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরেই একটি ঘনিষ্ঠ ও পরস্পরনির্ভরশীল অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। দুই দেশের ভৌগোলিক সন্নিকটতা, ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা, মুক্তিযুদ্ধের মিত্রতা, বাণিজ্যিক নির্ভরতা, সীমান্ত ব্যবস্থাপনা, নদী–পানিবণ্টনসহ নানা ইস্যু এই সম্পর্ককে একই সঙ্গে জটিল ও অপরিহার্য করে তুলেছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে দিল্লিতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবস্থান এবং তাঁর বিভিন্ন ভারতীয় মূলধারার গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার বা বক্তব্য দেওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে যে কূটনৈতিক টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়েছে, তা দুই দেশের পারস্পরিক আস্থায় নতুন প্রশ্ন তুলেছে। ঢাকা থেকে ভারতীয় উপহাইকমিশনার পবন ভাদেকে তলব করে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক উদ্বেগ জানানোর মধ্য দিয়ে বিষয়টি আরো গুরুত্ব ও স্পষ্টতা লাভ করেছে। বাংলাদেশ সরকারের বক্তব্য অনুযায়ী, ভারতের রাজধানীতে অবস্থানরত একজন পলাতক আসামিকে—যিনি মানবতাবিরোধী অপরাধে বিচারের মুখোমুখি—মূলধারার গণমাধ্যমে বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া আন্তঃরাষ্ট্রীয় নীতি ও কূটনৈতিক শিষ্টাচারের পরিপন্থী। এই অভিযোগ শুধু রাজনৈতিক নয়, বরং নিরাপত্তা, কূটনীতি এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার দিক থেকেও এর গভীরতা রয়েছে।
ঢাকার ভাষ্যমতে, যাঁকে বাংলাদেশ আশ্রয়প্রাপ্ত পলাতক অপরাধী হিসেবে দেখছে, তাঁর মাধ্যমে ভারতীয় মিডিয়ায় বাংলাদেশবিরোধী বক্তব্য প্রচারিত হওয়া দুই দেশের সম্পর্কের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। বাংলাদেশ দাবি করছে, এসব বক্তব্য শুধু রাজনৈতিক অপপ্রচার নয়, বরং দেশের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতার ওপর হুমকি সৃষ্টি করতে পারে এবং সন্ত্রাসী তৎপরতা কিংবা উসকানিমূলক কার্যক্রমকে উৎসাহিত করতে পারে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ভারতীয় কূটনীতিককে জানানো হয়েছে, এ ধরনের প্ল্যাটফর্ম প্রদান কেবল বিশ্বাসের ঘাটতি সৃষ্টি করে না, ভবিষ্যতের দ্বিপক্ষীয় আলাপ–আলোচনার ওপরও ছায়া ফেলতে পারে। রাষ্ট্রগুলোর মধ্যকার সম্পর্ক সাধারণত পারস্পরিক শ্রদ্ধা, অভিন্ন স্বার্থ এবং অভ্যন্তরীণ বিষয়ে সংবেদনশীলতা বোঝার ওপর দাঁড়িয়ে থাকে। তাই ঢাকার যুক্তি হলো—একজন পলাতক রাজনৈতিক ব্যক্তিকে এমনভাবে প্রচারিত করা যেন ভারত তাকে রাজনৈতিক আশ্রয় বা সমর্থন দিচ্ছে—এটি কূটনৈতিক নীতির পরিপন্থী একটি প্র্যাকটিস হিসেবে দেখা যেতে পারে।
ভারত অবশ্য এ ধরনের অভিযোগ এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে ব্যাখ্যা করেনি। তবে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক বাস্তবতায় ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, গণমাধ্যম কাঠামো এবং নীতি পরিকল্পনায় বিভিন্ন অবস্থান ও মতামত থাকে। এমনকি গণমাধ্যম অনেক ক্ষেত্রে সরকারি অবস্থান নয়; বরং স্বতন্ত্র বেসরকারি উদ্যোগের অংশ। কিন্তু ঢাকার আপত্তি মূলত এই জায়গায় যে, একজন রাজনৈতিকভাবে বিতর্কিত এবং আইনগতভাবে পলাতক ব্যক্তি ভারতের কেন্দ্রে অবস্থান করছেন এবং সেখান থেকেই ধারাবাহিকভাবে সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন, যা ভারত সরকার চাইলে নিয়ন্ত্রণ করতে পারত কিংবা অন্তত এমন কার্যক্রম যাতে কূটনৈতিকভাবে বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে, তা এড়াতে ভূমিকা রাখতে পারত। বাংলাদেশ মনে করছে, ভারত এ বিষয়ে নিষ্ক্রিয় বা নীরব ভূমিকা পালন করায় ঘটনাটি এক ধরনের রাজনৈতিক বার্তা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিষয়টি যদি শুধুই মানবিক আশ্রয় বা নিরাপত্তাজনিত কারণে দিল্লিতে অবস্থানের প্রশ্ন হতো, তবে হয়তো এত আলোচনার অবকাশ থাকত না। কিন্তু ভারতের মূলধারার জাতীয় টেলিভিশন বা দৈনিকে ধারাবাহিক সাক্ষাৎকারের সুযোগ পাওয়াকে বাংলাদেশ যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে।
মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের প্রশ্নটি বাংলাদেশে দীর্ঘ রাজনৈতিক আলোচনার অংশ। দেশে যে ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়েছে, তার বিচার ও রায় নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে বিভিন্ন মত থাকলেও দেশের অভ্যন্তরে প্রচুর জনগণের সমর্থন রয়েছে। তাই বর্তমানে যাকে বাংলাদেশ পলাতক বলে অভিহিত করছে, তাঁকে নিয়ে ভারতীয় মিডিয়ায় প্রচার পাওয়াকে জনগণের একাংশও নেতিবাচক চোখে দেখছে। এই পরিস্থিতিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আনুষ্ঠানিক অবস্থান জনগণকেও কিছুটা আশ্বস্ত করার প্রয়াস বলে মনে করা যেতে পারে। গণমাধ্যমে বিষয়টির প্রকাশের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখা যাচ্ছে, অনেকেই বিষয়টিকে জাতীয় মর্যাদা ও সার্বভৌমত্বের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বলে মনে করছেন।
এদিকে দিল্লির রাজনৈতিক অঙ্গনেও শেখ হাসিনার উপস্থিতি নানামাত্রিক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। ভারত দক্ষিণ এশীয় ভূরাজনীতিতে যে প্রভাব বিস্তার করে থাকে, তার জন্য প্রতিবেশী দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট সম্পর্কে ভারতের সংবেদনশীল থাকা জরুরি। বিশেষ করে বাংলাদেশ–ভারত সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ পর্যায়ে পৌঁছানোর পর সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দুদেশই কৌশলগত সহযোগিতা বাড়িয়েছে। সীমান্ত ব্যবস্থাপনা, প্রতিরক্ষা সহযোগিতা, বাণিজ্যিক যোগাযোগ, আঞ্চলিক পরিবহন চুক্তি, এমনকি বিদ্যুৎ–জ্বালানি খাতে গভীর পারস্পরিক বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এরই মধ্যে যদি রাজনৈতিক আশ্রয় বা রাজনৈতিক বক্তব্যের কারণে কোনো পক্ষ ক্ষুব্ধ হয়, তবে সেটি এই সহযোগিতাগুলোর ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। বাংলাদেশ তাই স্পষ্টভাবে জানিয়েছে যে তারা চাইছে না ভারতের সঙ্গে কোনো ভুল বোঝাবুঝি বা দূরত্ব তৈরি হোক, বরং বিষয়টির সমাধান দ্রুত হোক।
একই সময়ে এটি সত্য যে আঞ্চলিক রাজনীতিতে মিডিয়া এখন একটি বৃহৎ ও প্রভাবশালী হাতিয়ার। ভারতীয় মূলধারার মিডিয়ার প্রভাব বাংলাদেশসহ প্রতিবেশী দেশগুলোর জনমত গঠনে গভীর প্রভাব ফেলে। তাই কোনো প্রতিবেশী দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে ভারতীয় মিডিয়ার অতিরিক্ত মনোযোগ বা কোনো পলাতক নেতার বক্তব্যকে প্রাধান্য দেওয়া অস্থিরতা তৈরি করতে পারে। ঢাকা এ কারণে বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন যে এসব প্রচার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে সংবেদনশীল অবস্থায় ঠেলে দিতে পারে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এ ধরনের বক্তব্য কোনো অপছন্দনীয় রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে নয়, বরং রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে উসকানিমূলক মতামত ছড়াচ্ছে, যা কূটনৈতিকভাবে বন্ধুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রের কাছে অগ্রহণযোগ্য।
দুই দেশের জনগোষ্ঠীর সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক মেলবন্ধন শতাব্দীর। সীমান্তের দুই পাশে লাখো মানুষের পারিবারিক সম্পৃক্ততা রয়েছে। ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক কেবল সরকারি স্তরেই সীমাবদ্ধ নয়, মানুষের জীবনের সঙ্গে যুক্ত। অথচ রাজনৈতিক উত্তাপ বাড়লে এই মানবিক সম্পর্কই অপ্রত্যাশিত চাপের মুখে পড়ে। রাজনৈতিক সম্পর্কের তারতম্য ব্যবসা-বাণিজ্য, ভিসা সুবিধা, অভিবাসী শ্রমিকের চলাচল, পর্যটন, এমনকি শিক্ষার্থী বিনিময়ের ক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশ এই দিকটিও মাথায় রেখে বিষয়টি শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধান করতে পারে এমন ইঙ্গিত দিয়েছে।
তলব কূটনীতি কূটনৈতিক জগতের একটি প্রচলিত ধাপ। সাধারণত যখন কোনো রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের কোনো আচরণে অসন্তুষ্ট হয়, তখন সে ঐ দেশের কূটনীতিককে তলব করে তার অবস্থান স্পষ্ট জানিয়ে দেয়। এটি অভিযোগ নয়; বরং সম্পর্ক রক্ষার কৌশল। বাংলাদেশের এই অবস্থান মূলত একটি বার্তা — ভারত যেন বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখে এবং বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের স্বার্থে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে। কারণ, বাংলাদেশের কথায়, “অত্যন্ত স্পর্শকাতর” এই রাজনৈতিক ইস্যুটি দ্রুত সমাধান করা না হলে তা ভুল ব্যাখ্যা তৈরি করতে পারে। এখানেই বাংলাদেশের প্রত্যাশা যে নয়াদিল্লি বিষয়টিকে বন্ধুত্বপূর্ণ দৃষ্টিতে বিবেচনা করবে।
তবে এটাও সত্য, ভারতীয় গণতন্ত্রে গণমাধ্যম স্বাধীন এবং সরকার অনেক সময় সরাসরি কোনো সাংবাদিক বা মিডিয়া প্রতিষ্ঠানের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে পারে না। এ ক্ষেত্রে যদি ভারতের পক্ষ থেকে এমন ব্যাখ্যা আসে যে গণমাধ্যম স্বাধীন—তাহলে সেটি আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হবে। কিন্তু বাংলাদেশের উদ্বেগ বিষয়টিকে অন্য একটি কূটনৈতিক মাত্রায় নিয়ে যায়—যদি ব্যক্তি ভারতের নিরাপত্তায় থাকেন, তবে তাঁর নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা, গতিবিধি বা প্রচার কার্যক্রমও সংবেদনশীল বিবেচনার আওতায় পড়ে। তাই ভারত চাইলে মানবিক কারণে দিল্লিতে অবস্থানের সুযোগ দিতে পারে, কিন্তু প্রকাশ্য রাজনৈতিক সক্রিয়তা সীমিত করতে পারে—এমনটাই ঢাকার অবস্থান।
বাংলাদেশ–ভারত সম্পর্কের ইতিহাসে নানা উত্থান-পতন থাকলেও দুই দেশই বুঝে এসেছে যে পরস্পরকে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। আঞ্চলিক শান্তি, বাণিজ্য, নিরাপত্তা এবং সীমান্ত ব্যবস্থাপনার বিষয়গুলোতে সহযোগিতা ছাড়া কোনো রাষ্ট্রই একা সফল হতে পারে না। তাই এখনকার পরিস্থিতি দুই দেশের নীতিনির্ধারকদের জন্য একটি পরীক্ষা বলা চলে—কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তির মিডিয়ায় বক্তব্য দেওয়া কি দুই দেশের দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্ককে প্রভাবিত করবে, নাকি কৌশলগত স্বার্থে দুই দেশই দ্রুত সমাধানের পথ খুঁজে নেবে।
বর্তমান ভূরাজনৈতিক বাস্তবতাও বিবেচনায় নিতে হয়। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তির উত্থান, বৈশ্বিক শক্তি পুনর্বিন্যাস, বাণিজ্য ও নিরাপত্তা সহযোগিতায় চীনের ভূমিকা বৃদ্ধি, যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত অগ্রাধিকার—সব মিলিয়ে বাংলাদেশ–ভারত সম্পর্ক শুধু দ্বিপাক্ষিক নয়, বৃহত্তর ভূ-রাজনৈতিক পরিমণ্ডলেও গুরুত্বপূর্ণ। তাই সম্পর্কের মধ্যে সামান্য বিচ্যুতিও অন্য শক্তির জন্য সুযোগ তৈরি করতে পারে। বাংলাদেশ ও ভারতের নীতিনির্ধারকরা এই বাস্তবতা জানেন বলেই দুই দেশের সম্পর্ক দীর্ঘদিন ধরে একটি নির্দিষ্ট স্থিতি ধরে রাখতে পেরেছে, যদিও মাঝে মাঝে ছোটখাটো উত্তেজনা দেখা দিয়েছে।
সবশেষে বলা যায়, দিল্লিতে শেখ হাসিনার বক্তব্য প্রচারের বিষয়টি শুধু একটি কূটনৈতিক অস্বস্তি নয়; বরং এটি দুই দেশের সম্পর্কের সংবেদনশীল পরিধিকে প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশ চাইছে ভারত তাদের উদ্বেগকে মূল্য দিক এবং দ্রুত বিষয়টির সমাধান করুক। অন্যদিকে ভারতও সম্ভবত বুঝতে পারবে, প্রতিবেশীর সংবেদনশীলতা অগ্রাহ্য করলে পরবর্তীতে বড় ধরণের কূটনৈতিক সংকট তৈরি হতে পারে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এই বার্তা দুই দেশের সম্পর্কের টেকসই ভবিষ্যতের জন্য একটি সতর্কচিহ্ন। সামনের দিনগুলোতে দুই দেশের মধ্যকার আলোচনাই বলে দেবে এই অস্বস্তির দ্রুত অবসান ঘটবে, নাকি এটি নতুন জটিলতার দ্বার উন্মোচন করবে। তবে দক্ষিণ এশিয়ার এই দুই ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সম্পর্কের ইতিহাস বলছে—সমস্যা যত বড়ই হোক, আলোচনার পথই একমাত্র সমাধান।
আপনার মতামত জানানঃ