
ইরানের রাজধানী তেহরান—একসময় বরফঢাকা পাহাড় আর সরু নদীর জলধারায় ঘেরা শহর—এখন দাঁড়িয়ে আছে এমন এক সঙ্কটের দুয়ারে, যেখানে কল খুললে পানি আসবে কি না, সেটাই হয়ে গেছে এক ধরনের লটারি। রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদমাধ্যমই সতর্ক সাইরেন বাজিয়ে জানিয়েছে, শহরের প্রধান জলাধার আমির কাবির বাঁধে এখন যতটুকু পানি আছে, তা প্রায় এক কোটি মানুষের প্রয়োজন মিটিয়ে সর্বোচ্চ দুই সপ্তাহ চলতে পারে। এক বছর আগেও যেখানে ৮৬ মিলিয়ন ঘনমিটার পানি ছিল, সেখানে এখন আছে মাত্র ১৪ মিলিয়ন ঘনমিটার। হিসেবটা নির্মম, আর সংখ্যার পেছনের বাস্তবতা আরও নির্মম—একটি মহানগরী ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে তার ‘ডে জিরো’র দিকে।
এই ‘ডে জিরো’ আসলে কেমন একটি দিন হতে পারে, তা কল্পনা করতে খুব বেশি ভাবনার দরকার নেই। তেহরানের মানুষরা ইতোমধ্যে সেই ভবিষ্যৎকে হাতের নাগালে অনুভব করছেন। বহু তলাবিশিষ্ট অ্যাপার্টমেন্টে বাস করা এক নারী বিবিসিকে বলেছেন, পানি উৎপাদন কমে যাওয়ায় আর পাইপলাইনের চাপ নেমে যাওয়ায় তাদের ভবনের ট্যাংক মুহূর্তের মধ্যে খালি হয়ে যায়। কখনো আবার একদম পানি ওঠেই না। তখন বিদ্যুৎ গেলেই ইন্টারনেট বন্ধ, লিফট বন্ধ, উপরে ওঠা-নামা, বাজার করা—সবকিছু একসঙ্গে অসহনীয় হয়ে ওঠে। গরমের দমচাপা দিনে, যখন তীব্র বায়ুদূষণ শহরকে ঘিরে রাখে, তখন ঘরে অসুস্থ বয়স্ক বা ছোট শিশুরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা পানি আর বিদ্যুৎবিহীন অবস্থায় আটকে থাকে। নগরজীবনের আধুনিক কাঠামোটা এমনভাবে পানির ওপর নির্ভর, যে পানি না থাকলে পুরোটা মুহূর্তেই কেমন ভেঙে পড়া এক অবকাঠামোর মতো লাগে।
তেহরানকে পানি দেয় পাঁচটি প্রধান বাঁধ। এর মধ্যে লার বাঁধ প্রায় শুকিয়ে যাওয়ার পথে, আর আমির কাবির বাঁধের জলাধার এখন ইতিহাসের সর্বনিম্ন স্তরে। পাহাড়বেষ্টিত হ্রদের তলদেশ থেকে উঠে আসা ফাটল ধরা পাথর, চারা গাছ গজিয়ে ওঠা শুকনো অংশ, আর সঙ্কুচিত নীল জলরাশির সরু দাগ—সব মিলিয়ে তৈরি হয়েছে এক ভীতিকর প্রাকৃতিক দৃশ্য, যেন শহরের ভবিষ্যতের ভাঙাচোরা প্রতিচ্ছবি। এই জলাধারগুলোই একসময় রাজধানীর প্রাণ ছিল, এখন সেগুলোই তেহরানের জলদেউলিয়াতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সংকট শুধুই খরা বা কম বৃষ্টিপাতের গল্প নয়; এটি একধরনের “ওয়াটার ব্যাঙ্করাপ্সি”—যেখানে প্রকৃতি যতটা পানি নিয়মিত সরবরাহ করতে পারে, মানুষের ব্যবহারের পরিমাণ দীর্ঘদিন ধরে ততটা ছাড়িয়ে গেছে। নদী-খাল-হ্রদ শুকিয়ে যাওয়ার পর শুরু হয়েছে ভূগর্ভস্থ পানি তোলার উন্মাদনা। কয়েক দশক ধরে কৃষি, শিল্প আর শহুরে নির্মাণের নামে এমনভাবে ভূগর্ভস্থ স্তর খুঁড়ে জল তুলে নেয়া হয়েছে যে, অনুমান করা হচ্ছে ইরানের ৭০ শতাংশেরও বেশি ভূগর্ভস্থ জলাধার ইতোমধ্যেই ফাঁকা বা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। কোথাও কোথাও মাটি বছরে ২৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত নিচে বসছে—ভূগর্ভস্থ ফাঁকা হয়ে যাওয়া স্তর ধসে পড়ছে, আর তার সঙ্গে শহর আর গ্রাম নিঃশব্দে একটু একটু করে ডুবে যাচ্ছে ভেতরের দিকে।
ইরানের পানি ব্যবহারের সবচেয়ে বড় অংশ যায় কৃষিখাতে—মোট ব্যবহৃত পানির প্রায় ৯০ শতাংশ। এর অনেকটাই নষ্ট হয় অদক্ষ সেচ ব্যবস্থার ফাঁক দিয়ে। শুষ্ক ও মরুপ্রবণ এলাকায় ধান আর আখের মতো পানি-খেকো ফসল চাষ করা হচ্ছে বছরের পর বছর। এতে একদিকে যেমন পানি দ্রুত শেষ হচ্ছে, অন্যদিকে টেকসই কৃষির বদলে তৈরি হচ্ছে এক প্রকার ভঙ্গুর, ঝুঁকিপূর্ণ খাদ্যব্যবস্থা। প্রকৃতি এখানে সহযোগী নয়, বরং সতর্কবার্তা দিচ্ছে, আর এই সতর্কবার্তা অগ্রাহ্য হওয়ার ফল এখন জলাধারের শুকিয়ে যাওয়া তলদেশে, ফেটে যাওয়া মাটির গায়ে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
তবে তেহরানের সংকটকে শুধু গ্রাফ আর পরিসংখ্যান দিয়ে বোঝা সম্ভব নয়। এটাকে বোঝার জন্য দেখতে হয় খালি ট্যাংকের সামনে সারি ধরে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ, ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষার পরও পানি না পেয়ে ফিরে যাওয়া মেয়েরা, অথবা বিদ্যুৎবিহীন গরম রাতে ছাদে উঠে হেলে পড়া গাঢ় আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা ক্লান্ত শ্রমিকদের মুখ। দিনে দুই থেকে চার ঘণ্টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ চলে যাওয়া এখন সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে। জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের ওপর চাপ কমে গেছে জলাধার শুকিয়ে যাওয়ার কারণে, আবার গ্যাস-চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে ঠাণ্ডা পানি দিয়ে কুলিং করার সুযোগও কমেছে। ফলে অতিরিক্ত গরমে এসি আর পানির পাম্প চালাতে গিয়ে পুরো গ্রিডই এক অনিশ্চিত ভারসাম্যে দুলতে থাকে।
বিদ্যুৎ বিভ্রাটের প্রকৃত চাপ পড়ছে গরিবদের ওপর। উচ্চবিত্তদের অনেকেরই বাড়তি জেনারেটর আছে, পানির ট্যাংক আছে, অস্থায়ী সংকট সামাল দেওয়ার মতো সঞ্চয় আছে। কিন্তু নিম্নবিত্তদের জন্য বিদ্যুৎ না থাকলে মানে ফ্রিজ বন্ধ, খাবার নষ্ট, ওষুধ রাখা কঠিন, লিফট না চললে উপরের তলায় ওঠানামা দুর্বিষহ, আর পানির ট্যাংক বসানোর সামর্থ্য না থাকলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কল শুকনো—এই সব কিছুর একসঙ্গে আঘাত। সংকট তাই শুধু প্রাকৃতিক নয়, তা হয়ে দাঁড়িয়েছে সামাজিক বৈষম্যের নির্মম আয়না।
ইরানের বেশ কয়েকটি প্রদেশ—বিশেষ করে খুজেস্তান আর সিস্তান-বেলুচিস্তান—এই সংকটের সবচেয়ে তীব্র চেহারা দেখছে। কূপ আর খাল শুকিয়ে যাওয়ায় অনেক কৃষক পরিবার বাধ্য হয়ে শহরে চলে যাচ্ছে। কাজ, স্কুল, হাসপাতাল আর নিরাপদ পানি খুঁজতে তারা ঠাঁই নিচ্ছে তেহরানের মতো শহরে, যেগুলো নিজেরাই পানি আর জ্বালানির চাপের নিচে ন্যুব্জ। পরিবেশগত অভিবাসন তাই আর আলাদা কোনো সংকট নয়; এটি আস্তে আস্তে শহুরে বেকারত্ব, বস্তি বিস্তার, অপর্যাপ্ত অবকাঠামো আর রাজনৈতিক অস্থিরতার সঙ্গে মিশে একটি জটিল জাল তৈরি করছে। “পানি, বিদ্যুৎ, জীবন”—এগুলো এখন শুধু স্লোগান নয়, বরং মৌলিক অধিকারের দাবিতে রাস্তায় নামা মানুষের গলার আওয়াজ।
এই সবকিছুর মাঝেও ইরানের ভেতরের রাজনীতি আর আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতি এক অদ্ভুত পটভূমি তৈরি করেছে। একদিকে সরকার ক্রমাগত বলছে, পানযোগ্য পানি সরবরাহ তারা অগ্রাধিকার দিচ্ছে, পানি সাশ্রয়ের মাধ্যমে নাকি তিনগুণ সাশ্রয় সম্ভব হয়েছে। অন্যদিকে দেশে ক্রিপ্টোকারেন্সি মাইনিংয়ের মতো উচ্চ বিদ্যুৎনির্ভর কার্যক্রম নিয়ে সমালোচনা অব্যাহত। অভিযোগ আছে, ক্ষমতাসীমায় ঘনিষ্ঠ কিছু গোষ্ঠী এসব কার্যক্রম থেকে লাভবান হচ্ছে, আর রেশনিংয়ের মূল বোঝা পড়ছে সাধারণ মানুষের গায়ে। কর্তৃপক্ষ বলছে, তারা অবৈধ মাইনিং সাইট ধরছে, কিন্তু বাস্তবে গ্রিডে চাপ কমছে না, আর গ্রাম-শহরজুড়ে বিদ্যুৎবিভ্রাটের গল্প বাড়ছেই।
আরও এক স্তরে আছে আন্তর্জাতিক বক্তব্য-বিবৃতির টানাপোড়েন। ইসরায়েল ২০২৫ সালের সংঘাতের পর ইরানের দিকে তাকিয়ে পানিশোধন ও পুনর্ব্যবহার প্রযুক্তি নিয়ে ‘সহযোগিতার সম্ভাবনা’ দেখিয়েছে, শর্ত—ইরান “স্বাধীন” হলে। তেহরান এসব কথা রাজনৈতিক নাটক বলে উড়িয়ে দিয়েছে, গাজায় মানবিক বিপর্যয়ের দিকে আঙুল তুলে পাল্টা সমালোচনা করেছে। পানি এখানে শুধু নীতি বা প্রকৌশলের বিষয় নয়, তা হয়ে উঠেছে কূটনৈতিক বার্তা আর ক্ষমতার ভাষারও অংশ। কিন্তু এই শব্দের খেলায় সাধারণ তেহরানবাসীর ফাঁকা কল, শুকিয়ে যাওয়া নদী আর ধুলো উড়তে থাকা বাঁধের তলদেশের ছবি খুব কমই আলোচনায় আসে।
বিশ্বব্যাপী প্রেক্ষাপটে ইরানের সংকট এক গুরুতর সতর্কবার্তা। জাতিসংঘের তথ্য বলছে, ২০০০ সাল থেকে বিশ্বজুড়ে খরার প্রবণতা প্রায় ২৯ শতাংশ বেড়েছে। যদি বর্তমান ধারা চলতে থাকে, তাহলে ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বের প্রতি চারজনের তিনজন কোনো না কোনোভাবে খরার প্রভাবের মধ্যে পড়তে পারেন। পশ্চিম এশিয়ার অন্যান্য দেশও একই ধরনের বহুবর্ষজীবী খরা, ভূমি অবক্ষয়, দুর্বল জলব্যবস্থাপনা আর রাজনৈতিক অস্থিরতার ফাঁদে আটকা। কৃষি, জ্বালানি, স্বাস্থ্য, পরিবহন ও পর্যটন—সব খাতেই এর দোর্দন্ড প্রভাব পড়ছে। ইরান শুধু একটি উদাহরণ, কিন্তু এই উদাহরণের ভেতরেই ভবিষ্যৎ পৃথিবীর অনেক শহরের সম্ভাব্য চেহারা লুকিয়ে আছে।
তার পরও সমাধান যে নেই, এমনটা কেউ বলছেন না। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পানি, জ্বালানি ও ভূমি ব্যবস্থাপনাকে একসঙ্গে রেখে সমন্বিত নীতি নেওয়া গেলে, এখনও অনেক কিছু বদলানো সম্ভব। ইরান ঘোষণা করেছে, সাত বছরের মধ্যে জাতীয় পানি ব্যবহারে বছরে ৪৫ বিলিয়ন ঘনমিটার পর্যন্ত কমানোর লক্ষ্য তাদের আছে—পুনঃব্যবহার, আধুনিক সেচ, পাইপলাইনের ফাঁকফোকর কমানো ইত্যাদির মাধ্যমে। কিন্তু আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা, প্রশাসনিক জটিলতা আর বিনিয়োগের ঘাটতি এই উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনাকে কাগজের ভেতর আটকে রাখছে। বড় প্রশ্ন হলো, রাজনৈতিক সদিচ্ছা, স্বচ্ছতা আর দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ছাড়া কি এই রূপান্তর সম্ভব?
পরিবেশবিদ কাভেহ মাদানি তাই বলছেন, শেষ পর্যন্ত ইরানকে তার ‘পানির দেউলিয়াত্ব’ স্বীকার করতেই হবে—যত দেরি করবে, তত বেশি মূল্য দিতে হবে। উন্নয়নের মডেল বদলে, পানির ওপর অতিরিক্ত নির্ভর প্রকল্পগুলো পুনর্বিবেচনা করে, কৃষিতে কম পানি লাগে এমন ফসল ও প্রযুক্তিতেও বিনিয়োগ করা দরকার। এসব কাজ যত দ্রুত শুরু হবে, তত বেশি সম্ভাবনা থাকবে তেহরানকে সম্পূর্ণ জলবিহীন শহরে পরিণত হওয়া থেকে বাঁচানোর। কারণ এখন আর প্রশ্নটা কেবল এই যে, বৃষ্টি হবে কি হবে না; বরং প্রশ্নটা হচ্ছে—পানি কমবে, খরা আসবে—এটা ধরে নিয়ে আমরা আগে কী প্রস্তুতি নিচ্ছি।
তেহরানের শুকিয়ে যাওয়া নদীর বুকে এখনও মানুষ পিকনিক করতে যায়, শুকনো তলদেশে কার্পেট পেতে বসে আড্ডা দেয়, শিশুেরা নুড়িপাথর নিয়ে খেলে। একসময় যে জায়গায় পানি ভরপুর ছিল, সেখানেই এখন ধুলো উঠছে, কিন্তু মানুষের দৈনন্দিনতা থেমে নেই। এই দৃশ্যের মধ্যে এক ধরনের বিষণ্ণ সৌন্দর্য আছে; একই সঙ্গে আছে অদ্ভুত এক অস্বস্তি। যেন মানুষের জীবনযাত্রা আর প্রকৃতির পরিবর্তনের মাঝখানে তৈরি হয়েছে এক অপেক্ষার সময়—সবাই জানে, এভাবে বেশিদিন চলবে না, কিন্তু তবু আজকের দিনটা যেভাবেই হোক কাটিয়ে দিতে হবে।
তেহরানের কল থেকে এখনো যে পানি পড়ছে, তা আসলে সময় ধার করা পানি। সামনে কঠিন সিদ্ধান্ত, কঠোর নীতি আর বাস্তবায়নের পরীক্ষা অপেক্ষা করছে। শহরের এই সংকট আমাদের শেখায়, পানি কেবল একটি প্রাকৃতিক সম্পদ নয়; এটি একই সঙ্গে ন্যায়বিচার, শাসন, প্রযুক্তি, অর্থনীতি, ভূরাজনীতি এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতারও প্রতীক। তেহরানের গ্রীষ্মের তপ্ত দুপুরে কল ঘুরিয়ে পানি পাওয়া না-পাওয়ার ফারাকটা তাই শুধু আবহাওয়া ঠিক করে না; সেটি নির্ধারণ করে রাষ্ট্র, সমাজ আর আমাদের সম্মিলিত বুদ্ধিমত্তা—আমরা কত দ্রুত বুঝতে পারি যে পানি নিঃশেষ হওয়ার আগে বদলাতে হবে আমাদের পথ।
আপনার মতামত জানানঃ