 পদ্মার চর সবসময়ই ছিল ভূগোলের দিক থেকে আলাদা, আলাদা মানসিকতার মানুষদের বসবাসের জায়গা, আর রাষ্ট্রের নজর এড়িয়ে টিকে থাকা এক সুক্ষ্ম জগত। নদীর গতিপথ যেমন বদলায়, চরও তেমন বদলায়; এক মৌসুমে যেখানে দোআঁশ মাটির উর্বর জমি, পরের বর্ষায় সেখানে গহীন পানির স্রোত। চরবাসীর জীবনও সে রকম—আজ বীজ বপন, কাল ফসল কাটা, আর কখন যে ভিটেমাটি সরে গিয়ে অন্য চরদিকে আশ্রয় নিতে হয়, সে কেউ জানে না। এই অনিশ্চয়তার ভেতরেই চরাঞ্চলে জন্ম নেয় শক্তির রাজনীতি। কে নিয়ন্ত্রণ করবে নদী, কে নিয়ন্ত্রণ করবে বালু, কে নিয়ন্ত্রণ করবে ফসলি জমি—এই মালিকানা প্রশ্ন থেকেই সন্ত্রাসী বাহিনীগুলোর উদ্ভব। পান্না বাহিনী, লালচাঁন বাহিনী—তারপর দীর্ঘ বিরতির পর আবার কাকন বাহিনী। যেন চর কখনও সন্ত্রাসমুক্ত হয়নি, শুধু নাম বদলেছে, চরিত্র বদলায়নি।
পদ্মার চর সবসময়ই ছিল ভূগোলের দিক থেকে আলাদা, আলাদা মানসিকতার মানুষদের বসবাসের জায়গা, আর রাষ্ট্রের নজর এড়িয়ে টিকে থাকা এক সুক্ষ্ম জগত। নদীর গতিপথ যেমন বদলায়, চরও তেমন বদলায়; এক মৌসুমে যেখানে দোআঁশ মাটির উর্বর জমি, পরের বর্ষায় সেখানে গহীন পানির স্রোত। চরবাসীর জীবনও সে রকম—আজ বীজ বপন, কাল ফসল কাটা, আর কখন যে ভিটেমাটি সরে গিয়ে অন্য চরদিকে আশ্রয় নিতে হয়, সে কেউ জানে না। এই অনিশ্চয়তার ভেতরেই চরাঞ্চলে জন্ম নেয় শক্তির রাজনীতি। কে নিয়ন্ত্রণ করবে নদী, কে নিয়ন্ত্রণ করবে বালু, কে নিয়ন্ত্রণ করবে ফসলি জমি—এই মালিকানা প্রশ্ন থেকেই সন্ত্রাসী বাহিনীগুলোর উদ্ভব। পান্না বাহিনী, লালচাঁন বাহিনী—তারপর দীর্ঘ বিরতির পর আবার কাকন বাহিনী। যেন চর কখনও সন্ত্রাসমুক্ত হয়নি, শুধু নাম বদলেছে, চরিত্র বদলায়নি।
২০০৩ থেকে ২০০৬ সালের দিকে পদ্মার চর ছিল আতঙ্কের সমার্থক। পান্না বাহিনী ও লালচাঁন বাহিনীর দাপটে চার উপজেলার সীমান্তাঞ্চল ছিল আগ্নেয়গিরির মতো উত্তপ্ত। তখনকার গণমাধ্যমে লেখা হয়েছিল, মাত্র তিন বছরে ৪১ জন মানুষকে হত্যা করা হয় এই আধিপত্য বিস্তারের যুদ্ধে। সকাল হলে দেখা যেত নদীর চরে লাশ পড়ে আছে; আর রাত হলে গ্রামের মানুষরা আলো নিভিয়ে রাখত। সে সময় পুলিশ, বিজিবি, প্রশাসন—সবাই ছড়ি হাতে শক্ত অবস্থান নেয়। ক্রসফায়ারের একের পর এক ঘটনায় পান্না নিহত হয়, লালচাঁন নিহত হয়, দুপক্ষের অনেক সদস্য নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। চর দীর্ঘ সময়ের জন্য শান্ত হয়। মানুষ ফিরে পায় চাষাবাদের সাদামাটা জীবন। কিন্তু চর এক জায়গায় থেমে থাকে না। নদীর জল যেমন স্থির থাকে না, চরবাসীর জীবনের নিরাপত্তাও দীর্ঘস্থায়ী হয় না।
যে চর একদিন পান্নার দখলে ছিল, পরে লালচাঁনের হাতে যায়, সেই চরেই আবার একদিন উত্থান হয় ‘কাকন বাহিনী’র। বাহিনীর প্রধান রোকনুজ্জামান কাকন—নামের সঙ্গে ইঞ্জিনিয়ার উপাধি আছে, কারণ তিনি ১৯৯৪ সালে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে বিএসসি সম্পন্ন করেছিলেন। পড়াশোনা আছে, বুদ্ধি আছে, কিন্তু ভূখণ্ড বেছে নিয়েছিলেন শক্তি ও ভয় দেখিয়ে আধিপত্য কায়েমের পথ। স্থানীয় মানুষের বর্ণনায় উঠে এসেছে, ২০০৫ সালে পান্না নিহত হওয়ার পর কাকন সৌদি আরব চলে যান। ফিরে আসেন কয়েক বছর পরে। তখনকার রাজনৈতিক বাস্তবতায় তাঁকে আশ্রয় দেন স্থানীয় প্রভাবশালী ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা। বালুমহাল নিয়ন্ত্রণ ছিল তখন সোনার খনি—যে বালুমহাল নিয়ন্ত্রণ করবে, সে শুধু বালু নয়, নদীপথ, ঘাট, বাজার, পরিবহন, এমনকি ভোট ও অর্থনীতির শিরায় শিরায় নিয়ন্ত্রণ করবে। কাকন এই বিনিয়োগযোগ্য ক্ষমতার ভাষা দ্রুত বুঝে যান।
পদ্মার চরাঞ্চলে স্পিডবোট মানেই গতি ও শক্তির প্রতীক। এই স্পিডবোট দিয়েই কাকন বাহিনী নদীর বুকে মহড়া দেয়। তাদের হাতে থাকে আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র, হাতে ধরা ফ্ল্যাগ, মুখে ভরপুর দম্ভ। চরবাসীরা দূর থেকে দেখে, কিন্তু সামনে গেলে মৃত্যু নিশ্চিত—এই মনস্তত্ত্বই কাকন বাহিনী ব্যবহার করে। যে কৃষক ফসল তুলছে, তাকে বলা হয়, “অংশ দিতে হবে।” যে বালুর ট্রাক্টর নদী থেকে বালু বহন করছে, সে জানে কাকনের হিস্যা দিতে হবে। যে মাঝি নদী পারাপারের নৌকা চালাচ্ছে, তাকেও দিতে হয় চাঁদা। এই একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ বহুদিন চলে আসছিল। চরবাসীরা অনেকেই বলেন, আগের সরকারের সময়ে কেউ মুখ খুলতে সাহস পায়নি। বালুমহাল ছিল রাজনীতির অর্থভান্ডার। সেখানে কাকন ছিল এক হাতিয়ার।
কিন্তু নদীতে বন্দুক ঠেকিয়ে ভীতি দেখানোর রাজনীতিরও শেষ আছে। এই বছর জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত কাকন বাহিনীর বিরুদ্ধে ছয়টি মামলা হয় বিভিন্ন থানায়। পুলিশ বা প্রশাসনের চোখ এড়ানো যায়নি যখন ড্রোন দিয়ে স্থানীয়রা কাকনের স্পিডবোট মহড়ার ভিডিও ধারণ করে সরাসরি জেলা প্রশাসকের হাতে দেন। ভিডিওতে স্পষ্ট দেখা গেছে—দৌলতপুর, লালপুর, ঈশ্বরদী, বাঘা—চার জেলার বিস্তীর্ণ পদ্মার চরে বাহিনীর সামরিক কায়দার রণভঙ্গি। তারপরও বাহিনীর দাপট কমেনি, বরং অভিযোগ আছে উল্টোভাবে তারা কৃষকদের ফসল লুট, নদীপথে চাঁদাবাজি এবং জমিদখলের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়।
তারই মধ্যে ঘটে গেল ভয়াবহতম ঘটনা—দুই কৃষক নিহতের গোলাগুলি। চরবাসী বলছেন, কাশবন দখলকে কেন্দ্র করে কাকন বাহিনী ও প্রতিপক্ষ মণ্ডল গ্রুপের মধ্যে হাতাহাতি শুরু হয়ে পরে তুমুল বন্দুকযুদ্ধে রূপ নেয়। নিহত হন আমান মণ্ডল ও নাজমুল মণ্ডল। গুরুতর আহত হন আরও দুজন। একই ঘটনায় কাকনের এক সহযোগী লিটনও নিহত হয়। রক্তের দাগ পড়ে নদীর তীরে, কিন্তু নদী তো স্বভাবগতভাবেই সব দাগ ধুয়ে ফেলতে জানে। ধুয়ে দেয়, কিন্তু স্মৃতি মুছতে পারেনা চরবাসী।
এই হত্যাকাণ্ডের পর জেলা পুলিশ অভিযান শুরু করে। নৌকা নিয়ে চর থেকে চরে যাওয়া, ৫-৬ কিলোমিটার হাঁটা, আশ্রয়স্থল খোঁজা—এসব অভিযান প্রমাণ করে প্রশাসন এবার কেবলমাত্র মামলা-জরিপের বাইরে এসেছে। পুলিশের উচ্চপর্যায়ের একজন কর্মকর্তা বলছেন, “১৫ দিনের মধ্যে দেখবেন ফল।” চরবাসী কিছুটা আশা দেখছে, কিন্তু সেই আশা খুব নাজুক। কারণ তারা জানে, ক্ষমতার পরিবর্তন হলে চর আবার নতুন কোনো কাকনের জন্ম দিতে পারে।
চরাঞ্চলে আইন খুব দ্রুত প্রয়োগ করা যায় না। যে নদীপথে নামলেই দশ মিনিটের মধ্যে জেলা বদলে যায়, সেখানে সন্ত্রাসীরা খুব সহজে পালিয়ে যেতে পারে। কখনও কলাবাগানের ভেতর, কখনও সীমান্তের শূন্য রেখার ধানক্ষেতের মধ্যে তারা আশ্রয় নেয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও জানে, চর মানে শুধু অপরাধ নয়—চর মানে রাষ্ট্রের শূন্যতা।
সবশেষে সবচেয়ে বড় প্রশ্নটি থেকে যায়—রাষ্ট্র কোথায়? এই মানুষগুলো কি দেশের নাগরিক নয়? তাদের কর, ভোট, পরিশ্রম কি দেশের অর্থনীতিতে অংশ নয়? যদি তাই হয়, কেন তারা নিজেদের জমি, নদী, জীবন রক্ষা করতে গুলি খেয়ে মরবে? বন্দুকের ভাষায় রাজনীতি চলে—এটা কি রাষ্ট্র মেনে নিয়েছে?
চরবাসীরা এখনো বলছে—“আমরা শুধু চাই শু’খমত থাকতে। ফসল তুলব, নদী পার হব, কেউ এসে আমাদের ওপর গুলি চালাবে না।” কিন্তু চরবাসীর এই সরল চাহিদা পূরণ করা সহজ নয়। কারণ চর অঞ্চলের বালু ও জমি এখন আর শুধু স্বাভাবিক সম্পদ নয়—এগুলো হলো ক্ষমতার অর্থনীতি, সশস্ত্র আধিপত্যের রণক্ষেত্র।
চর যদি সত্যিই শান্ত হতে হয়, কাকন বাহিনী শুধু ভেঙে দিলে হবে না। স্থানীয় রাজনৈতিক স্বার্থের শৃঙ্খল ভাঙতে হবে। বালুমহালকে স্বচ্ছতার আওতায় আনতে হবে। চরবাসীদের গণআত্মরক্ষার সুযোগ তৈরি করতে হবে। এবং সবচেয়ে বড় কথা—রাষ্ট্রকে নদীর বুকে নিজের উপস্থিতি প্রমাণ করতে হবে।
নইলে নদী আবার কাউকে না কাউকে নিজের নতুন রাজা বানিয়ে নেবে। পদ্মা নদী যেমন, চর মানুষও মনে রাখে সব—রক্ত, ভয়, আর মুক্তি পাওয়ার অসম্পূর্ণ স্বপ্ন।
 
	 
	 
	 
	 
	 
	 
আপনার মতামত জানানঃ