২০২০ সালের শুরুর দিকে বিশ্বব্যাপি করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ লকডাউনে চলে যেতে একপ্রকার বাধ্য হয়। লকডাউনে মানুষ ঘরবন্দি থাকার কারণে সমগ্র বিশ্বে স্থবিরতা নেমে আসে পরিবহন খাতে। শিল্প, কল-কারখানা, পর্যটনসহ নানা খাতের কার্যক্রম সীমিত হয়ে আসে। যারফলে কমতে শুরু করে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের বৈশ্বিক চাহিদা। বছর শেষে মার্কিন এনার্জি ইনফরমেশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (ইআইএ) মতে, করোনা মহামারী ও লকডাউনের কারণে বিগত বছর অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের বৈশ্বিক চাহিদা আগের বছরের তুলনায় ৯ শতাংশ কমেছে। এমনটাই জানাচ্ছে আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা রয়টার্স।
অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের বিশ্বব্যাপি চাহিদায় পতনের পেছনে করোনাভাইরাসের মহামারীকে চিহ্নিত করেছে মার্কিন সংস্থা এনার্জি ইনফরমেশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন । প্রতিষ্ঠানটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছরের জানুয়ারির প্রথমে চীনে লকডাউন শুরু হয়। ওই সময় দেশটিতে নববর্ষের মৌসুম চলছিল। লকডাউনে উৎসব বাতিল হয়ে যায়। যার ফলে মানুষ ঘরবন্দি হয়ে পড়ে। এমন পরিস্থিতিতে ২০২০ সালের শুরুর দিকে চীনে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের চাহিদায় রেকর্ড পতন ঘটে।
করোনা সংক্রমণ চীনে শুরু হলেও তা দ্রুত পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয় বৈশ্বিক মহামারী। ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা থেকে শুরু করে এশিয়ার প্রায় সবগুলোদেশে লকডাউন শুরু হলে বছরের উল্লেখযোগ্য একটা সময় বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ ঘরবন্দি জীবন কাটায়। পৃথিবীব্যাপি গতি হারায় আমদানি-রফতানি, ব্যবসা-বাণিজ্য, সামগ্রিক অর্থনীতি। মূলত এর জের ধরে গত বছর বিশ্বজুড়ে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের চাহিদায় পতন দেখা দিয়েছে।
এর আগে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিনিয়োগ ব্যাংকিং কোম্পানি রেমন্ড জেমস এমন পূর্বাভাস দিয়ে জানিয়েছিল, ২০২২ সালের আগে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের বৈশ্বিক চাহিদা ২০১৯ সালের সমপর্যায়ে আসার সম্ভাবনা ক্ষীণ। এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল প্ল্যাটস ও অয়েলপ্রাইসডটকম-এর প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই জ্বালানি তেলের বাজার খুব সহসাই মহামারী থেকে প্রভাবমুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা নেই। এ পরিস্থিতিতে ২০২০ সালতো তো বটেই, ২০২১ সাল নাগাদ জ্বালানি পণ্যটির বৈশ্বিক চাহিদায় নিম্নমুখী প্রবণতা বজায় থাকতে পারে।
রেমন্ড জেমসের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২১ সালে জেট ফুয়েল খাতে জ্বালানির চাহিদা প্রত্যাশার তুলনায় দৈনিক গড়ে ২০ লাখ ব্যারেল কমে যেতে পারে বলেছিল। সড়ক পরিবহন খাতে পেট্রল ও ডিজেলের চাহিদা কমে যেতে পারে দৈনিক গড়ে ১৬ লাখ ব্যারেল। এছাড়া বিভিন্ন শিল্প ও পেট্রোকেমিক্যাল খাতে জ্বালানি তেলের চাহিদা কমে যেতে পারে দৈনিক গড়ে ১০ লাখ ব্যারেল। নৌ-পরিবহন খাতে জ্বালানিটির চাহিদা কমে যেতে পারে দৈনিক গড়ে চার লাখ ব্যারেল। সব মিলিয়ে ২০২১ সাল পর্যন্ত পণ্যটির বাজার নিম্নমুখী প্রবণতার মধ্য দিয়ে যেতে পারে। রেমন্ড জেমস এর পূর্বাভাস সত্য বলে এখন প্রতীয়মান হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সংস্থা ইআইএ’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিদায়ী বছরে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের বৈশ্বিক চাহিদা দাঁড়িয়েছে দৈনিক গড়ে ৯ কোটি ২২ লাখ ব্যারেলে। এক বছরের ব্যবধানে জ্বালানি পণ্যটির বৈশ্বিক চাহিদায় ৯ শতাংশ পতন দেখা গেছে। ১৯৮০ সাল থেকে প্রতি বছর অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের বৈশ্বিক চাহিদার হিসাব রাখছে ইআইএ। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, এর পর থেকে ২০২০ সালেই জ্বালানি তেলের বৈশ্বিক চাহিদায় সবচেয়ে বড় পতন দেখা গেছে।
গেল বছরে জ্বালানি তেলের বৈশ্বিক চাহিদা পতনের নেতিবাচক প্রভাব দেখা দিয়েছিল আন্তর্জাতিক বাজারে। ২০২০ সালের শেষভাগের আগ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দরপতন বজায় ছিল। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের ব্যারেল শূন্য ডলারের নিচে নেমে যাওয়ার ঘটনা ঘটে গত বছর। অর্থাৎ ওই সময় জ্বালানি তেল কিনলে বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো অর্থ তো নেয়নি, উল্টো ক্রেতাদের পরিবহন ব্যয় নিজেরাই বহন করেছে। ইতিহাসে এমন ঘটনা নজিরবিহীন। বছরের শেষভাবে এসে করোনা ভ্যাকসিনের প্রয়োগ শুরু হলে জ্বালানি পণ্যটির বাজার পরিস্থিতি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে। যদিও সেটা আশানুরূপ ছিল না।
তবে চলতি বছর জ্বালানি তেলের বৈশ্বিক চাহিদা মন্দা ভাব কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে পারে মনে করছেন বিশেষজ্ঞমহল। ইআইএর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২১ সালে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের বৈশ্বিক চাহিদা দাঁড়াতে পারে দৈনিক গড়ে ৯ কোটি ৭৮ লাখ ব্যারেলে, যা আগের বছরের তুলনায় দৈনিক গড়ে ৫৬ লাখ ব্যারেল, যা ৬ শতাংশ বেশি। যদিও ২০১৯ সালে মহামারী-পূর্ববর্তী অবস্থানের তুলনায় যা প্রায় ৩ শতাংশ কম। চলতি বছর শুধু যুক্তরাষ্ট্রে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দৈনিক গড় চাহিদা ১৪ লাখ ব্যারেল বাড়তে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। অন্যদিকে ২০২২ সালে জ্বালানি পণ্যটির দৈনিক গড় চাহিদা চলতি বছরের তুলনায় আরো ৩৩ লাখ ব্যারেল বৃদ্ধি পাওয়ার জোরালো সম্ভাবনা দেখছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানটি।
আপনার মতামত জানানঃ