যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নীতির বিরুদ্ধে এক অভূতপূর্ব বিক্ষোভের ঢেউ নেমেছে। হাজার হাজার মানুষ নেমে এসেছে রাস্তায়, হাতে প্ল্যাকার্ড আর কণ্ঠে স্লোগান— “রাজতন্ত্র নয়, গণতন্ত্র চাই”, “সংবিধানের বিকল্প নেই।” এমন উত্তাল জনসমুদ্রে একদিকে প্রতিবাদের উচ্ছ্বাস, অন্যদিকে গণতন্ত্র রক্ষার গভীর উদ্বেগ। ‘নো কিংস’ নামে পরিচিত এই আন্দোলনের মূল বার্তা— কেউই রাজা নন, আমেরিকা কোনো রাজতন্ত্র নয়। গণতন্ত্রকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে জনগণের কণ্ঠস্বরকে ফিরিয়ে আনতে হবে।
নিউইয়র্কের টাইমস স্কোয়ারে মানুষের ঢল নেমেছিল। শুধু স্কোয়ার নয়, তার আশপাশের রাস্তাগুলো, এমনকি পাতাল রেলের প্রবেশপথও ভরে গিয়েছিল প্রতিবাদকারীতে। অনেকে পরিবার নিয়ে এসেছেন, কেউ বাদ্যযন্ত্র বাজাচ্ছেন, কেউ আবার শান্তিপূর্ণভাবে ব্যানার হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। “গণতন্ত্র দেখতে এমনই”— এই স্লোগান গেয়ে, বাজনার তালে তালে নেচেছেন অনেকে। নিউইয়র্ক পুলিশের হিসাব অনুযায়ী, শুধু ওই শহরেই এক লক্ষেরও বেশি মানুষ রাস্তায় নেমেছেন। টাইমস স্কোয়ারেই কুড়ি হাজারের বেশি মানুষের উপস্থিতি চোখে পড়েছে।
এই বিক্ষোভ শুধু নিউইয়র্কে সীমাবদ্ধ ছিল না। ওয়াশিংটন ডিসি, শিকাগো, লস অ্যাঞ্জেলস, মায়ামি— প্রতিটি শহরেই একই দৃশ্য। মানুষ প্ল্যাকার্ড হাতে জানাচ্ছেন তাদের ক্ষোভ, অসন্তোষ আর ভয়ের কথা। তারা বলছেন, ট্রাম্পের সাম্প্রতিক নীতিগুলো যুক্তরাষ্ট্রকে এক ধরনের কর্তৃত্ববাদী শাসনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। অনেকেই আশঙ্কা করছেন, দেশটি ধীরে ধীরে ফ্যাসিজমের পথে এগোচ্ছে।
বিক্ষোভকারীদের মধ্যে ছিলেন নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ— শিক্ষক, শিক্ষার্থী, লেখক, কর্মজীবী, এমনকি অবসরপ্রাপ্ত প্রকৌশলীও। যেমন, নিউজার্সির এক প্রবীণ প্রকৌশলী মাসিমো মাসকলি, যিনি ইটালিতে বেড়ে উঠেছেন। তিনি বলেন, “আমার চাচা মুসোলিনীর বিরুদ্ধে লড়েছিলেন, ফ্যাসিস্টদের হাতে প্রাণ হারান। আজ আমেরিকায় আবার সেই ফ্যাসিজমের ছায়া দেখছি, এটা ভাবতেও কষ্ট হয়।” তার চোখে এই আন্দোলন শুধুই রাজনৈতিক প্রতিবাদ নয়, বরং এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব— স্বৈরশাসনের পুনরুত্থানের বিরুদ্ধে সতর্কতা।
‘নো কিংস’ আন্দোলনের আয়োজকরা জানিয়েছেন, তাদের লক্ষ্য সম্পূর্ণ অহিংস প্রতিবাদ। তারা অংশগ্রহণকারীদের শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন, যাতে কোনো রকম সংঘর্ষ না ঘটে। তাদের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে— “আমরা কারও বিরুদ্ধে নয়, আমরা গণতন্ত্রের পক্ষে।” নিউইয়র্কে পুরো অনুষ্ঠানজুড়ে হেলিকপ্টার, ড্রোন, এমনকি পুলিশও সতর্ক অবস্থায় ছিল। যদিও পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, বিক্ষোভ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শান্তিপূর্ণ ছিল এবং কোনো বড় ধরনের বিশৃঙ্খলার খবর পাওয়া যায়নি।
বিক্ষোভের প্রেক্ষাপটে ট্রাম্পের সহযোগীরা দাবি করেছেন, এই প্রতিবাদের পেছনে বামপন্থী ‘অ্যান্টিফা’ আন্দোলনের হাত রয়েছে। তারা এটিকে “হেইট আমেরিকা র্যালি” বলে অভিহিত করেছেন, অর্থাৎ আমেরিকাকে ঘৃণার সমাবেশ। অন্যদিকে আয়োজকরা পাল্টা বলেছেন, তাদের এই প্রতিবাদ আসলে ভালোবাসার প্রকাশ— আমেরিকাকে তারা এতটাই ভালোবাসেন যে, গণতন্ত্রকে ধ্বংস হতে দিতে চান না।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প অবশ্য এই অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, তার পদক্ষেপগুলো দেশের পুনর্গঠনের জন্য জরুরি। তিনি নিজেকে স্বৈরশাসক বা ফ্যাসিস্ট বলে আখ্যা দেওয়ার বিষয়টি ‘উন্মাদনা’ বলে ব্যাখ্যা করেছেন। তবে সমালোচকদের দাবি, দ্বিতীয় মেয়াদে ট্রাম্প ক্রমশ নির্বাহী ক্ষমতা বাড়িয়ে দিয়েছেন, কংগ্রেসের অনুমোদন ছাড়াই তহবিল ব্যবহার করেছেন, এমনকি কিছু রাজ্যের গভর্নরদের আপত্তি উপেক্ষা করে ন্যাশনাল গার্ড মোতায়েন করেছেন। অনেকের মতে, এইসব পদক্ষেপ আমেরিকার সাংবিধানিক ভারসাম্যকে নষ্ট করছে।
ওয়াশিংটন ডিসির বিক্ষোভে উপস্থিত ছিলেন সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স। তিনি বলেন, “আমরা এখানে এসেছি ঘৃণা ছড়াতে নয়, বরং ভালোবাসার জন্য। আমরা আমেরিকাকে ভালোবাসি, তাই আমরা প্রতিবাদ করছি।” তার এই বক্তব্যে জনতার গর্জন ওঠে। নিউইয়র্কের সিনেটর চাক শুমারও এক্স (সাবেক টুইটার)-এ লেখেন, “আমেরিকায় কোনো রাজা নেই, কোনো স্বৈরশাসক নেই। আমরা ট্রাম্পকে গণতন্ত্র ধ্বংস করতে দেব না।”
এই বিক্ষোভের ঢেউ শুধু আমেরিকার ভেতরে নয়, ছড়িয়ে পড়েছে ইউরোপেও। বার্লিন, রোম, মাদ্রিদ, এমনকি লন্ডনে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের সামনেও সংহতি মিছিল হয়েছে। ইউরোপের নাগরিকরা বলছেন, গণতন্ত্রের সংকটে থাকা আমেরিকাকে একা ফেলে রাখা যায় না। টরন্টোতেও যুক্তরাষ্ট্রের কনস্যুলেটের সামনে প্রতিবাদকারীরা জড়ো হয়েছেন।
টেক্সাস, ভার্জিনিয়া ও কানসাসে রিপাবলিকান গভর্নররা সতর্ক অবস্থান নিয়েছেন। টেক্সাস গভর্নর গ্রেগ অ্যাবোট এমনকি ন্যাশনাল গার্ডকে সক্রিয় করেছেন, যুক্তি দিয়েছেন “পরিকল্পিত অ্যান্টিফা লিংকড বিক্ষোভের” মোকাবিলায় প্রস্তুত থাকতে হবে। তার এই পদক্ষেপের তীব্র সমালোচনা করেছেন রাজ্যের ডেমোক্র্যাট নেতারা। এক নেত্রী মন্তব্য করেন, “শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ দমনে সশস্ত্র বাহিনী নামানো রাজা বা স্বৈরশাসকের কাজ। গ্রেগ অ্যাবোট প্রমাণ করেছেন, তিনিও তাদের মতোই ভাবছেন।”
বিক্ষোভকারীদের মধ্যে এক তরুণী হাতে প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন, তাতে লেখা— “আমরা রাজাকে চাই না, আমরা জনগণের সরকার চাই।” তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “আমি জন্মেছি এমন এক আমেরিকায়, যেখানে জনগণের কণ্ঠই ছিল সর্বশক্তিমান। এখন মনে হয়, সেই কণ্ঠ ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে।”
এই বিক্ষোভে অনেকেই ভিন্ন ভিন্ন কারণে অংশ নিয়েছেন— কেউ ট্রাম্পের অভিবাসন নীতি নিয়ে ক্ষুব্ধ, কেউ প্রেসের স্বাধীনতা হ্রাস পাওয়া নিয়ে চিন্তিত, কেউ আবার জলবায়ু সংকট উপেক্ষা করার প্রতিবাদে এসেছেন। কিন্তু সবাই এক জায়গায় একমত— ট্রাম্পের আমলে আমেরিকার গণতন্ত্র ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যাচ্ছে।
রয়টার্স ও ইপসসের সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের ৪০ শতাংশ মানুষ ট্রাম্পের পক্ষে, আর ৫৮ শতাংশ তার বিপক্ষে। এই বিভাজনই যেন আমেরিকার রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি— এক দেশে দুটি দৃষ্টিভঙ্গি, দুটি আদর্শ।
একজন বিক্ষোভকারী বলেছেন, “এটা কেবল ট্রাম্পের বিরুদ্ধে আন্দোলন নয়, এটা এক নতুন আমেরিকা গড়ার লড়াই। যেখানে প্রতিটি নাগরিক স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারে, ভোট দিতে পারে, ভয় ছাড়াই।”
এমন এক সময়ে যখন বিশ্বজুড়ে কর্তৃত্ববাদী প্রবণতা বাড়ছে, যুক্তরাষ্ট্রের এই ‘নো কিংস’ আন্দোলন যেন এক প্রতীক— মানুষ এখনো গণতন্ত্রের পক্ষে দাঁড়াতে জানে। রাস্তায় থাকা সেই মানুষগুলোর স্লোগান, তাদের কণ্ঠস্বর, তাদের হাতে ধরা ব্যানার যেন একটাই বার্তা দিচ্ছে— “আমরা রাজা চাই না, আমরা জনগণের দেশ চাই।”
এই আন্দোলন সাময়িক না স্থায়ী— তা সময়ই বলবে। তবে একথা নিশ্চিত, এই প্রতিবাদ আমেরিকার ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় লিখে দিল। যেখানে মানুষ আবার মনে করল, গণতন্ত্র মানে কেবল ভোট নয়, বরং প্রতিদিনের সচেতনতা, প্রতিটি অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো। আর সেই চেতনা থেকেই হয়তো আবার শুরু হবে এক নতুন পথচলা— স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার আর সমতার পথে।
আপনার মতামত জানানঃ