ভারত ও পাকিস্তানের সম্পর্কের ইতিহাস মূলত সংঘাত, অবিশ্বাস এবং রাজনৈতিক টানাপোড়েনের ইতিহাস। স্বাধীনতার পর থেকেই দুই দেশের মধ্যে কাশ্মীর ইস্যু নিয়ে বিরোধ যেন কখনোই থামেনি। সাম্প্রতিক সময়ে আবারও সেই পুরোনো দ্বন্দ্ব নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে ভারতের সেনাপ্রধান জেনারেল উপেন্দ্র দ্বিবেদীর বক্তব্যের মধ্য দিয়ে। রাজস্থানের অনুপগড়ে এক সামরিক ঘাঁটিতে দেওয়া বক্তৃতায় তিনি এমন এক হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, যা শুধু পাকিস্তানের জন্য নয়, গোটা দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্যও শঙ্কার ইঙ্গিত বহন করে।
সামরিক শক্তি প্রদর্শনের এক মঞ্চে দাঁড়িয়ে ভারতের সেনাপ্রধান বলেন, পাকিস্তান যদি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সন্ত্রাসবাদকে সমর্থন দিতে থাকে, তবে মানচিত্র থেকেই পাকিস্তানকে মুছে ফেলতে ভারত পিছপা হবে না। এমন হুঁশিয়ারি আসলে শুধু ভাষাগত আগ্রাসন নয়, এটি ভারতের ক্রমবর্ধমান সামরিক আত্মবিশ্বাসের প্রতিফলন। তিনি তাঁর বক্তব্যে আরও বলেন, পাকিস্তান যদি বিশ্ব মানচিত্রে নিজেদের অস্তিত্ব ধরে রাখতে চায়, তবে তাদের সন্ত্রাস রপ্তানি বন্ধ করতে হবে। দ্বিবেদীর কথায় আভাস পাওয়া যায়, ভারত আর আগের মতো সহনশীল অবস্থানে নেই; এখন তারা প্রতিটি হামলার জবাব দেবে আরও কঠোরভাবে।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভির প্রতিবেদন অনুযায়ী, দ্বিবেদী এই বক্তব্য দেন যখন তিনি রাজস্থানের অনুপগড়ে এক সামরিক ঘাঁটিতে সৈন্যদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিচ্ছিলেন। তিনি বলেন, “আমরা অপারেশন সিঁদুরে যে দয়া দেখিয়েছি, এবার তা দেখানো হবে না।” তাঁর এই মন্তব্যের মধ্য দিয়ে বোঝা যায়, ভারত অতীতের অভিযান থেকে শিক্ষা নিয়ে আরও আক্রমণাত্মক অবস্থান নিতে চাইছে। তিনি সৈন্যদের প্রস্তুত থাকতে বলেন এবং ইঙ্গিত দেন যে ভবিষ্যতে আরও বড় অভিযানের সম্ভাবনা রয়েছে। সেনাপ্রধানের বক্তব্যে যেমন একধরনের জাতীয়তাবাদী উচ্ছ্বাস রয়েছে, তেমনি তা আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য উদ্বেগজনক বার্তাও বহন করছে।
ভারতের এই হুঁশিয়ারির আগে বিমানবাহিনীর প্রধান এ পি সিং দাবি করেছিলেন, গত মে মাসে অপারেশন সিঁদুর চলাকালীন ভারতীয় বাহিনী পাকিস্তানের চার থেকে পাঁচটি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছিল, যার মধ্যে ছিল যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি এফ-১৬ ও চীনের তৈরি জেএফ-১৭ বিমান। এই মন্তব্যের মধ্য দিয়ে ভারত আসলে তাদের সামরিক সক্ষমতা এবং প্রযুক্তিগত অগ্রগতির প্রদর্শন করছে। পাকিস্তান বরাবরের মতো এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে, কিন্তু ভারতের বক্তব্য স্পষ্ট—তারা এখন কূটনৈতিক নয়, সামরিক শক্তির ভাষায় জবাব দিতে প্রস্তুত।
অপারেশন সিঁদুর ছিল ভারতের এক বিশেষ সামরিক অভিযান, যার মূল লক্ষ্য ছিল সন্ত্রাসীদের গোপন ঘাঁটি, প্রশিক্ষণকেন্দ্র এবং তাদের নেতৃত্বকে ধ্বংস করা। জেনারেল দ্বিবেদী বলেন, এই অভিযানে ভারতের উদ্দেশ্য ছিল নিরীহ সাধারণ মানুষ যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। ভারতের দাবি, তারা নির্ভুলভাবে সন্ত্রাসী আস্তানাগুলোতে হামলা চালিয়েছে এবং পরবর্তীতে তার প্রমাণ বিশ্ববাসীর সামনে উপস্থাপন করেছে। পাকিস্তান যদি এই তথ্য গোপন করার চেষ্টা করত, তবে ভারত তা প্রতিহত করেছে বলেও তিনি জানান।
অপারেশন সিঁদুরের পেছনের প্রেক্ষাপটও ছিল এক ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলা। গত ২২ এপ্রিল কাশ্মীরের পেহেলগামে সংঘটিত ওই হামলায় ২৫ জন পর্যটক ও একজন স্থানীয় গাইড নিহত হন। একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী প্রথমে হামলার দায় স্বীকার করলেও পরে তা অস্বীকার করে। ভারত সরাসরি পাকিস্তানকে দায়ী করে, যদিও ইসলামাবাদ তা প্রত্যাখ্যান করে। এর পর থেকেই দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক উত্তেজনা দ্রুত সামরিক সংঘাতে রূপ নেয়।
৬ মে রাতে ভারত ‘অপারেশন সিঁদুর’ নামে একটি হামলা চালায় পাকিস্তান ও পাকিস্তান-অধ্যুষিত আজাদ কাশ্মীরের অভ্যন্তরে থাকা নয়টি সন্ত্রাসী ঘাঁটিতে। ভারতের দাবি অনুযায়ী, এই অভিযানে লস্কর-ই-তইয়েবার সদর দপ্তরও ধ্বংস করা হয়। পাকিস্তান এর প্রতিক্রিয়ায় ৭ মে রাতে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। কয়েক দিনের মধ্যে সংঘাত ভয়াবহ আকার ধারণ করলে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হস্তক্ষেপ করেন এবং ১০ মে ঘোষণা দেন, দুই দেশ যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে।
ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের ইতিহাসে এই ধরনের সংঘাত নতুন নয়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে উভয় দেশের সামরিক নেতৃত্বের আগ্রাসী বক্তব্য পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। জেনারেল দ্বিবেদীর মন্তব্য যে শুধু পাকিস্তানের জন্য নয়, তা গোটা দক্ষিণ এশিয়ার শান্তির জন্যও একটি অশনিসংকেত—তা স্পষ্ট। এমন এক সময় এই বক্তব্য এসেছে, যখন ভারত তাদের সামরিক ব্যয় বাড়াচ্ছে, সীমান্তে নজরদারি শক্তিশালী করছে এবং বৈদেশিক নীতিতে আক্রমণাত্মক অবস্থান নিচ্ছে।
ভারতীয় সেনাপ্রধানের বক্তব্যের মধ্যে একধরনের মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের ইঙ্গিতও রয়েছে। তিনি সৈন্যদের উদ্দেশ্যে বলেন, “ভগবানের ইচ্ছা থাকলে, আপনারা শিগগিরই সুযোগ পাবেন।” এটি নিছক অনুপ্রেরণামূলক বক্তব্য নয়, বরং একটি বার্তা—ভারত যে কোনো মুহূর্তে সামরিক পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত। একই সঙ্গে তিনি অপারেশন সিঁদুরে অবদান রাখার জন্য কয়েকজন কর্মকর্তাকে সম্মানিত করেন, যা দেশজুড়ে দেশপ্রেমের আবেগ উস্কে দেয়।
ভারতের এই সাম্প্রতিক অবস্থান আসলে পাকিস্তানের প্রতি তাদের দীর্ঘদিনের ক্ষোভেরই বহিঃপ্রকাশ। পাকিস্তানও যে পিছিয়ে নেই, তা প্রমাণ করেছে তাদের পাল্টা হামলার মধ্য দিয়ে। দুই দেশের মধ্যে পারমাণবিক অস্ত্রের উপস্থিতি এই সংঘাতকে আরও ভয়াবহ করে তোলে। একদিকে রাজনৈতিকভাবে দুর্বল পাকিস্তান, অন্যদিকে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী এবং আন্তর্জাতিক সমর্থনপুষ্ট ভারত—এই দুই প্রতিবেশীর দ্বন্দ্ব গোটা উপমহাদেশকে বিপদের মুখে ঠেলে দিতে পারে।
যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পরও উত্তেজনা পুরোপুরি কমেনি। সীমান্তে এখনও গোলাগুলি, ছোটখাটো সংঘর্ষ এবং গোয়েন্দা তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। আন্তর্জাতিক মহল বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও রাশিয়া দুই দেশের প্রতি সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানালেও, বাস্তবে পরিস্থিতি যে কোনো সময় বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে।
জেনারেল দ্বিবেদীর বক্তব্য তাই কেবল একটি সামরিক মন্তব্য নয়; এটি এক গভীর রাজনৈতিক বার্তা। ভারতের বর্তমান নেতৃত্ব জাতীয় নিরাপত্তাকে রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত করেছে, এবং পাকিস্তানবিরোধী অবস্থান তাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও জনপ্রিয়তা বাড়াচ্ছে। অন্যদিকে পাকিস্তানের সরকার অভ্যন্তরীণ সংকট, অর্থনৈতিক ধস ও রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে এমন একটি পরিস্থিতি সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে।
ফলে প্রশ্ন জাগে, দুই দেশের মধ্যে শান্তি কি সত্যিই সম্ভব? ইতিহাস বলে, কাশ্মীর ইস্যু এবং সন্ত্রাসবাদের প্রশ্নে দুই পক্ষ কখনোই একমত হবে না। ভারতের সাম্প্রতিক হুঁশিয়ারি সেই দ্বন্দ্বকে আরও তীব্র করে তুলেছে। যদি সত্যিই “অপারেশন সিঁদুরের দ্বিতীয় সংস্করণ” শুরু হয়, তবে তা শুধু ভারত-পাকিস্তান নয়, পুরো দক্ষিণ এশিয়ার জন্য এক ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনবে।
এ মুহূর্তে আন্তর্জাতিক সমাজের উচিত দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সংলাপ পুনরায় শুরু করার আহ্বান জানানো। কারণ পারমাণবিক অস্ত্রে সজ্জিত এই দুই প্রতিবেশীর মধ্যে আরেকটি যুদ্ধ শুধু সীমান্তেই নয়, মানবিকতার মানচিত্রেও গভীর ক্ষত সৃষ্টি করবে। ভারতের সেনাপ্রধানের হুঁশিয়ারি তাই এক অর্থে সতর্কবার্তাও বটে—এটি জানিয়ে দেয়, সীমান্তে শান্তি এখনও অচল, আর যুদ্ধের ছায়া এখনও দিগন্তে ভাসছে।
আপনার মতামত জানানঃ