বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রতীক নিয়ে লড়াই নতুন কিছু নয়। স্বাধীনতার পর থেকেই ভোটের মাঠে রাজনৈতিক দলগুলোর অস্তিত্বকে চিহ্নিত করতে এবং ভোটারদের কাছে পৌঁছে দিতে প্রতীকের ভূমিকা অপরিসীম। বিশেষ করে যেসব দেশের উল্লেখযোগ্য অংশের ভোটার শিক্ষার দিক থেকে পিছিয়ে, সেখানে প্রতীক কেবল নির্বাচনী প্রক্রিয়ার অংশ নয়, বরং একটি দলের অস্তিত্ব, মর্যাদা ও জনপ্রিয়তার প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়। সাম্প্রতিক সময়ে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) যে শাপলা প্রতীককে ঘিরে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে টানাপোড়েনে জড়িয়েছে, সেটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে পুরনো বিতর্ককে নতুনভাবে সামনে এনেছে। বিষয়টি কেবল প্রতীকের নয়, বরং এটি দল ও কমিশনের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য, রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং ভবিষ্যৎ নির্বাচনী প্রক্রিয়ার ন্যায্যতা নিয়েও প্রশ্ন তুলে দিয়েছে।
এনসিপির উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন, তা একদিকে দলের প্রতীকের প্রতি তাদের একগুঁয়েমির প্রকাশ, অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের প্রতি সরাসরি চ্যালেঞ্জ। তিনি লিখেছেন, নির্বাচন কমিশন সচিব বলেছেন শাপলা প্রতীক তালিকায় নেই, তাই দেওয়া যাবে না। অথচ এনসিপি প্রথম নিবন্ধনের সময়েই পরিষ্কারভাবে এই প্রতীক চেয়েছিল। এই বক্তব্যের মধ্যেই ফুটে ওঠে বাংলাদেশের রাজনীতির এক বাস্তব চিত্র—দলগুলো মনে করে, কমিশনের হাতে ক্ষমতা থাকলেও তার প্রয়োগ হয় অন্য কারও ইশারায়। এই সন্দেহ নতুন নয়, বরং প্রতিটি নির্বাচনের আগে এমন অভিযোগ ওঠে যে নির্বাচন কমিশন স্বাধীন নয়, বরং শাসক দল কিংবা শক্তিশালী মহলের ইচ্ছার বাইরে কিছু করতে পারে না।
শাপলা প্রতীক কেন এত গুরুত্বপূর্ণ, সেই প্রশ্নে ফিরে আসতে হয় ভোটের মাঠে। বাংলাদেশের সাধারণ ভোটাররা প্রতীকের মাধ্যমে দলকে চেনে, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে। শাপলা একটি সহজ প্রতীক, যা বাংলার সাধারণ মানুষ শত শত বছর ধরে চিনে আসছে। এটি জাতীয় ফুল হিসেবেও মানুষের মনে স্থান করে নিয়েছে। তাই এই প্রতীক ভোটারদের কাছে সহজেই গ্রহণযোগ্য এবং স্মরণযোগ্য। এনসিপি মনে করে, এই প্রতীক তাদের জন্য স্বাভাবিকভাবেই বেশি উপযোগী। প্রতীক পরিবর্তন করতে হলে তাদের প্রচার কৌশল নতুনভাবে সাজাতে হবে, যা সময় ও অর্থ—দুটো ক্ষেত্রেই বড় ধরনের ক্ষতি বয়ে আনতে পারে। এই বাস্তবতার কারণেই সারজিস আলম এতটা জোর দিয়ে বলেছেন, অন্য কোনো প্রতীক মানা হবে না।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, একজন রাজনৈতিক সংগঠক কীভাবে নির্বাচন কমিশনকে এমন ভাষায় হুঁশিয়ারি দিতে পারেন যে, প্রতীক না দিলে তারা দেখে নেবে নির্বাচনের অবস্থা কেমন হয়? এই বক্তব্যের ভেতরেই নিহিত আছে বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংস্কৃতির এক অস্বস্তিকর দিক। বহু বছর ধরেই এখানে ক্ষমতার রাজনীতি চলে আসছে। রাজনৈতিক দল ও নেতারা মনে করেন, শক্তি প্রদর্শন করেই সবকিছু অর্জন করতে হয়। কমিশন কিংবা আদালতের রায়কে তারা প্রায়ই নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থের চশমা দিয়ে দেখেন। সারজিসের বক্তব্য তাই কেবল তার ব্যক্তিগত অবস্থান নয়, বরং দলীয় রাজনীতির একটি প্রচলিত কৌশলের প্রতিফলন।
অন্যদিকে, নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। একটি দলের নিবন্ধন প্রক্রিয়ার সময় যদি তারা পরিষ্কারভাবে শাপলা প্রতীক চেয়ে থাকে, তবে সেটি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার দায়িত্ব কমিশনেরই ছিল। তা না হলে আজকের এ সংকট তৈরি হতো না। এই ব্যর্থতা বা গাফিলতির দায় কমিশনের ওপরই বর্তায়। আবার এটিও ঠিক যে, প্রতীকের তালিকা একবার চূড়ান্ত হলে সেখানে নতুন করে সংযোজন করা আইনগতভাবে সম্ভব কি না, সেটিও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কমিশন হয়তো সেই আইনি বাধার দোহাই দিচ্ছে। কিন্তু জনগণের চোখে সেটি অজুহাত বলে মনে হতে পারে, কারণ অনেক সময় আইন পরিবর্তন বা সংশোধন করাও রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে।
এনসিপি বাংলাদেশের রাজনীতিতে তুলনামূলক নতুন দল হলেও তারা প্রতীক নিয়ে এতটা সরব হওয়ার মাধ্যমে নিজেদের অবস্থান জানান দিতে চাইছে। ছোট বা নতুন দলগুলোর জন্য প্রতীক আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ বড় দলের মতো তাদের এখনও প্রতিষ্ঠিত ভোটব্যাংক নেই। প্রতীকই তাদের পরিচয় গড়ে তোলে। তাই তারা যেকোনো মূল্যে প্রিয় প্রতীক ধরে রাখতে চাইবে, এমনকি সেটা যদি কমিশনের সঙ্গে সংঘাতে গিয়ে ঠেকে। সারজিস আলমের বক্তব্যকে তাই কেবল এক ধরনের উগ্রতা হিসেবে দেখা যাবে না, বরং এটিকে তাদের টিকে থাকার লড়াই হিসেবেও দেখা উচিত।
তবে হুমকির ভাষা ব্যবহার রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্য ক্ষতিকর। তিনি বলেছেন, “নাহলে কোন নির্বাচন কীভাবে হয় আর কে কীভাবে ক্ষমতায় গিয়ে মধু খাওয়ার স্বপ্ন দেখে, সেটা আমরাও দেখে নেব।” এই বক্তব্য ইঙ্গিত করে নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে অচল করার হুমকি। গণতন্ত্রে প্রতিযোগিতা অবশ্যই থাকতে হবে, তবে সেটি হতে হবে আইনি কাঠামোর ভেতরে থেকে। একটি দল যদি মনে করে কমিশন অন্যায় করছে, তাদের উচিত আদালতের শরণাপন্ন হওয়া বা রাজনৈতিক আন্দোলনের পথে যাওয়া। কিন্তু সরাসরি নির্বাচনের বিরুদ্ধে হুমকি দেওয়া গণতান্ত্রিক চর্চাকে দুর্বল করে দেয়।
প্রতীককে ঘিরে এই টানাপোড়েন আসলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের আরেকটি বড় সমস্যার প্রতিফলন—সবার কাছে নির্বাচনী প্রক্রিয়া গ্রহণযোগ্য নয়। নির্বাচন কমিশন বারবার বলেছে তারা স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করছে, কিন্তু বাস্তবে প্রতিটি নির্বাচনের আগে ও পরে বিরোধী দলের অভিযোগ থামে না। এই অবিশ্বাসের সংস্কৃতি ভাঙা না গেলে যতই প্রতীকের প্রশ্নে সমাধান হোক না কেন, নির্বাচনের ন্যায্যতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাবে।
এনসিপির শাপলা প্রতীক পাওয়ার দাবির পেছনে আরেকটি রাজনৈতিক কৌশলও থাকতে পারে। তারা জানে, বড় দলের ছায়ায় টিকে থাকতে হলে কোনো না কোনো প্রতীকে নিজেদের পরিচিত করতে হবে। শাপলা যেহেতু জাতীয় প্রতীক হিসেবে মানুষের মনে স্থান করে নিয়েছে, তাই সেটির জন্য তারা মরিয়া। আবার তাদের এই লড়াই সংবাদমাধ্যমে আলোচনায় আসছে, ফলে একটি ছোট দলও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে অনেক সময় সংবাদমাধ্যমে আলোচনায় থাকা টিকে থাকার কৌশল হিসেবেও কাজ করে।
সারজিস আলমের বক্তব্যকে তাই দুইভাবে পড়া যায়। একদিকে তিনি তার দলের রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষার চেষ্টা করছেন, অন্যদিকে তিনি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের প্রতি এক ধরনের চাপ সৃষ্টি করছেন। এই চাপ হয়তো বাস্তবে কাজ নাও করতে পারে, তবে এটি একটি রাজনৈতিক বার্তা দেয়—তাদের দল সহজে হাল ছাড়বে না। আবার যদি কমিশন প্রতীক না দেয়, তবে তারাও নির্বাচনের মাঠে নতুন কৌশল খুঁজে নেবে।
প্রশ্ন হচ্ছে, এই প্রতীকের বিতর্ক থেকে শিক্ষা কী নেওয়া যেতে পারে? প্রথমত, নির্বাচন কমিশনের উচিত নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় শুরু থেকেই স্বচ্ছতা বজায় রাখা। যদি কোনো দল নির্দিষ্ট প্রতীক চায়, তবে সেটি গ্রহণযোগ্য কি না স্পষ্টভাবে জানাতে হবে। দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক দলের উচিত আইনের পথ অনুসরণ করা। তারা যদি মনে করে কমিশন অন্যায় করছে, আদালতের দ্বারস্থ হওয়া ছাড়া বিকল্প নেই। তৃতীয়ত, রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে হুমকি নয়, যুক্তি ও গণআন্দোলনের জায়গা তৈরি করতে হবে।
বাংলাদেশের গণতন্ত্র এখনও পূর্ণাঙ্গ হয়নি। প্রতিবার নির্বাচনের আগে যে অস্থিরতা তৈরি হয়, সেটি গণতন্ত্রের শিকড়কে দুর্বল করে। প্রতীকের মতো একটি সাধারণ বিষয় নিয়েও যখন এমন উত্তেজনা সৃষ্টি হয়, তখন বোঝা যায় রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো কতটা ভঙ্গুর অবস্থায় আছে। সারজিস আলম হয়তো তার দলের স্বার্থেই এমন বক্তব্য দিয়েছেন, কিন্তু এই বক্তব্য বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতার অনেক গভীর সমস্যাকেই উন্মোচন করেছে।
শাপলা প্রতীক হয়তো আগামীতে এনসিপি পাবে, নাও পেতে পারে। কিন্তু এই বিতর্ক প্রমাণ করেছে যে প্রতীক কেবল চিহ্ন নয়, এটি দলীয় অস্তিত্বের প্রশ্ন, ভোটারদের সঙ্গে সংযোগের প্রশ্ন, আর একই সঙ্গে রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রশ্ন। আর এ কারণেই সারজিস আলমের মতো নেতারা সাহস করে এমন বক্তব্য দিতে পারেন। তারা জানেন, প্রতীক ছাড়া মাঠে টিকে থাকা প্রায় অসম্ভব। কমিশন যদি তাদের দাবি না মানে, তবে সেটি নিয়ে তারা যে রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তুলতে পারে, তাতে নির্বাচন প্রক্রিয়া আরও সংকটে পড়বে।
অবশেষে বলা যায়, শাপলা প্রতীককে ঘিরে এই লড়াই বাংলাদেশের গণতন্ত্রের এক প্রতিচ্ছবি। এখানে ক্ষমতার লড়াই যেমন তীব্র, তেমনি প্রতীকের মতো প্রতীকী বিষয়ও হয়ে ওঠে বড় রাজনৈতিক ইস্যু। সারজিস আলমের বক্তব্যকে তাই কেবল হুমকি হিসেবে নয়, বরং রাজনৈতিক বাস্তবতার একটি বহিঃপ্রকাশ হিসেবে দেখতে হবে। এই বাস্তবতা পরিবর্তন করা সহজ নয়, তবে তা পরিবর্তন না করতে পারলে ভবিষ্যতের প্রতিটি নির্বাচনই থেকে যাবে প্রশ্নবিদ্ধ।
আপনার মতামত জানানঃ