২০২৪ সালের আগস্টের শুরুতে ঢাকার গণভবনে যা ঘটেছিল, তা শুধু বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে নয়, সমসাময়িক বিশ্ব রাজনীতির মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণেও বিশেষ গুরুত্ব পাওয়ার যোগ্য। সেই সময় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের এক শুনানিতে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম প্রকাশ করেছিলেন, কীভাবে এক দীর্ঘ রাত এবং ভোরবেলার কয়েক ঘণ্টায় রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতার ভারসাম্য কেঁপে উঠেছিল।
ঘটনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ৫ আগস্ট সকালে যখন সামরিক বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা তাকে ক্ষমতা ছাড়ার জন্য চাপ দিচ্ছিলেন, তখন তিনি উচ্চারণ করেছিলেন—“আমাকে গুলি করে মেরে ফেলো, আর গণভবনে কবর দিয়ে দাও।” প্রথম শোনায় এটি মনে হতে পারে এক আবেগপ্রবণ প্রতিক্রিয়া, কিন্তু মনস্তত্ত্ব ও রাজনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, এই সংক্ষিপ্ত বাক্যে ফুটে ওঠে ক্ষমতার সঙ্গে ব্যক্তিসত্তার এমন এক একীভূত রূপ, যেখানে মৃত্যু ও শাসন একই সমান্তরালে দাঁড়িয়ে যায়।
শেখ হাসিনার বক্তব্যে রাষ্ট্র ও ব্যক্তি যেন মিশে যায় এক অবিচ্ছিন্ন সত্তায়। ক্ষমতা তার কাছে শুধু রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ নয়, বরং অস্তিত্বের একমাত্র স্বীকৃতি। সেই কারণে ক্ষমতা হারানো তার কাছে মৃত্যুর সমান। এমনকি মৃত্যুর স্থানও তিনি বেছে নিয়েছিলেন ক্ষমতার প্রতীকী কেন্দ্র—গণভবন। এই মানসিক অবস্থানকে মনোবিশ্লেষণে Thanatos of Power বলা যেতে পারে—এক ধরনের ধ্বংসাত্মক ক্ষমতাবোধ, যেখানে বেঁচে থাকা কিংবা মরার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে ক্ষমতায় অবিচল থাকা।
এই উক্তি আমাদের মনে করিয়ে দেয় ইতিহাসের সেই সব একনায়ককে, যারা পরাজয় মেনে নেননি। হিটলার ১৯৪৫ সালে বার্লিনের বাঙ্কারে আত্মহত্যা করেছিলেন, কারণ তার কাছে পরাজয় মানেই ছিল নিজের রাজনৈতিক সত্তার মৃত্যু। তার মরদেহ পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল, যাতে প্রতীকীভাবে তার উপস্থিতি অক্ষুণ্ণ থাকে। শেখ হাসিনার “গণভবনে কবর” ইচ্ছার মধ্যে সেই প্রতীকী অমরত্বের আকাঙ্ক্ষাই প্রতিফলিত হয়। যেন বলতে চাইছেন—“আমিই রাষ্ট্র, আমার মৃত্যু মানেই রাষ্ট্রের মৃত্যু।”
ফ্যাসিবাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো নেতা ও জাতির অবিচ্ছেদ্য একীকরণ। ইতালীয় দার্শনিক উমবের্তো একো তার Ur-Fascism প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন, ফ্যাসিবাদী নেতা বিশ্বাস করেন যে তিনি জাতির অবতার। শেখ হাসিনার বক্তব্যেও সেই প্রবণতার স্পষ্ট ছাপ রয়েছে। তার জন্য ক্ষমতা ছিল এক ধরনের আয়না, যেখানে নিজের প্রতিচ্ছবি ছাড়া অন্য কিছু কল্পনা করা যেত না। গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় পিতার সমাধির পাশে শায়িত হওয়ার বদলে গণভবনকে সমাধিস্থল হিসেবে ভাবা ছিল রাষ্ট্রক্ষমতার প্রতীকী দখলদারিত্বের চূড়ান্ত রূপ।
জুলাই ২০২৪-এর আন্দোলনের সময়, মাত্র ২১ দিনে কয়েক হাজার মানুষের মৃত্যু এবং কয়েক দশ হাজার আহত হওয়ার পরও শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছাড়ার কোনো ইঙ্গিত দেননি। বরং সেই সময় তার একমাত্র লক্ষ্য ছিল নিজের পদ রক্ষা করা। গণতান্ত্রিক নীতিতে একজন নির্বাচিত নেতার কাছে জনগণের জীবন ও নিরাপত্তা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাওয়ার কথা। কিন্তু এখানে তা উল্টো—ক্ষমতা রক্ষা ছিল প্রধান, নাগরিকের জীবন ছিল গৌণ।
এমন পরিস্থিতিতে যদি তার মধ্যে গণতান্ত্রিক চেতনা ও মানবিক মূল্যবোধ কাজ করত, তাহলে তিনি হয়তো বলতেন—“আমি পদত্যাগ করছি, যাতে আর রক্ত না ঝরে।” কিন্তু তিনি সে পথ বেছে নেননি। তার এই অবস্থান শুধু রাজনৈতিকভাবে নয়, নৈতিক দিক থেকেও গভীর প্রশ্নের জন্ম দেয়। এটি দায়িত্বহীনতা ও নিষ্ঠুরতার এমন এক রূপ, যা গণতান্ত্রিক নেতৃত্বের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
মনোবিজ্ঞানে বলা হয়, ক্ষমতা আসক্তি মাদকাসক্তির মতোই তীব্র হতে পারে। একজন শাসক যত দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকেন, ততই তিনি নিজের পরিচয়কে ক্ষমতার সঙ্গে এমনভাবে মেলান, যেখানে ক্ষমতা হারানো মানে আত্মবিলুপ্তি। শেখ হাসিনার ক্ষেত্রে এই প্রক্রিয়া এতটাই গভীরে গিয়েছিল যে, মৃত্যুকেও তিনি দেখতে চেয়েছিলেন ক্ষমতার কেন্দ্রের ভেতরে—গণভবনের মাটিতে।
এখানে প্রতীকী অমরত্বের ধারণা গুরুত্বপূর্ণ। কেউ কেউ মৃত্যুর পরও স্মৃতিতে বেঁচে থাকতে চান কর্মের মাধ্যমে, কিন্তু ফ্যাসিবাদী নেতারা চান স্থাপত্য, ভূখণ্ড বা রাষ্ট্রযন্ত্রের অংশ হয়ে থাকতে। মিশরের ফারাওরা তাদের পিরামিডে, কিম পরিবার উত্তর কোরিয়ার প্রাসাদে, আর শেখ হাসিনা চেয়েছিলেন গণভবনে। এই আকাঙ্ক্ষা ক্ষমতাকে ব্যক্তিসত্তার সঙ্গে এমনভাবে জড়িয়ে ফেলে যে, জীবনের অর্থ হয়ে দাঁড়ায় নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা, জনগণের সেবা নয়।
যখন রাষ্ট্র ও নেতার মধ্যে সীমারেখা ভেঙে যায়, তখন গণতন্ত্র ভেঙে পড়ে। “আমাকে হত্যা মানেই রাষ্ট্রকে হত্যা”—এমন চিন্তা সেই ভাঙনেরই লক্ষণ। এটি রাষ্ট্রকে জনগণের থেকে কেড়ে নিয়ে ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত করে। এর ফল হয় ধ্বংসাত্মক—জনগণ বঞ্চিত হয় তাদের অধিকার থেকে, আর রাষ্ট্র যন্ত্রে স্থায়ীভাবে ঢুকে যায় ব্যক্তিগত শাসনের ছায়া।
২০২৪ সালের সেই ভোরে, শেখ হাসিনার মনে হয়তো চলছিল দ্বন্দ্ব—ক্ষমতা হারানো নাকি মৃত্যু বরণ করা। কিন্তু তার বক্তব্য প্রমাণ করে, মৃত্যু বরণ করতে তিনি প্রস্তুত ছিলেন, ক্ষমতা ছাড়তে নয়। পরবর্তী সময়ে তার দেশত্যাগ এবং রাজনৈতিক পতন এক অর্থে এই মানসিকতারই স্বাভাবিক পরিণতি।
রাষ্ট্র মানুষের জন্য—এটি বেঁচে থাকার আশ্রয়স্থল, মর্যাদা ও স্বাধীনতার ক্ষেত্র। কিন্তু যখন রাষ্ট্রের প্রতীক হয়ে ওঠে কোনো ব্যক্তি, তখন সেটি জীবন রক্ষার জায়গা না হয়ে মৃত্যুর প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়। শেখ হাসিনার “গণভবনে কবর” ভাবনা ঠিক সেই রূপান্তরের চিহ্ন বহন করে—যেখানে রাষ্ট্র আর জনগণ নয়, বরং ক্ষমতা ও ব্যক্তি একীভূত হয়ে যায়, এবং সেই একীকরণ হয় ধ্বংসাত্মক, ফ্যাসিবাদী ও আত্মবিনাশী।
ইতিহাসে বহুবার দেখা গেছে, যারা রাষ্ট্রকে নিজের সঙ্গে একীভূত করে দেখেন, তাদের পতন অনিবার্য। কারণ রাষ্ট্র বেঁচে থাকে জনগণের ইচ্ছায়, কোনো এক ব্যক্তির ইচ্ছায় নয়। জনগণের জন্য জীবন রক্ষার চেয়ে নিজের ক্ষমতা রক্ষা করা—এমন সিদ্ধান্তই প্রমাণ করে, শাসক গণতন্ত্রের প্রতিনিধি নন, বরং রাষ্ট্রযন্ত্রের বন্দী। শেখ হাসিনার আগস্ট ২০২৪-এর মন্তব্য সেই সত্যেরই এক গভীর ও ভয়াবহ উদাহরণ হয়ে থাকবে ইতিহাসে।
আপনার মতামত জানানঃ