মঙ্গল গ্রহ নিয়ে মানুষের কৌতূহলের শেষ নেই। দূরের লালচে এই গ্রহ বারবার টেনে এনেছে বৈজ্ঞানিকদের নজর। যদিও আজও সেখানে মানুষ পা রাখেনি, তবুও একের পর এক মহাকাশযান, রোভার, ল্যান্ডার পৌঁছেছে মঙ্গলের বুকে। আর তাদের পাঠানো ছবি, তথ্য ঘেঁটে বিজ্ঞানীরা তৈরি করেছেন লাল গ্রহের অতীতের এক রোমাঞ্চকর চিত্র। এবার তারা যা আবিষ্কার করলেন, তা এক কথায় চমকে দেওয়ার মতো। মনে করা হচ্ছে, আজ থেকে প্রায় ৩০০ কোটি বছর আগে মঙ্গলের দক্ষিণাংশ জুড়ে ছিল বিশাল এক নদী-নেটওয়ার্ক। শুধু নদী নয়, শাখানদী, উপনদী মিলিয়ে প্রায় ১৬ হাজার কিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত ছিল নদী উপত্যকা।
এই গবেষণার সবচেয়ে চমকপ্রদ দিক হলো—এই অঞ্চলটি এত দিন পর্যন্ত মঙ্গলের একেবারে ‘জলহীন’ বা ‘শুষ্ক’ অঞ্চল হিসেবে পরিচিত ছিল। কিন্তু নতুন তথ্য বলছে, এই নির্জন ভূমিতেই এক সময় নিয়মিত বৃষ্টি হতো, বরফ গলত, আর সেখান দিয়েই বয়ে চলত ছোট-বড় হাজার হাজার নদী। ইংল্যান্ডের ওপেন ইউনিভার্সিটির গবেষক অ্যাডাম লুজ়কুট জানাচ্ছেন, “এটা এমন এক জায়গায় আবিষ্কৃত হয়েছে, যেখানে এত দিন জল থাকার প্রমাণ মেলেনি। অথচ সেই শুষ্ক ভূমিতেই দেখা গেল জলের চিহ্ন ছড়িয়ে রয়েছে বিশাল এলাকায়।”
এই নদীগুলির অনেকগুলির গভীরতা এতটাই বেশি যে কিছু কিছু নদীগর্ভ ১০০ মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত। গিরিখাত বা খাঁদের মতো ভূতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যগুলিও সেখানে পাওয়া গেছে, যা নদীর জলের ঘর্ষণের ফল বলেই মনে করছেন গবেষকেরা। মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার মার্স রিকনাইসেন্স অরবিটার (MRO) এবং মার্স গ্লোবাল সার্ভেয়ারের পাঠানো ছবি বিশ্লেষণ করে এই তথ্য মিলেছে। সেগুলি বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা ‘ফ্লুভিয়াল সাইনাস রিজ’ নামে একটি ভূ-প্রকৃতি চিহ্নিত করেছেন—যা প্রাচীন নদীবাহিত পলির রেখা শক্ত হয়ে তৈরি হয়। সময়ের সঙ্গে আশপাশের নরম মাটি ক্ষয়ে গিয়ে ওই কঠিন রেখাগুলি উন্মুক্ত হয়ে পড়ে, যা ইনভার্টেড চ্যানেল নামেও পরিচিত। এসব চিহ্নই মঙ্গলের নদী-নদীধারার সবচেয়ে বড় প্রমাণ।
সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক বিষয় হলো—এই নদীগুলো ছিল শুধুই নদী নয়, বরং তারা একটি জটিল জলপথের জালের মতো বিন্যস্ত ছিল। কোথাও দেখা গিয়েছে, দুটি পৃথক নদী গিয়ে মিশেছে একটি বৃহৎ গর্তে, যেখান থেকে আবার নতুন একটি নদী শুরু হয়েছে। এই ধরনের প্যাটার্ন পৃথিবীর নদীব্যবস্থার সঙ্গে অদ্ভুত রকমের মিল রাখে। ফলে বিজ্ঞানীদের ধারণা, একসময় মঙ্গলেও পৃথিবীর মতোই জলের প্রবাহ ছিল, পরিবেশ ছিল তুলনামূলকভাবে উষ্ণ ও আর্দ্র।
মঙ্গলে যে জল ছিল, তার প্রমাণ বিজ্ঞানীরা আগেই পেয়েছেন। এমনকি বরফ ও হিমবাহের অস্তিত্বও নিশ্চিত করা গিয়েছে আগের কিছু অভিযানে। কিন্তু এবার যা পাওয়া গেছে, তা শুধু এক জায়গায় নয়, বরং একটানা প্রায় ১৬,০০০ কিমি বিস্তৃত এক অববাহিকা। এতে বোঝা যায়, মঙ্গলের প্রাচীন আবহাওয়া ছিল অনেক বেশি প্রাণবান এবং জলসম্পদে সমৃদ্ধ। হয়তো একসময় সেই জলেই জন্ম নিতে পারত প্রাণের স্পন্দন।
তবে প্রশ্ন ওঠে—এত জল গেল কোথায়? বিজ্ঞানীরা বলছেন, এক সময় মঙ্গলের চৌম্বকক্ষেত্র ছিল শক্তিশালী, যা গ্রহটিকে সৌরবাতাসের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা করত। কিন্তু একসময় চৌম্বকক্ষেত্র ধসে পড়ে। ফলস্বরূপ সূর্যের তেজস্ক্রিয় কণা মঙ্গলের বায়ুমণ্ডলে আঘাত হানে এবং ধীরে ধীরে তা ক্ষয়ে যায়। এই কারণেই জলের বিশাল ভাণ্ডার হারিয়ে যায় মহাশূন্যে। কিন্তু বিজ্ঞানীদের ধারণা, এখনও মঙ্গলের উপরের তলে বা ভেতরের গর্ভে কোথাও না কোথাও কিছু জল থেকে যেতে পারে। সেই জল হয়তো এখনও পাতালের নদীর মতো গোপনে বইছে, কেবল আমাদের চোখের আড়ালে।
এই আবিষ্কার শুধু মঙ্গলের অতীত জানার ক্ষেত্রেই নয়, বরং ভবিষ্যতের জন্যও অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। যদি কখনও মানুষ মঙ্গলে বসতি গড়ার পরিকল্পনা করে, তাহলে এই ধরনের প্রাচীন জলের চিহ্ন ও সম্ভাব্য ভূগর্ভস্থ জল তাদের জীবনের অন্যতম সহায়ক হয়ে উঠতে পারে।
এই আবিষ্কার আরও একবার প্রমাণ করে, মহাকাশ ও গ্রহ-নক্ষত্রের জগতে এখনও অজানা রহস্যের শেষ নেই। যে মঙ্গলকে এত দিন ‘মৃত’ ও ‘শুষ্ক’ বলে মনে করা হতো, সেখানে এত প্রাণময় অতীত লুকিয়ে রয়েছে, ভাবা যায়? বিজ্ঞানীদের হাতে আসা প্রতিটি নতুন ছবি, প্রতিটি তথ্য যেন উন্মোচন করে মঙ্গলের বুকে লুকিয়ে থাকা ইতিহাসের আরও এক কণিকা। এবং সেই ইতিহাসে লেখা রয়েছে নদী, বরফ, বৃষ্টি আর জলপ্রবাহের রোমাঞ্চকর গল্প। বিজ্ঞান জানে, একদিন হয়তো সেই গল্পের প্রমাণ পাওয়া যাবে আরও গভীরে। তখন হয়তো মঙ্গল আর পৃথিবীর তফাতটাও ছোট মনে হবে।
আপনার মতামত জানানঃ