ইউক্রেনের ওপর পশ্চিমা শক্তির রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব নতুন কিছু নয়। তবে সাম্প্রতিক একটি খনিজ চুক্তির মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র, বিশেষ করে সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ মহলের সরাসরি স্বার্থ সংশ্লিষ্টতা নতুনভাবে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। ১৬ জুন ইউক্রেন সরকার দেশের লিথিয়াম খনির দরপত্র আহ্বান করে, যা যুক্তরাষ্ট্র-ইউক্রেনের একটি পূর্ব চুক্তির ধারাবাহিকতায় এসেছে। এতে অংশ নেওয়া কনসোর্টিয়ামের পেছনে রয়েছেন রোনাল্ড এস লডার—ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত এক ব্যবসায়ী।
এই চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র-ইউক্রেন যৌথভাবে বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত নেবে, মার্কিন কোম্পানিগুলো টেন্ডারে অগ্রাধিকার পাবে, আর মুনাফার ওপর কোনো করও আরোপ হবে না। চুক্তিকে ইউক্রেনীয়রা নিজেদের পক্ষে বললেও এর কাঠামো পর্যালোচনা করলে স্পষ্ট হয় যে এটি ইউক্রেনের সার্বভৌম সম্পদে বিদেশি হস্তক্ষেপের আরেকটি দৃষ্টান্ত। অনেকেই এটিকে একটি যুদ্ধরত দেশের দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে শোষণের চেষ্টা হিসেবে দেখছেন।
এই চুক্তি একা কোনো ঘটনা নয়—বরং পশ্চিমা শক্তির দীর্ঘদিনের ইউক্রেন-নীতি বাস্তবায়নের আরেকটি ধাপ মাত্র। ২০১৪ সালে জো বাইডেনের ছেলে হান্টার বাইডেন ইউক্রেনের গ্যাস কোম্পানি বুরিসমার বোর্ডে যোগ দেন, তখনো ইউক্রেন রাজনৈতিকভাবে অস্থির ও পশ্চিমা প্রভাবাধীন ছিল। এর পরপরই দেখা যায়, বাইডেন নিজে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টকে হুমকি দিচ্ছেন দেশটির প্রধান আইন কর্মকর্তাকে বরখাস্ত না করলে এক বিলিয়ন ডলার সহায়তা বন্ধ করা হবে।
এই প্রেক্ষাপটে ট্রাম্পের সময়ের খনিজ চুক্তি যেন এক রূঢ় বাস্তবতার প্রকাশ—যেখানে পশ্চিমা নেতারা নিজেরাই স্বার্থ উদ্ধারে ইউক্রেন সরকারকে চাপে রাখেন। শুধু পার্থক্য এই যে, ট্রাম্প সেটা করেছেন প্রকাশ্যে, যা অন্যরা করেন পর্দার আড়ালে।
প্রকৃতপক্ষে পশ্চিমাদের চাপের কারণে ইউক্রেন এমন কিছু আইন পাস করতে বাধ্য হয়েছে, যা জনমত কিংবা দেশের স্বার্থের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ ছিল না। ২০২০ সালে ব্যক্তিমালিকানাধীন কৃষিজমি বিক্রির নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার বিলটি পাস হয় ব্যাপক জনবিরোধিতা সত্ত্বেও। এই সংস্কারের ফলে বৃহৎ কোম্পানিগুলো ইউক্রেনের কৃষিখাতের নিয়ন্ত্রণ নেয় এবং খাদ্য নিরাপত্তার সংকট দেখা দেয়। এক জরিপে দেখা গেছে, ২০২২ সালে ইউক্রেনের ২৮ শতাংশ মানুষ মাঝারি থেকে তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগেছে, যা ইউরোপীয় ইউনিয়নের গড়ের তুলনায় দ্বিগুণের বেশি।
এমনকি জেলেনস্কি প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরেও এই চাপ থামেনি। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্মিলিত চাপে ইউক্রেনের বিচারব্যবস্থায় বিদেশি ‘বিশেষজ্ঞদের’ ভূমিকাকে বাধ্যতামূলক করা হয়। ফলে হাই কাউন্সিল অব জাস্টিসের মতো সংস্থায় বিদেশি সদস্যরাই হয়ে ওঠে ক্ষমতার নিয়ন্ত্রক। নিজ রাজনৈতিক দলের সদস্যদের বিরোধিতার মধ্যেও জেলেনস্কিকে এসব সংস্কার বাস্তবায়ন করতে হয়েছে।
ইউক্রেনের অর্থনীতি শিল্পভিত্তিক থেকে কৃষিভিত্তিক হওয়ার দিকে একধরনের প্রক্রিয়াজাত রূপান্তর ঘটেছে। ২০১০ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে শিল্প খাতের অবদান জিডিপিতে হ্রাস পায়, আর কৃষি খাতের অংশ বেড়ে যায়। অথচ এই কৃষি সম্প্রসারণ হয়েছে রপ্তানিমুখী একফসলি চাষের মাধ্যমে, যেমন সূর্যমুখী, ভুট্টা, সয়াবিন। এতে করে ইউক্রেনের খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থায় একধরনের ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয় এবং ৪০ শতাংশ কৃষিজমি উর্বরতা হারানোর ঝুঁকিতে পড়ে।
ইউক্রেনের ইউরোপের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির ফলাফলও তাদের অনুকূলে যায়নি। ইউরোপীয় পণ্যে ইউক্রেনের বাজার সয়লাব হয়ে গেলেও ইউক্রেনীয় পণ্য ইউরোপে প্রবেশ করতে পারেনি। ২০২১ সালে ইউক্রেনের বাণিজ্য ঘাটতি ছিল চার বিলিয়ন ইউরো। ফলে ইউক্রেন থেকে রপ্তানি হচ্ছে কাঁচামাল, আর আমদানি হচ্ছে প্রক্রিয়াজাত পণ্য ও যন্ত্রপাতি।
এইসব অর্থনৈতিক চাপের ফলে ইউক্রেনের শিল্প খাত মুখ থুবড়ে পড়ে। ২০১৯ সালের মধ্যে গাড়ি, যন্ত্রপাতি, ধাতব ও কৃষি যন্ত্রপাতি উৎপাদনে ভয়াবহ পতন ঘটে। এর জবাবে জেলেনস্কি সরকার শিল্পখাত রক্ষায় আইন প্রণয়ন করতে চাইলেও, পশ্চিমাদের সমালোচনার মুখে পড়ে সেই উদ্যোগে নানা ছাড় দিয়ে তা পাস করতে হয়।
সবমিলিয়ে দেখা যাচ্ছে, ইউক্রেনের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, বিচারব্যবস্থা, খনিজ সম্পদ, কৃষি ও শিল্প—সবখানেই রয়েছে পশ্চিমাদের সুস্পষ্ট চাপ ও হস্তক্ষেপ। ট্রাম্পের খনিজ চুক্তি শুধু এই চিত্রের এক উন্মোচন, যে চিত্র এতদিন ঢাকা ছিল কূটনৈতিক পর্দার আড়ালে। ইউক্রেনের ‘সার্বভৌমত্ব’ এখন এক প্রশ্নবোধক চিহ্ন। এই পরিস্থিতিতে পশ্চিমাদের নৈতিক অবস্থান নিয়েও নতুন করে প্রশ্ন উঠছে—যেখানে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের কথা বলে তারা যে কৌশলে অর্থনৈতিক উপনিবেশ তৈরি করছে, তা আগের ঔপনিবেশিক ইতিহাসকেও হার মানাচ্ছে।
আপনার মতামত জানানঃ