পারস্য উপসাগরের হরমুজ প্রণালিকে কেন্দ্র করে আবারও উত্তপ্ত হয়ে উঠছে মধ্যপ্রাচ্য। রয়টার্সের এক বিশেষ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ইরান সম্প্রতি তাদের সামরিক নৌযানে সামুদ্রিক মাইন বোঝাই করেছে—এমন তথ্য হাতে আসার পর যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ব্যাপক উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ে। মার্কিন গোয়েন্দাদের ভাষ্য অনুযায়ী, তেহরান সম্ভবত ইসরায়েলের একের পর এক হামলার জবাবে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক রুট হরমুজ প্রণালি বন্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিল।
গোপন গোয়েন্দা তথ্য বিশ্লেষণ করে এই আশঙ্কার জন্ম হয়। যুক্তরাষ্ট্রের দুই শীর্ষ কর্মকর্তার ভাষায়, ইরানে ১৩ জুন ইসরায়েলের একটি ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পরপরই এই মাইন বোঝাইয়ের প্রস্তুতির বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়। যদিও এখনও পর্যন্ত প্রণালিতে এসব মাইন ব্যবহার করা হয়নি, কিন্তু বিষয়টি ইঙ্গিত দেয় যে ইরান হয়তো এবার সত্যিই এই পথ বন্ধ করার বিষয়ে চিন্তা করছিল।
হরমুজ প্রণালি বিশ্বের সবচেয়ে ব্যস্ত এবং গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক পথগুলোর একটি, যার মধ্য দিয়ে বৈশ্বিক তেল ও গ্যাস সরবরাহের প্রায় ২০ শতাংশ পরিবাহিত হয়। সৌদি আরব, কুয়েত, ইরাক, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও কাতারের মতো দেশগুলো এই পথ দিয়েই এশিয়া ও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে জ্বালানি রপ্তানি করে। এমন একটি পথ যদি হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়, তবে জ্বালানি সরবরাহে বিশৃঙ্খলা দেখা দেওয়ার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির আশঙ্কা থাকে।
তবে আশ্চর্যজনকভাবে, হরমুজ প্রণালি বন্ধ না হওয়ায় বরং অপরিশোধিত তেলের দাম ১০ শতাংশের বেশি কমেছে সম্প্রতি। বিশ্লেষকদের মতে, সামগ্রিক উত্তেজনার মধ্যেও ইরান এই প্রণালি বন্ধ না করায় বাজারে কিছুটা স্থিতি ফিরে এসেছে।
ইরানের পক্ষ থেকে কখন এবং কীভাবে মাইন বসানো হয়েছে, তা স্পষ্ট নয়। এমনকি মাইনগুলো পরে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে কি না, সেটিও নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি। যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা ইঙ্গিত দিয়েছেন, উপগ্রহ চিত্র বা সরাসরি গুপ্তচরবৃত্তির মাধ্যমেই হয়তো এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
২২ জুন যুক্তরাষ্ট্র ‘মিডনাইট হ্যামার’ নামে একটি সামরিক অভিযানের মাধ্যমে ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালায়। এর প্রতিক্রিয়ায় ইরানি পার্লামেন্ট হরমুজ প্রণালি বন্ধের বিষয়ে একটি প্রস্তাবে সম্মতি দেয়। যদিও এই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত নয় এবং কেবলমাত্র ইরানের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদই তা বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
পাশাপাশি ইরানের সামরিক বাহিনী হয়তো কৌশলগতভাবে এই প্রস্তুতি নিয়েছিল, যাতে শত্রুপক্ষকে এক ধরনের বার্তা দেওয়া যায়। আবার কেউ কেউ মনে করছেন, এটি শুধুই শীর্ষ নেতৃত্বের নির্দেশ পাওয়ার আগের প্রস্তুতি।
হরমুজ প্রণালি ওমান ও ইরানের মাঝখানে অবস্থিত, যার সবচেয়ে সরু অংশ মাত্র ২১ মাইল চওড়া। এর মধ্যে নৌচলাচলের পথ মাত্র ২ মাইল প্রশস্ত। এই সরু পথে প্রতিদিন শত শত তেলবাহী জাহাজ চলাচল করে। ২০১৯ সালের এক তথ্য অনুযায়ী, ইরানের কাছে ৫,০০০-এর বেশি সামুদ্রিক মাইন ছিল, যেগুলো দ্রুতগামী ছোট নৌযানে সহজেই বসানো সম্ভব।
এদিকে বাহরাইনে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের পঞ্চম নৌবহর সাধারণত চারটি মাইন ক্লিয়ারেন্স জাহাজ ব্যবহার করে থাকে। বর্তমানে সেই বহরের জায়গায় যুক্ত হচ্ছে ‘লিটোরাল কমব্যাট শিপ’, যার মাইন প্রতিরোধ ক্ষমতাও রয়েছে। ইরানে হামলার আগে যুক্তরাষ্ট্র বাহরাইন থেকে এই মাইন ক্লিয়ারেন্স জাহাজগুলো সরিয়ে নেয়, যা ইঙ্গিত দেয় তারা আগাম প্রস্তুতি নিচ্ছিল।
ইরান পরে যুক্তরাষ্ট্রের কাতার ঘাঁটিতে সীমিত প্রতিক্রিয়াস্বরূপ ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। তবে ওয়াশিংটনের আশঙ্কা, তেহরান ভবিষ্যতে আরও কঠোর পাল্টা ব্যবস্থা নিতে পারে।
হোয়াইট হাউসের এক মুখপাত্র দাবি করেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের দক্ষ নেতৃত্বে পরিচালিত ‘মিডনাইট হ্যামার’ অপারেশন, হুতিদের বিরুদ্ধে অভিযান এবং সর্বোচ্চ চাপ প্রয়োগের কৌশলের ফলে হরমুজ প্রণালির নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে এবং ইরান এখন অনেকটাই দুর্বল।
সব মিলিয়ে পরিস্থিতি এখনও উত্তেজনাপূর্ণ। যদিও প্রণালি বন্ধ হয়নি, কিন্তু গোটা বিশ্বের নজর এখন এই অঞ্চলের দিকে। ইরান যদি হঠাৎ করে হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দেয়, তবে তা শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, গোটা বৈশ্বিক অর্থনীতিতেই বড়সড় প্রভাব ফেলতে পারে।
আপনার মতামত জানানঃ