মহামারি করোনাভাইরাসে যখন সারা পৃথিবী সয়লাব, তখন এই মরণব্যাধি ঠেকাতে সদ্য আবিষ্কৃত ভ্যাকসিন নিয়ে জীবন বাঁচাতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছে পৃথিবীর মাত্র ১৪ শতাংশ মানুষ। আর বাকি ৮৬ শতাংশ মানুষের কপালে কী ঘটবে, এনিয়ে ভাবছে না ধনী রাষ্ট্রগুলো। করোনা মহামারি প্রতিরোধক ভ্যাকসিন ব্যবহারের ফলে ধনী দেশগুলোর রাষ্ট্রনেতারা তাদের নিজ নিজ দেশের জনগণকে স্বাস্থ্যসুরক্ষা ও মৃত্যুহার হ্রাস পাবে বলে আশ্বস্ত করছেন। নিজ দেশের বাইরেও যে আরও দেশ, আরও মানুষ রয়েছে, সেই বিষয়টিতে এখন তাদের তেমন নজর নেই। ধনী দেশগুলো অনেকটা ভ্যাকসিনের একচেটিয়া মজুদ শুরু করেছে। এটি দরিদ্র দেশগুলোতে মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখবে। এতে বিশ্ব অর্থনীতি ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়বে বলে নতুন এক গবেষণায় উঠে এসেছে। এতে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের ধাক্কা উন্নয়শীল দেশগুলোর মতো উন্নত দেশগুলোতেও লাগবে। খবর নিউইয়র্ক টাইমস।
গতকাল মঙ্গলবার প্রকাশিত গবেষণায় দেখা গেছে, সবচেয়ে কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেও চলতি বছরের মাঝামাঝিতে ধনী দেশগুলো তাদের শতভাগ নাগরিককে টিকাদান কর্মসূচির আওতায় আনতে পারবে। অথচ তখনো ভ্যাকসিনেশন থেকে অনেক দূরে থাকবে দরিদ্র দেশগুলো।
গবেষণাটি বলছে, এর ফলে বৈশ্বিক অর্থনীতি ৯ ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি ক্ষতির মুখোমুখি হবে। এ অংকটি জাপান ও জার্মানির সম্মিলিত বার্ষিক জিডিপির চেয়েও বড়। তবে এ ক্ষতিতে এখানে অর্ধেকের বেশি মূল্য চুকাতে হবে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও ব্রিটেনের মতো ধনী দেশগুলোকে।
গবেষকরা যেটিকে বলছেন ‘খুব সম্ভাব্য’ সেই চিত্রটি বলছে, বছর শেষে উন্নয়নশীল দেশগুলো হয়তো তাদের অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে ভ্যাকসিন দিতে পারবে। তখন বিশ্ব অর্থনীতিকে ১ দশমিক ৮ ট্রিলিয়ন থেকে ৩ দশমিক ৮ ট্রিলিয়নের ধাক্কা সামলাতে হবে। এক্ষেত্রেও ধনী দেশগুলোকে অর্ধেকের বেশি ক্ষতি বহন করতে হবে।
ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্সের সহায়তায় পরিচালিত গবেষণাটি এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে যে, ভ্যাকসিনের ন্যায়সঙ্গত বণ্টন সব দেশের অর্থনৈতিক স্বার্থের জন্য জরুরি, বিশেষ করে সেসব দেশ, যারা বাণিজ্যের ওপর অধিক নির্ভর করে। পাশাপাশি এটি সেই ধারণাটির সমালোচনা করে যেখানে বলা হয়, ভ্যাকসিন ভাগাভাগি করা মানে দরিদ্র দেশকে সহায়তা করা।
এ গবেষণাটির একজন গবেষক সেলভা ডেমিরালপ বলেন, স্পষ্টত সব অর্থনীতি একটি আরেকটির সঙ্গে যুক্ত। অন্য অর্থনীতিগুলোর পুনরুদ্ধার করা ছাড়া কোনো অর্থনীতিই পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না।
কক ইউনিভার্সিটি, হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি এবং ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ডের সঙ্গে যুক্ত অর্থনীতিবিদদের একটি দল ৬৫টি দেশের ৩৫টি শিল্পের বাণিজ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে অসম ভ্যাকসিন বিতরণের অর্থনৈতিক প্রভাবগুলো খতিয়ে দেখেছেন।
উন্নয়নশীল দেশগুলো ভাইরাসের বিস্তার থামানোর লক্ষ্যে লকডাউনের কারণে যদি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের বাইরে থেকে যায়, তখন তাদের হাতে খরচ করার জন্য খুব সামান্য অর্থই থাকবে। যে কারণে উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ ও এশিয়ার রফতানিকারকদের বিক্রি হ্রাস পাবে। পাশাপাশি উন্নত বিশ্বের বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকেও ব্যাপকভাবে সংকটে পড়তে হবে।
এই মুহূর্তে বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের মুখে সর্বত্র করোনাপ্রতিরোধী ভ্যাকসিন সংগ্রহ নিয়ে কথা হচ্ছে। কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে এই ভ্যাকসিনের ক্রয় বাণিজ্য ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে ধনী দেশগুলোর আধিপত্য বেশি করে চোখে পড়ছে। বিশ্বজুড়ে এই সংকটময় অবস্থার আলোকে বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন ‘পিপলস ভ্যাকসিন অ্যালায়েন্স’ বা সর্বজনের জন্য টিকা জোট নামে একত্র হয়েছে। এদের মধ্য অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, ফ্রন্টলাইন এইড, গ্লোবাল জাস্টিস নাউ, অক্সফাম, কারিতাস প্রভৃতি সংগঠনগুলো রয়েছে।
নবগঠিত পিপলস ভ্যাকসিন অ্যালায়েন্স বলছে, তাদের এই জোট বিশ্বের সব মানুষের জন্য করোনাপ্রতিরোধী ভ্যাকসিন চাই, তা নিশ্চিত করার বিষয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকবে। তারা বলছে ভ্যাকসিন বিষয়ে ধনী দেশগুলো এমন কোনো প্রভাব খাটানো বা মজুত করা উচিত নয়, যাতে অন্য দেশগুলোর ভ্যাকসিন পেতে সমস্যা হতে পারে।
অক্সফামের প্রধান স্বাস্থ্য আধিকারিক আনা ম্যারিয়ট বলেছেন, ‘মুনাফার আগে মানুষের জীবন নিয়ে ভাবতে হবে। কার পকেটে কত টাকা রয়েছে, তাই যদি জীবনরক্ষাকারী ভ্যাকসিন ব্যবহারের মানদণ্ড হয়, তবে পৃথিবীর অসংখ্য মানুষ এই মহামারি প্রতিরোধে টিকা নিতে অসমর্থ হবে।’
গ্লোবাল জাস্টিস নাওয়ের হাইডি চৌ বলেছেন, বিজ্ঞানের অর্জন যেন মানুষের জীবনরক্ষাকারী না হয়ে শুধু ওষুধ কোম্পানিগুলোর মুনাফা অর্জনের পথ না হয়।
ফ্রন্টলাইন এইডসের পরিচালক লোইস চিংগান্দুর মতে, এই মহামারিটি একটি বিশ্বব্যাপী সমস্যা, যার একটি বৈশ্বিক সমাধান প্রয়োজন। আর যতক্ষণ না পৃথিবীর বেশির ভাগ মানুষের এই ভ্যাকসিন নেওয়ার সামর্থ্য রইবে না, ততক্ষণ বিশ্বব্যাপী অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকবে।
গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিনস অ্যান্ড ইমিউনাইজেশন বা গ্যাভি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে সঙ্গে নিয়ে বিশ্বজুড়ে গরিব দেশগুলোর জন্য স্বল্পমূল্যে টিকা দেওয়ার বিষয়ে উদ্যোগ নিয়েছে। এ ছাড়া ইইউ কমিশন ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রাথমিক উদ্যোগে, সংক্রামক রোগ ও মহামারির টিকা তৈরির জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতামূলক সংস্থার (সিইপিআই) নেতৃত্বে করোনার টিকা সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও বিতরণের বৈশ্বিক উদ্যোগ কোভ্যাক্স গড়ে উঠেছে। কোভ্যাক্স স্বল্প ও মধ্যম আয়ের ৯২টি দেশকে করোনা টিকা সংগ্রহে সহায়তা দেবে বলে জানিয়েছে। মার্কিন টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ফাইজার (বায়োএনটেক) জানিয়েছে, তারা দরিদ্র দেশগুলোকে ৪০ মিলিয়ন তথা ৪ কোটি করোনার টিকা দিবে। গত ২২ জানুয়ারি কোভ্যাক্সের মাধ্যমে কোনও মুনাফা ছাড়াই উৎপাদন মূল্যে ভ্যাকসিন দেওয়ার ঘোষণা দেয় তারা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮১১
আপনার মতামত জানানঃ