আইনের ভাষায় একটা কথা বিশ্বব্যাপী প্রচলিত আছে, প্রয়োজনে দশজন অপরাধী ছাড়া পেয়ে যাক তবুও যেন একজন নিরপরাধীর সাজা না হয়। বিশ্বের সমস্ত বিচার ব্যবস্থায় এই কথাটি মোটা অক্ষরে স্মরণে রাখা হয়। নিরপরাধীর সাজা যেন না হয় সেজন্য সজাগ দৃষ্টি রাখা হয়। তারিখের পর তারিখ, বিভিন্ন সাক্ষ্য প্রমাণ যাচাই বাছাই শেষে আদালত এইজন্যই বিচারের রায় প্রদান করে থাকেন যাতে ফাঁক-ফোঁকরে কোনো নিরপরাধীর সাজা না হয়ে যায়। বাংলাদেশেও এই রীতি রয়েছে। তবুও কোথায় কার যেন ভুলে কীভাবে যেন নিরপরাধীর সাজা হয়ে যায়। এদেশে এই সংখ্যাটা নেহাত কম নয়। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দেশে নিরপরাধীর সাজাভোগের উদাহরণ খুঁজে দেখলে দেখা যাবে প্রকৃত আসামির সংখ্যার চেয়ে অতো একটা কম নয়।
এই তো বছর কয়েক আগে ঘটে যাওয়া জাহালামের ঘটনা কেইবা না জানে। সোনালী ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতি না করেও চেহারা আর গ্রামের ক্ষাণিকটা মিল থাকায় তাকে তিন বছর জেল খাটতে হয়েছে। আদালত ক্ষতিপূরণ দিয়ে তাকে মুক্তি দিলেও ফিরিয়ে দিতে পারেনি তার তিনটি বছর।
এরপর নামের কিছুটা মিল থাকায় আরমান বিহারীর সাজাভোগের ঘটনাও তো আলোড়ন সৃষ্টিকারী। ২০০৫ সালের ৩০ আগস্ট রাজধানীর পল্লবী থেকে ৪০ বোতল ফেনসিডিল উদ্ধারের ঘটনায় শাহাবুদ্দিন ও তার দুই সহযোগীর নামে মামলা করে পুলিশ। দুই বছর কারাভোগের পর জামিনে মুক্তি পেয়ে আত্মগোপন করেন শাহাবুদ্দিন। ২০১১ সালের ১৭ জানুয়ারি আত্মসমর্পণ করে জামিন পেলে আবারও ফেরারি হন তিনি। পরের বছরের ১ অক্টোবর ঢাকার একটি আদালত শাহাবুদ্দিনকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেয়। এ মামলায় ২০১৬ সালের ২৭ জানুয়ারি পল্লবীর বেনারসি কারিগর মো. আরমানকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এরপর দুজনের বাবার নামের ভুলে আরমানকে বিনাদোষে পাঁচ বছর জেল খাটতে হয়। গত ৩১ ডিসেম্বর হাইকোর্টের রায়ে তিনি মুক্তি পান। আরমানকে ২০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে পুলিশকে এবং এ ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট। যদিও ক্ষতিপূরণের আদেশ চেম্বার আদালতে স্থগিত হয়েছে।
আলোড়ন না তুললেও এসবের বাইরেও রয়েছে অজস্র ঘটনা। তবে অতোটা আলোড়ন তুলতে না পারলেও দেশ রুপান্তরের মাধ্যমে আলোচিত কয়েকটি ঘটনার কথা জানা যায়।
স্ত্রী-সন্তান খুনের অভিযোগে খুলনার রূপসার শেখ জাহিদকে ২০০০ সালের ২৫ জুন বাগেরহাটের বিচারিক আদালত তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। এরপর কনডেম সেলে কাটে চার বছর। ২০০৪ সালের ৩১ জুলাই হাইকোর্টে বিচারিক আদালতের রায় বহাল থাকে। এরপর চূড়ান্ত নিষ্পত্তির জন্য আরও ১৬ বছর অপেক্ষা। অবশেষে গত বছরের ২৫ আগস্ট প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে আপিল বিভাগ জাহিদকে হত্যার দায় থেকে বেকসুর খালাস দেয়। ৩১ আগস্ট খুলনা কারাগার থেকে তিনি যখন মুক্তি পান তখন তার বয়স ৫০। খুন না করেও জাহিদের যৌবনের মূল্যবান ২০ বছর কাটাতে হয়েছে কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে। মামলার তদন্ত ও অভিযোগপত্রে অসংগতি, বিচারিক প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতা, সংশ্লিষ্টদের অবহেলার কারণে এমন ঘটনা ঘটেছে বলে জানা যায়।
১৯৯৬ সালের ২১ ডিসেম্বর যশোরের শার্শায় খুন হয় রওশন আলী (১৫)। ২০০০ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি এ মামলায় বিচারিক আদালত শফিকুল ইসলামসহ (১৬) তিন আসামির যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেয়। ঘটনার সময় শফিকুলের বয়স ছিল ১৬ বছর। ২০০৭ সালের ৭ মে হাইকোর্টে বিচারিক আদালতের রায় বহাল থাকে। গত ১৩ জানুয়ারি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায়ে খালাস পান শফিকুল। ইতিমধ্যে তার জীবন থেকে ঝরে গেছে ২০টি বছর। রায়ে বলা হয়, শফিকুল কারাগারে থাকলে তাকে যেন অবিলম্বে মুক্তি দেওয়া হয়। একই সঙ্গে এ মামলার বিচার প্রক্রিয়াকে একটি ‘বড় ধরনের ভুল’ (বিগ মিসটেক) আখ্যায়িত করে সর্বোচ্চ আদালত। শফিকুলের জীবন এতটাই এলোমেলো যে আপিল বিভাগে রায়ের দিন তার কোনো আইনজীবী ছিলেন না। এমনকি তিনি কারাগারে নাকি জামিনে মুক্ত, সে বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের কাছে কোনো তথ্য নেই।
ভারত থেকে গরু পাচারের অভিযোগে ১৯৮৬ সালে যশোরের শার্শা থানায় আবদুল কাদের ও মফিজুর রহমানের নামে মামলা হয়। একই বছর যশোরের একটি আদালত তাদের পাঁচ বছর করে কারাদন্ড দেয়। সাজার বিরুদ্ধে ১৯৮৭ সালে যশোর হাইকোর্টে (তখন হাইকোর্টের বিভাগীয় বেঞ্চ ছিল) আপিল করেন দুজন। ওই বছর যশোর হাইকোর্টের বেঞ্চ অবলুপ্ত হলে আবেদনটি ঢাকায় স্থানান্তর করা হয়। সাজার মেয়াদ শেষে আবদুল কাদের ও মফিজুর রহমান ১৯৯১ সালে মুক্তি পান। কিন্তু উচ্চ আদালতে এ আপিলটি নিষ্পত্তি হয়নি। বিচারিক আদালতের রায়ের ৩২ বছর এবং সাজা ভোগের ২৭ বছর পর ২০১৮ সালের ২০ মার্চ হাইকোর্টের রায়ে দুই আসামি খালাস পান। তবে মফিজুর রহমান এ রায়ের আগেই মারা যান।
একজন নিজের নির্দোষের রায় দেখে যেতে পারেননি। অন্যজন আবদুল কাদেরের বয়স ৭০ পেরিয়েছে। কৃষিকাজ করে কোনো মতে জীবনধারণ করছেন। তিনি সামাজিক, পারিবারিক ও আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। মূলত বিচারের দীর্ঘসূত্রতার কারণে এমন ঘটনা ঘটেছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
এসএসসি পরীক্ষার নম্বরপত্র জালিয়াতির মামলায় ১৫ বছরের সাজা হয় নোয়াখালীর কামরুল ইসলামের। কিন্তু এক দশক ধরে মামলার তদন্ত শেষে আদালতের বিচারে যার সাজা হলো তার সঙ্গে অপরাধের সংশ্লিষ্টতা নেই বিন্দুমাত্র। শুধু ঠিকানার সামঞ্জস্যে মূল আসামি কামরুলের জায়গায় নিরপরাধ কামরুলের বিরুদ্ধে সাজা এবং গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়। এ ঘটনা গড়ায় উচ্চ আদালত পর্যন্ত। গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পর হাইকোর্টে রিট আবেদন করেছিলেন নিরপরাধ কামরুল। গতকাল মঙ্গলবার(২৬ জানুয়ারি) দুদকের দেওয়া প্রতিবেদন ও রুলের শুনানি শেষে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো.মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ বিষয়ে রায়ের জন্য আগামীকাল বৃহস্পতিবার দিন ধার্য রেখেছে।
প্রতিবেদনে ঘটনার জন্য ক্ষমা চেয়ে দুদক আদালতকে বলেছে, তাদের ‘সরল বিশ্বাসে’ চলা তদন্তে ভুল হয়েছে। গ্রামের নামে সামঞ্জস্যের কারণে আসল অপরাধীর পরিবর্তে ভুল ব্যক্তির নামে প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা জানান, একটা মানুষের খুন হওয়ার ঘটনা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, দ্রুততম সময়ে আসামির ন্যায়বিচার নিশ্চিত করাও তেমনি গুরুত্বপূর্ণ। বছরের পর বছর কারাভোগের পর কেউ খালাস পেলেও তাকে নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। তার যৌবন কাটে কারাগারে। বৃদ্ধ বয়সে কর্মক্ষমতা থাকে না। ফলে পরিবারেও তিনি অবজ্ঞার পাত্র হন। তারা মনে করেন, স্পর্শকাতর মামলা নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে অনেক দেশেই সময় নির্দিষ্ট থাকে। আমাদের এখানে এমন কঠোর মনোভাব অনুসরণ করা গেলে বিচারের নামে অবিচার থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া সম্ভব; বিশেষ করে হত্যা মামলার ক্ষেত্রে সময় বেঁধে দেওয়া দরকার। এ সময়ের মধ্যে অভিযোগপত্র, সাক্ষ্যগ্রহণের পর বিচার শেষ করতে হবে। এরপর মামলাটি আপিলে গেলে তাও নির্দিষ্ট সময়ে নিষ্পত্তি করতে হবে। এতে মানুষ সুবিচার থেকে বঞ্চিত হবে না।
তবে বিচারকদের সদিচ্ছার ঘাটতি আছে বলে মনে করেন না তারা। কিন্তু জনসংখ্যা, অপরাধ ও যে হারে মামলা বাড়ছে, সেই তুলনায় বিচারকসহ অন্যান্য অবকাঠমো বাড়ছে না। ফলে মামলার চাপ রয়ে গেছে এবং এ ধরনের সমস্যা হচ্ছে বলে মনে করেন। তারা মনে করেন, মামলার গুরুত্ব এবং জঘন্যতম অপরাধী না হলে সেগুলো পৃথক করে দ্রুত নিষ্পত্তির উদ্যোগ নিতে হবে। আসামি দীর্ঘদিন কারাগারে থাকলে এবং সদাচরণ করলে সরকার মুচলেকা নিয়ে তাদের প্যারোল দিতে পারে। তাহলে কারাগারে আসামির সঙ্গে দুর্ভোগও কমে আসবে। প্রয়োজনে মামলার চাপ ও ভুক্তভোগীদের দুর্ভোগ কমাতে সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞদের নিয়ে একটি কমিশন করা যেতে পারে। তারা মনে করেন, বিচারের নামে তো অবিচার কারও কাম্য নয়। এ অবস্থা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া দরকার।
এসডব্লিউ/কেএইচ/ ১৬০৪
আপনার মতামত জানানঃ