করোনাকালে কিস্তির টাকা আদায় থেকে বিরত থাকতে এনজিওগুলোকে নির্দেশ দিয়েছিল সরকার। কিন্তু সরকারি নির্দেশ উপেক্ষা করে ঋণের কিস্তি তুলেছে রাজশাহীতে কার্যরত অধিকাংশ এনজিও। সম্প্রতি ‘বীজ’ নামের বেসরকারি ঋণপ্রদানকারী সংস্থা থেকে ঋণ নিয়ে কিস্তির টাকা পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ায় ঋণগ্রহীতা নিলুফা খাতুনের নামে মামলা করে প্রতিষ্ঠানটি। রোববার রাতে এনজিওকর্মীরা পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে দুর্গাপুর উপজেলার মাড়িয়া গ্রাম থেকে এক বছরের শিশুসন্তানসহ নিলুফাকে গ্রেফতার করেন। সোমবার নিলুফাকে আদালতে হাজির করা হলে জামিন নামঞ্জুর করে তাকে জেলহাজতে পাঠানো হয়। এক বছরের শিশুকন্যা সোনিয়াকেও মায়ের সঙ্গে জেলে যেতে হয়েছে।
জানা যায়, গত বছর স্ত্রী নিলুফা খাতুনের নামে বেসরকারি ঋণপ্রদানকারী সংস্থা ‘বীজ’-এনজিও থেকে এক লাখ টাকা ঋণ নিয়েছিলেন রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলার মাড়িয়া গ্রামের আব্দুস সালাম। সেই টাকায় জিনিসপত্র তৈরি করে বিক্রি করতেন। কিন্তু করোনার কারণে সালাম ও নিলুফা দম্পতির আয় রোজগার পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। ফলে লকডাউনে মূল পুঁজি শেষ হয়ে যায়। বৈশ্বিক মহামারী করোনাকালীন সময়ে কাজ না পেলে আব্দুস সালামের সংসারে অভাব অনটন দেখা দেয়। এ কারণে এনজিওর কিস্তির টাকা বকেয়া পড়ে যায়। সরকারের তরফ থেকে করোনাকালীন সময়ে কিস্তির টাকা আদায়ে বিরত থাকার জন্য এনজিওগুলোকে নির্দেশ দিলেও সরকারের সেই নির্দেশনা আমলে নেননি ‘বীজ’। খেলাপি দেখিয়ে আব্দুস সালামের স্ত্রীর নামে মামলা করে এনজিওটি। ওই মামলায় আদালত আব্দুস সালামের স্ত্রীর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন। রবিবার রাতে দুর্গাপুর থানার পুলিশ আব্দুস সালামের স্ত্রীকে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে যায়। সাথে এক বছর বয়সী শিশুকন্যাও বাদ যাননি।
গ্রেপ্তারকৃত নিলুফা বেগমের স্বামী আব্দুস সালাম জানান, সাংসারিক নানা দায় দেনার কারণে বছর দেড়েক আগে দুর্গাপুর উপজেলা থেকে পরিচালিত ‘বীজ’ নামক এনজিও থেকে স্ত্রী নিলুফা বেগমের নামে জনতা ব্যাংক দুর্গাপুর শাখায় থাকা একাউন্টের চেক জমা দিয়ে মাসিক কিস্তিতে একলক্ষ টাকা ঋণ নেন। ঋণ নেয়ার পর থেকে নিয়মিতভাবে এনজিওর মাস্টারের মাধ্যমে ১০ হাজার টাকা মাসিক কিস্তি পরিশোধ করতে থাকেন।
সহায় সম্বলহীন হত দরিদ্র আব্দুস সালাম দিনমজুরি করে একদিকে পরিবার পরিজনদের দিনে দু’ মুঠো ডাল ভাত, পরিধেয় বস্ত্র এবং চিকিৎসার খরচ অন্যদিকে এনজিওর কিস্তির টাকা জোগাড় করতে অতিরিক্ত পরিশ্রম ও মানসিক টেনশনের ফলে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন। হাসপাতালে প্রায় দেড় মাস চিকিৎসাধীন থাকেন আব্দুস সালাম। জমানো কিছু টাকা সেই সাথে ধার-কর্য ও প্রতিবেশীদের কাছ থেকে সাহায্য সহযোগিতা নিয়ে চিকিৎসার খরচ ব্যবস্থা করে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরেন।
আব্দুস সালাম আরো জানান, বাড়িতে ফেরা মাত্রই এনজিওর কর্মী ও ম্যানেজার মহিরুল ইসলাম এসে কিস্তির টাকার জন্য চাপ প্রয়োগ করে এবং বলে দ্রুত টাকা পরিশোধ না করলে মামলা করে জেলের ভাত খাওয়াবে। এনজিওর চাপের মুখে মামলার ভয়ে এলাকার সুদখোর মহাজনের কাছ থেকে চড়া সুদে টাকা নিয়ে এনজিওর ম্যানেজারকে আরেকটি কিস্তি দেন। পরের মাসে সুদখোর মহাজনের চাপে সুদের টাকা দেয়ায় এনজিওর কিস্তি দিতে অপারগতা প্রকাশ করে আব্দুস সালাম। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ‘বীজ’ এনজিওর দুর্গাপুর শাখার ব্যবস্থাপক মহিরুল ইসলাম আব্দুস সালামের স্ত্রী নিলুফা বেগমের জমা রাখা জনতা ব্যাংকের চেক ডিজনার করে নিলুফা বেগমকে আসামি করে রাজশাহী চিফ জুডিশিয়াল আদালতে মামলা করে।
স্থানীয়রা জানান, নিলুফাকে গ্রেফতার করা হলেও তার কোলে রয়েছে এক বছরের একটি শিশুকন্যা সোনিয়া। সোমবার সেই শিশুকন্যাকেও কঠিন ঠাণ্ডার মধ্যে মায়ের সঙ্গে রাজশাহী জেলে যেতে হয়েছে।
এ নিয়ে বীজ এনজিওর বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে মাড়িয়া গ্রামের মানুষ। লোকজন বিষয়টিকে অমানবিক মনে করে দ্রুত নিলুফাকে মুক্তি দেওয়ার দাবি তুলেছেন।
স্থানীয়দের অভিযোগে আরও জানা গেছে, করোনাকালেও সরকারি নির্দেশ উপেক্ষা করে ঋণের কিস্তি তুলেছে রাজশাহীতে কার্যরত অধিকাংশ এনজিও। দু একটির ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম পরিচালনার সরকারি অনুমোদন থাকলেও অধিকাংশরেই নেই। তারপরও তারা গ্রামাঞ্চলে দেদারসে দাদন স্টাইলে ঋণ কার্যক্রম পরিচালনা করছে। ফলে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। আবার ঋণের টাকা আদায়ে তারা চেক ডিজঅনার কৌশলকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করছে।
বীজ নামের এনজিওটির লোকজন এলাকায় ঋণ দেওয়ার আগে ব্যাংকে হিসাব খুলতে বলেন। হিসাব খোলা হলে চেকে সই নিয়ে নিজেদের কাছে জমা রাখেন। কোনো গ্রহীতা ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে নিজেদের কাছে রাখা ব্যাংকের চেকে ইচ্ছেমতো অংক বসিয়ে ডিজঅনার করান। তার পর মামলা করেন।
তবে যাতায়াতের টাকা না থাকায় সেই মামলাতে আদালতেও যেতে পারেনি নিলুফা বেগম। ফলে গ্রেফতারে পরোয়ানা জারি হয়। তেমনি একটি মামলায় নিলুফা বেগমকে পুলিশ রোববার রাতে গ্রেফতার করেছে।
দুর্গাপুর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) হাশমত আলী বলেন, আদালতের গ্রেফতারি পরোয়ানা থানায় আসায় পুলিশ নিলুফাকে গ্রেফতার করে। তবে আসামির একবছরের দুধের শিশু থাকায় পুলিশ আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে গ্রেফতারের পর শিশু কন্যাসহ নিলুফা বেগমকে থানা হাজতে না রেখে অফিসারদের ডিউটির কক্ষে রেখে সকালে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে।
তবে ‘বীজ’-এর দুর্গাপুর শাখার ব্যবস্থাপক মহিরুল ইসলাম সাংবাদিকদের সঙ্গে এই বিষয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি।
সরকারি নির্দেশনা থাকা সত্বেও এনজিওর কিস্তি আদায় সংক্রান্ত মামলায় ঋণগ্রহীতাকে কারাগারে প্রেরণ করা হলে আদালতের বিষয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেন সংশ্লিষ্ট বিশেষেজ্ঞরা। তারা বলেন, করোনাকালে কিস্তির টাকা আদায় থেকে বিরত থাকতে এনজিওগুলোর প্রতি সরকারি নির্দেশনা ছিল। সরকারি নির্দেশনা অমান্য করে এনজিওর কিস্তি আদায় আদালতের আমলে না নেওয়া প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞরা বিস্মিত হন। তারা মনে করেন, করোনা সংকটে সবচেয়ে বেশি বিপর্যয় পরিস্থিতে পড়েছে নিম্ন আয়ের মানুষেরা। ঠিক মত খেয়ে বেঁচে থাকাটাই তাদের নিকট চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমতাবস্তায় বিভিন্ন ঋণপ্রদানকারী সংস্থা থেকে ঋণ গ্রহণ করলে স্বাভাবিকভাবে তারা কিস্তি পরিশোধে অসামর্থ হবেন। সেদিকটা বিবেচনা করেই সরকার ঋণপ্রদানকারী সংস্থাদের প্রতি কিস্তি অনাদায়ে নির্দেশনা দিয়েছিল। এমতাবস্থায় কিস্তির টাকা পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ায় ঋণগ্রহীতাকে কারাগারে প্রেরণ অমানবিক। এবিষয়ে আদালতসহ সরকারের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন বিশেষজ্ঞরা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫২৬
আপনার মতামত জানানঃ