বাংলাদেশে নানা ধরনের হুমকির মুখে নাটক, বাউল উৎসব, লালন ভক্তদের মিলনমেলা বন্ধে বাধ্য করা হচ্ছে৷ বসন্ত ও ভ্যালেন্টাইন দিবসের আয়োজনও বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে৷ আর হামলা হচ্ছে মাজারে৷ তৌহিদী জনতার ব্যানারে এসব ঘটনা ঘটছে৷
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায় উদযাপিত হয়েছে বসন্ত বরণ উৎসব৷ কিন্তু রাজধানীর উত্তরাসহ দেশের কোথাও কোথাও বাধার মুখে পড়েছে এমন আয়োজন৷ এসব ঘটনায় তৌহিদী জনতার পাশাপাশি স্থানীয় পর্যায়ে কোথাও কোথাও ব্যবহার করা হচ্ছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নামও৷
কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে বার বার কড়া অবস্থানের কথা জাননো হলেও যারা হুমকি দিয়ে এসব অনুষ্ঠান বন্ধ করছেন, তারা থামছেন না৷ উপদেষ্টা মাহফুজ আলম তার এক ফেসবুক পোস্টে ‘তৌহিদী জনতার’ নামে যারা হামলা করেছেন তাদের সতর্ক করেছেন৷ তিনি বলেছেন, ‘‘এ কঠোরতার হুঁশিয়ারি অপরাধীদের জন্য, যারা তৌহিদের কথা বলে নিপীড়ন করছে, নৈরাজ্য করছে৷ কিন্তু আগে যেভাবে ইসলাম ফোবিয়ায় আক্রান্ত হয়ে সাধারণ মুসলিমদের নিপীড়ন করা হতো, যার শিকার আমিও হয়েছি, তা কোনো মতেই আর পুনরাবৃত্ত হবে না৷”
মহিলা সমিতি মঞ্চে ১৫ থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ঢাকা মহানগর নাট্য উৎসব হওয়ার কথা ছিল৷ একশটি নাটকের দল এই উৎসবে অংশ নেয়ার কথা ছিল৷ কিন্তু হুমকির কারণে মহিলা সমিতি তাদের বুকিং বাতিল করায় উৎসব স্থগিত হয়ে গেছে৷
উৎসবের মহাসচিব কামাল আহমেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমাদের মহিলা সমিতির পক্ষ থেকে ১৪ ফেব্রুয়ারি জানানো হয়, তাদের হুমকি দেয়া হয়েছে যে উৎসবে ফ্যাসিবাদের লোক আছে, তারা এখান থেকে কোনো আন্দোলন শুরু করতে পারে, তাই উৎসব হলে হামলা করা হবে৷ পরে আমরা রমনা থানায় গিয়ে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করি৷ তখন আমাদের ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’নাটকটি বাদ দিয়ে উৎসব করতে বলা হয়৷ আমরা পরে আলোচনা করে জানাবো বলে থানা থেকে চলে আসি৷ আমাদের আসার সময় মহিলা সমিতির কর্মকর্তাকে থানার মধ্যেই কয়েকজন ব্যাপক হুমকি দেয়৷ পরে মহিলা সমিতি আমাদের বুকিং বাতিল করে দেয়৷”
এ নিয়ে, সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী এক ফেসবুক পোস্টে বলেছেন, ‘‘নাট্যকর্মীদের মধ্যেই একটা অংশই উৎসব বন্ধের জন্য আহ্বান জানায়৷ তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘‘আমাদের দ্রুত অনুসন্ধান থেকে জানা গেলো, নাট্যকর্মীদের মধ্যেই একটা অংশ এই উৎসবের বিরোধিতা করে মহিলা সমিতি কর্তৃপক্ষের কাছে হল বরাদ্দ বাতিলের জন্য জোর দাবি জানিয়ে আসছে বেশ কিছুদিন ধরে৷ বিক্ষুব্ধ নাট্যকর্মীদের দাবি, এই উৎসবের আড়ালে জুলাই আন্দোলনের সময় ছাত্র-জনতা হত্যায় বিবৃতি দিয়ে উসকানি দেয়া কিছু ব্যক্তি বা তাদের গোত্রীয় কিছু মানুষ সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে৷ তারা দাবি জানায়, জুলাইয়ে তাদের ভূমিকার জন্য বিচারের মুখোমুখি হওয়ার আগে কোনো পুনর্বাসন চলবে না৷ অবশেষে, মহিলা সমিতি বরাদ্দ বাতিল করে৷”
এর জবাবে কামাল আহমেদ বলেন, ‘‘ফারুকী সাহেব হয়তো যে তথ্য জানতে পেরেছেন, তা বলেছেন৷ আমাদের কথা হলো, কোনো পক্ষের দাবির মুখে উৎসব বন্ধ করা হবে কেন?”
এর আগে শিল্পকলায়ও হুমকি ও অবস্থান নিয়ে নাটক বন্ধ করা হয়েছিলো৷ ঢাকা মহানগর নাট্য উৎসব স্থগিত হওয়া সম্পর্কে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘‘ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের পক্ষ থেকে ঢাকা মহানগর নাট্য উৎসব বন্ধ করা বা স্থগিত করা সম্পর্কে কোনো নির্দেশনা প্রদান করা হয়নি৷ যেকোনো ধরনের সৃজনশীল ও শৈল্পিক কর্মকাণ্ডে আমরা সবসময় উৎসাহিত করে থাকি৷ কী কারণে আলোচ্য নাট্য উৎসব স্থগিত হয়েছে তা আমাদের বোধগম্য নয়৷ উক্ত নাট্য উৎসব ঘিরে যেকোনো প্রকার অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে ডিএমপি তৎপর রয়েছে৷”
১৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকার উত্তরায় বসন্ত উৎসবও বন্ধ করে দিতে হয়েছে৷ ঢাকার বসন্ত উৎসব উদযাপন পরিষদ চারুকলার বকুল তলা, পুরনো ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্ক এবং উত্তরায় উন্মুক্ত মঞ্চে বসন্ত বরণের অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলো৷ কিন্তু উত্তরার উন্মুক্ত মঞ্চে বসন্ত বরণের অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হয়৷ ফরহাদ ইমন নামে একজন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা পরিচয় দিয়ে ওই উৎসব বন্ধ করে দেয়৷
ওই সময় তারা বলেছিলেন, ‘‘মঞ্চটির আমরা মীর মুগ্ধ নাম দিয়েছি৷ কিন্তু আয়োজকেরা সেটা ব্যানারে লেখেননি৷ আয়োজকদের মধ্যে ফ্যাসিবাদের দোসররা রয়েছেন৷”
একই দিনে টাঙ্গাইলের ভুঞাপুরে বসন্ত ও ভালবাসা দিবসে ফুল বিক্রি করায় ফুলের দেকানে হামলা হয়৷ তৌহিদী জনতার ব্যানারে ওই হামলা হয়৷ আর ওই ভয়ে পরের দিন ১৫ ফেব্রুয়ারি সেখানে পূর্ব নির্ধারিত ঘুড়ি উৎসব বাতিল করা হয়৷ ঘুড়ি উৎসববিরোধী একটি লিফলেট ছড়িযে দেয়ার পর ওই এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে৷
১২ ফেব্রয়ারি টাঙ্গাইলে লালন স্মরণোৎসব বন্ধ করা হয় হেফাজতে ইসলামের দাবির মুখে৷ এর আগে নারায়ণগঞ্জে লালন ভক্তদের মিলনমেলা পণ্ড করা হয়েছিলো হামলা চালিয়ে৷
গত ১৮ জানুয়ারি পুলিশের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ৪ আগস্টের পর থেকে ৪০টি মাজারের ৪৪ বার হামলা হয়েছে৷ সবচেয়ে বেশি হামলার ঘটনা ঘটেছে ঢাকা বিভাগে৷ এখানে ১৭টি মাজারে ভাঙচুর, লুটপাট হয়েছে৷ এছাড়া চট্টগ্রাম বিভাগে ১০টি ও ময়মনসিংহ বিভাগে সাতটি হামলার ঘটনা ঘটেছে৷ হামলায় জড়িত থাকার অভিযোগে ফৌজদারি মামলায় মোট ২৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷
আর বিশ্ব সূফী সংস্থা ২৩ জানুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলনে জানায়, গত ছয় মাসে দেশের বিভিন্ন স্থানে ৮০টি মাজারে হামলা হয়েছে৷ সংগঠনের নির্বাহী কমিটির সদস্য আফতাব আলম জিলানী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ওই সংবাদ সম্মেলনের পরও আরো চার-পঁচটি মাজারে হামলা হয়েছে৷ তৌহিদী জনতা ও ইমাম সমিতির নামে এগুলো করা হয়৷ আসলে এর পিছনে ওহাবিরা আছে৷ আমরা প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরের হুশিয়ারির পরও প্রতিকার পাচ্ছি না৷”
তিনি আরো বলেন, ‘‘শুধু মাজার নয় লালনের ২৪-২৫টি অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হয়েছে৷ নাটক বন্ধ করা হচ্ছে৷ বসন্ত উৎসব বন্ধ করা হয়েছে৷ তারা আসলে বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও সূফিবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে৷”
নারায়ণগঞ্জের লালন ভক্ত মিলন মেলার প্রতিষ্ঠাতা ফকির শাহজালাল বলেন, ‘‘আমরা প্রতিবছর লালন ভক্ত ও সাধুসঙ্গরা এক হতাম৷ ২৩ নভেম্বর হামলা করে পণ্ড করে দেয়া হয়৷ এখন আমি চাপের মুখে আছি৷ ড. আসিফ নজরুল ও ফারুকী স্যার দেখবেন বলেছিলেন৷ কিন্তু কিছুই হচ্ছে না৷ সারাদেশেই লালনের অনুষ্ঠান করতে দেয়া হচ্ছে না৷”
সাংবাদিক, অ্যাক্টিভিস্ট এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সামনের সারিতে থেকে সমর্থনদানকারী আশরাফ কায়সার বলেন, ‘‘সরকার উগ্রবাদের বিরুদ্ধে তার অবস্থান পরিস্কার করলেও তৌহিদী জনতা বা কোনো কোনো উগ্রবাদী গোষ্ঠী তাদের হুমকি হামলা চালিয়ে যাচ্ছে৷ কোনো কোনো রাজনৈতিক গোষ্ঠী এটাকে প্রশ্রয় দেয়ার কারণেই ছড়িয়ে পড়ছে৷ এটা মব কালচার৷”
তিনি আরো বলেন, ‘‘সরকাকে শুধু বিবৃতি দিলে চলবে না৷ এই ধরনের ঘটনায় যারা জড়িত তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে৷ তাদের প্রকাশ্যে আনতে হবে৷”
মানবাধিকার কর্মী নূর খান বলেন, ‘‘আসলে এখন তৌহিদী জনতা বা অন্য যে নামেই হোক না কেন তা মূলত বাংলাদেশের সংস্কৃতির ওপর আঘাত৷ বাংলাদেশের সাংস্কৃতির ভিত্তির ওপর পরিকল্পিতভাবে আঘাত করা হচ্ছে৷”
‘‘সরকার বার বার বিবৃতি দিলেও এখানো দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নেয়নি৷ সরকারের উচিত হবে শুধু বিবৃতি না দিয়ে অপরাধীদের আইনের আওয়াতায় এনে তাদের অবস্থানকে দৃশ্যমান করা”, যোগ করেন তিনি৷
এদিকে, এসব বিষয়ে সংস্কৃতি অঙ্গনের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করা হলেও তারা রাজি হননি৷ তারা বলছেন, ‘‘কিছু বললেই আমাদের ট্যাগ দিয়ে দেয়া হবে, আমরা বিপদে পড়ব৷’
আপনার মতামত জানানঃ