দেশকে বাস্তবিক দৃষ্টিতে দেখলে দেখা যাবে হরিলুটের জমানা চলছে। যার যার সুযোগ সুবিধামতো সে সে লুটেপুটে খাচ্ছে। যারা খেতে পারছেন না, তারাও না খাওয়ার আফসোস নিয়ে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। হালের বিবরণে এতটাই বলা চলে। তবে এসব লুটের ভূমিকায় থাকা অধিকাংশরাই রাষ্ট্রীয় ভিআইপি কিংবা ভিআইপি শ্রেণির প্রতিষ্ঠান। ব্যবসায়ীদের মনে ব্যবসা দেওয়ার উদ্দেশ্য যতটা না মুনাফা ভোগ করা থাকে তারচেয়ে বড় উদ্দেশ্য হলো কারসাজি আর ফন্দি ফিকির করে রাষ্ট্র কিংবা লোকজনের টাকা বগলদাবা করা। তবে এসবের অধিকাংশই চলে রাষ্ট্রীয় টেবিলের নিচ দিয়ে। টেবিলের ওপর দিয়েও যে এসব চলে না, তা নয়। লুটেপুটে খাওয়ার এই জমানায় ওপর-নিচ কোনো ভেদাভেদ নেই। সরকার কিংবা লোকজনের টাকাকে নিজের মনে করে পকেটে ঢোকানোটা এক রকম রীতিতেই পৌঁছে গেছে। আড়াল করে খাওয়ার ন্যুনতম দ্বিধাটুকুও রেখে খায় না। বলা চলে, রাষ্ট্রের টাকা হস্তগত করার প্রতিযোগিতা চলছে। দেশের বড় বড় ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানেই সরকার বিপুল পরিমাণ টাকা পাওনা রয়েছে। আজ সোমবার (২৫ জানুয়ারি) সংসদের প্রশ্নোত্তরে সরকার দলীয় অসীম কুমার উকিলের প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল জানিয়েছেন, বর্তমানে (অক্টোবর ২০২০) দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণগ্রহীতা ৩ লাখ ৩৪ হাজার ৯৮২ জন। স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে বৈঠকের শুরুতে প্রশ্নোত্তর টেবিলে উপস্থাপন করা হয়। সেখানে তিনি এ তথ্য দেন।
জাতীয় পার্টির শামীম হায়দার পাটোয়ারীর প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী জানান, চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। ডিসেম্বর ২০২০ পর্যন্ত আদায় হয়েছে ১ লাখ ৮ হাজার ৪৭১ কোটি ৭১ লাখ টাকা। লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় অর্জন ৩২.৮৭ শতাংশ।
সরকারি দলের এ কে এম রহমতুল্লাহর প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, দেশ থেকে অবমূল্যায়ন বা অতিমূল্যায়নের মাধ্যমে অর্থ পাচারের কিছু অভিযোগ পাওয়া গেছে। সংশ্লিষ্ট আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বিষয়টি খতিয়ে দেখছে। যেসব ক্ষেত্রে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে, সেসব ক্ষেত্রে আইনানুগ ব্যবস্থা চলমান রয়েছে। অর্থ পাচার বন্ধে সরকারের নানা পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে অর্থমন্ত্রী বলেন, এসব পদক্ষেপের ফলে বৈদেশিক মুদ্রা বা অর্থ পাচার অনেকাংশে কমে যাবে।
এদিকে সরকারি দলের সাংসদ শহীদুজ্জমান সরকারের প্রশ্নের জবাবে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তফা জব্বার জানান, দেশের চারটি মোবাইল অপারেটরের কাছে বিটিআরসির বকেয়া ১৩ হাজার ২২ কোটি ৩৮ লাখ ৬৫ হাজার ৯৩৪ টাকা। অপারেটরগুলো হলো গ্রামীণফোন, রবি, সিটিসেল (বর্তমানে বন্ধ) ও রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিটক। এগুলোর মধ্যে গ্রামীণফোন ও রবির কাছে বকেয়া অডিট আপত্তিসংক্রান্ত। আর সিটিসেলের বকেয়া উচ্চ আদালত–নির্ধারিত। টেলিটকের কাছে পাওনা থ্রিজি তরঙ্গ বরাদ্দ বাবদ।
সংসদে মন্ত্রীর দেয়া তথ্য অনুযায়ী, গ্রামীণফোনের অডিট আপত্তির ১২ হাজার ৫৭৯ কোটি ৯৪ লাখ ৭৬ হাজার ১৩৫ টাকার মধ্যে ২ হাজার কোটি টাকা দিয়েছে। তাদের কাছে বকেয়া রয়েছে ১০ হাজার ৫৭৯ কোটি ৯৪ লাখ ৭৬ হাজার ১৩৫ টাকা।আর রবির কাছে অডিট আপত্তির ৮৬৭ কোটি ২৩ লাখ ৯১ হাজার ৪৭৬ টাকার মধ্যে তারা পরিশোধ করেছে ১৩৮ কোটি টাকা। অপারেটরটির কাছেও বকেয়া আছে ৭২৯ কোটি ২৩ লাখ ৯১ হাজার ৪৭৬ টাকা।
এছাড়াও বন্ধ হয়ে যাওয়া মোবাইল অপারেটর সিটিসেলের (প্যাসিফিক বাংলাদেশ টেলিকম লি.) কাছে বাকেয়া ১২৮ কোটি ৬ লাখ ৯৮ হাজার ৩২৩ টাকা এবং রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিটকের কাছে বকেয়া এক হাজার ৫৮৫ কোটি ১৩ লাখ টাকা।
টাকা আদায় নিয়ে টেলিটক বাদে তিনটি অপরাটরের সাথে মামলা চলমান আছে। অপরদিকে টেলিটকের টাকা চেয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয়া হলেও কোন সাড়া মেলেনি বলেও জানান টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রী।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিদের সহযোগিতায় রাষ্ট্রের অধিকাংশ অর্থই বিশেষ শ্রেণির পকেটে। সরকারের অবহেলা কিংবা নজরদারির অভাবে যে এমনটি ঘটেছে এবিষয়ে দ্বিমত জানিয়ে বিশেষজ্ঞরা জানান, সরকারের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদেই এসব চলে থাকে। এতে অবশ্য সরকার দলীয় উচ্চপদস্থ কিংবা জাতীয় পর্যায়ের প্রভাবশালীদের সুবিধা যুক্ত থাকে।তারা মনে করেন, তদন্ত করলে লুটেপুটে খাওয়াদের আরো লম্বা লিস্ট করা যাবে। সেখানেও যে জালের ফাঁক ফোঁকর দিয়ে রাঘব বোয়ালরা ছুটে যাবেন এবিষয়ে সন্দেহ নেই কোনো। সরকারি বেসরকারি এমন কোনো প্রতিষ্ঠান নেই যেখানে টাকা লুটের নজির নেই। রাষ্ট্রের টাকা লুট করার জন্য আয়োজন করে বসে আছেন যেন লুটেরারা। দেশ থেকে লুটেপুটে খাওয়া রোধ করা গেলে দেশের অর্থনীতি যেমন একদিকে উন্নত থাকবে অপরদিকে সরকারকেও বৈদেশিক ঋণের জন্য হাত পাততে হবে না বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।
এসডব্লিউ/কেএইচ/১৪৪৩
আপনার মতামত জানানঃ