কম্পিউটারের ‘অ্যালগরিদমে’ সংখ্যায় বরকত আনতে গিয়ে যদি A Tales of Two Cities-কে ‘A Tale of Sixteen Cities’ লেখা দেখানো হয়, তাহলে সমাধিতে শায়িত চার্লস ডিকেন্স লজ্জায় নির্ঘাত পাশ ফিরে শোবেন। কিংবা জর্জ অরওয়েলের ভুবনজয়ী উপন্যাস 1984-কে যদি 2024 দেখানো হয়, তাহলে স্বর্গবাসী অরওয়েলের যে নির্ঘাত নিদ্রাভঙ্গ ঘটবে, তা আর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে দেখার প্রয়োজন পড়ে না।
বলছি এ কারণে যে, সম্প্রতি সত্যের সঙ্গে মিথ্যার ‘রুসুমাত’ বা বিবাহবন্ধন পাকাপাকি হয়ে গেছে। সামাজিক যোগাযোগ ‘হাব’ মেটার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য এখন থেকে নিউজ কনটেন্ট জোগাবে বিশ্বের নেতৃস্থানীয় সংবাদ সংস্থা ‘রয়টার্স।’ সম্প্রতি স্বাক্ষরিত অংশীদারত্বের সমঝোতা চুক্তি মোতাবেক যুক্তরাজ্যের বিশ্বজোড়া নেটওয়ার্কভিত্তিক সংবাদ সংস্থা ‘রয়টার্সের’ নিউজ কনটেন্ট ব্যবহার করতে পারবে টেক কোম্পানি ‘মেটা।’
মজার ব্যাপার হলো, বিশ্বব্যাপী খবরটা তারাই তুলে ধরেছে। সংস্থাটির মূল হোল্ডিং কোম্পানি হলো থমসন-রয়টার্স ইউকে। সামাজিক মাধ্যমের ক্রমবর্ধমান প্রচার প্রসারের কারণে রয়টার্স এমনিতেই মুদ্রণমাধ্যম ও টেলিভিশন থেকে তাদের ফোকাস শিফ্ট করেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের দিকে। ‘মেটার’ চ্যাটবট হোয়াটস্ অ্যাপ, ফেসবুক এবং ইনস্টাগ্রামের মতো প্ল্যাটফর্মগুলোয় নিউজ কনটেন্ট ব্যবহার করতে দেওয়ার বিষয়ে ‘রয়টার্স’ বলেছে, তাদের ‘বিশ্বাসযোগ্য’ নিউজ কনটেন্টগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আরও শক্তভাবে তুলে ধরতে ব্যবহার করা হচ্ছে। তবে সংগত কারণেই চুক্তির শর্তাবলি গোপন রাখা হয়েছে।
তাদের মধ্যে চুক্তি উন্মুক্তই থাক বা না থাক, সংবাদ যখন সর্বজনীন, বৈশ্বিক বুদ্ধিবৃত্তিক পণ্য এবং এর খরিদ্দার যখন বিশ্বের দর্শক-পাঠক-গবেষক ও নীতিনির্ধারকরা, তখন সত্য খবরের সঙ্গে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিবাহবন্ধন ব্যবহারকারীদের মধ্যে যে উদ্বেগ সৃষ্টি করবে এবং করতেই থাকবে, তা অবধারিত বাস্তবতা বলে ধরে না নেওয়ার কোনো অবকাশ নেই। আগে তথ্য উপস্থাপনের ক্ষেত্রে গ্রাফিক্স টেমপ্লেট, ফ্লো-চার্ট কিংবা ইনফো-গ্রাফিক্স ব্যবহার করা হতো।
হাল জামানার প্রযুক্তি ‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই)’ সংবাদ কনটেন্টের তথ্যগত বস্তুনিষ্ঠতাকে এখন কোন্ গ্যাঁড়াকলে ফেলে কেমনভাবে তুলে ধরবে, সেটাই এখন দেখার বিষয়। অতিকথন, মর্জিমাফিক উপস্থাপনা ও উদ্দেশ্যপূর্ণ তথ্য সাম্রাজ্যবাদের এ অতি আধুনিক জামানায় সত্যের সঙ্গে মিথ্যার এ বিবাহবন্ধন কী ধরনের সংবাদ প্রসব করতে থাকবে, বিশ্বকে আপাতত তাই দেখে যেতে হবে।
আধুনিক তথ্য-প্রজন্মের অনেক যুক্তি আছে এবং থাকবেও। তাদের মতে, নিউজ প্রোডাকশনের মান, গতি ও উৎপাদনশীলতা বাড়িয়ে দেবে এআই। তবে পরিমাণে বাড়লেও সে তথ্য সম্ভারে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় তৈরি মিথ্যা কিংবা অতিরঞ্জিত খবর, পক্ষপাতদুষ্টতা ও স্বেচ্ছাচারী মনোভাবের ঝুঁকি থাকবেই। এআই কর্তৃক জেনারেটকৃত ছবি ও ইনফোগ্রাফিক্স-ভিডিও কনটেন্টকেও প্রভাবিত করতে পারবে বড় দাগে। এতে দায়িত্বশীল সাংবাদিকতার অভীষ্ট লক্ষ ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে। এগুলোর গ্লোবাল সিন্ডিকেশন কতিপয় টেক-জায়ান্টদের নিয়ন্ত্রণেই থেকে যাবে। ফলে আঞ্চলিক স্বার্থ বলয়ে প্রভাবশালীদের দৌরাত্ম্য বিপজ্জনক মাত্রায় বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি সাংবাদিকতার সহযাত্রী হবে। সাংবাদিকতায় যুক্ত হবে ‘সাইবার ডিভাইড’ বা তথ্য প্রযুক্তিগত বিভাজন। উদ্বেগের প্রধান কারণগুলো এখানেই।
ইউরোপের সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক জার্মানির বিল্ড পত্রিকার মতে, তারা তাদের পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগের জনবল ছাঁটাই করতে চাচ্ছে এই এআই প্রযুক্তির কারণে। অনুরূপভাবে যুক্তরাজ্যের মিরর ও এক্সপ্রেস সংবাদমাধ্যমও এআইয়ের ক্ষেত্র প্রসারণের কথা ভাবছে, ‘which can be used to help human reporters compiling coverage of (news) topics.’ ঠিক এমনটাই ঘটছে অস্ট্রেলিয়ায়। তবে এক জরিপে দেখা গেছে, সাত শতাংশ ব্রিটিশ সংবাদপত্র পাঠক এআই প্রক্রিয়াজাতকৃত খবরে ভরসা রাখতে নারাজ। ‘Introduction of AI to journalism is going to do more harm than good.’
জরিপে দেখা গেছে, ৪৮ শতাংশ ব্রিটিশ পাঠক মনে করেন, এআইয়ের তৈরি খবরের প্রতিক্রিয়া ইতিবাচক না হয়ে বেশিরভাগই হবে নেতিবাচক। এ জরিপে মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকতে চেয়েছেন ২৩ শতাংশ ব্রিটিশ পাঠক-দর্শক। এ রকম নির্লিপ্ত অবস্থান গ্রহণকারীর সংখ্যাই অবশ্য পৃথিবীতে বেশি। তবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সমালোচনা ও বিপরীত অবস্থান গ্রহণকারীদের মনোভাব সর্ব মহলেই অভিনন্দিত ও বিবেচ্য বিষয়। কেননা এটি অস্বীকার করার উপায় নেই, রোবট বা রোবটিক্স উৎপাদন বা উৎপাদিকতার প্রতীক হলেও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সবসময়ই সন্দেহের পাত্র। কারণ এখানে মানবীয় চিন্তার বিকল্প করার ফন্দি করা হয়েছে। এটি নিশ্চয়ই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
তবে তা কল্যাণকর নাকি সর্বনাশা, প্রশ্ন সেটা নয়। প্রশ্ন হলো, যে বুদ্ধিমত্তা কৃত্রিম, তার ওপর আস্থা কীভাবে থাকবে সাধারণ মানুষের? কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে ফটোসাংবাদিকের ফটো-ইমেজের ভেক্টর-রূপায়ণ কিংবা তথ্যসূচক (ইনফোগ্রাফিক্স) বানানো এক জিনিস; কিন্তু অয়্যার সার্ভিস বা বার্তা সংস্থার সংবাদ কনটেন্ট প্রবাহের নতুন রূপায়ণ ও সত্যের কৃত্রিমিকরণ (কনটেন্ট ম্যানিপুলেশন) সম্পূর্ণ অন্য বিষয়। উদ্বেগের অন্যতম হেতুটা এটাই। কম্পিউটারের ‘অ্যালগরিদমে’ সংখ্যায় বরকত আনতে গিয়ে যদি ‘A Tales of Two Cities’কে ‘A Tale of Sixteen Cities’ লেখা দেখানো হয়, তাহলে সমাধিগোরে শায়িত চার্লস ডিকেন্স লজ্জায় নির্ঘাত পাশ ফিরে শোবেন।
কিংবা জর্জ অরওয়েলের ভুবনজয়ী উপন্যাস 1984-কে যদি 2024 দেখানো হয়, তাহলে স্বর্গবাসী অরওয়েলের নিদ্রাভঙ্গ যে নির্ঘাত ঘটবে, এটা তো ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে দেখার প্রয়োজন পড়ে না।
তথ্যপ্রযুক্তি এবং সংবাদমাধ্যমে এর প্রয়োগের ভালো-মন্দ বিভিন্ন দিক নিয়ে গবেষণারত অভিজ্ঞ মানুষও বসে নেই। তারা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সুবিধাগুলো যেমন শনাক্ত করেছেন, এর অনিবার্য বিপদ ও অন্তরায়গুলোও তেমনি সামনে নিয়ে এসেছেন। তবে মোটা দাগে তাদের উদ্বেগ হলো, এআই গণমাধ্যম শিল্পের জন্য যেমন ইতিবাচক প্রভাব রাখতে সক্ষম, ক্ষতি করার ক্ষমতা এর চেয়ে ঢের বেশি। তাই ক্ষতির দিকটি বেশি উদ্বেগজনক বলে সেই বিষয়গুলোই আগে বিবেচনা করা দরকার। যেমন, তারা বলছেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ইতোমধ্যে রুগ্ণ প্রকাশনা শিল্পের জন্য সর্বনাশা হবে।
কারণ ব্যস্ত মানুষ ইন্টারনেট সার্চ ইঞ্জিনগুলোয় যেভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে, এরপর থেকে তাদের এ নির্ভরশীলতা আসক্তিতে পরিণত হবে। উপরন্তু, যন্ত্র নির্ভরতা ভুলের পরিমাণ বাড়াবে, এতে সংবাদের বিশ্বাসযোগ্যতায় আকাল দেখা দেবে। একটা সংবাদমাধ্যমের জনপ্রিয়তার মূলে রয়েছে তার পরিবেশিত সংবাদের বিশ্বাসযোগ্যতা। এছাড়া সংবাদমাধ্যমের কর্মীরাও বিপদে পড়বেন। কারণ, প্রযুক্তি যখন নিউজ-কনটেন্ট তৈরি করবে, তখন সংবাদকর্মীদের এ কাজ হারিয়ে পেশা থেকেও সরে যেতে হবে।
বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, যান্ত্রিক সংবাদে থাকবে না কোনো রাজনৈতিক ও পেশাগত দিকনির্দেশনা, যাচাই-বাছাইয়ের সুযোগ, সংবাদের গুরুত্ব অনুধাবনশৈলী, ফলে সমানে ছড়াতে থাকবে অপসংবাদ ও বিভ্রান্তি (Misinformation and Disinformation)। সর্বোপরি সংবাদমাধ্যম হারাবে মানবীয় সৃজনশীলতা ও বিচার-বিবেকবোধ। কারণ এআই সংবাদকে কেবল প্রক্রিয়াজাত বা পরিশীলনই করবে না, সংবাদ সে উৎপাদনও করবে। এখনকার অত্যাধুনিক এআই হচ্ছে জেনারেটিভ এআই। মুক্ত-স্বাধীন ও সৎ সাংবাদিকতা বন্ধ করতে এখন আর তাই স্বৈরতন্ত্র বা অগণতান্ত্রিক একনায়কের দরকার হবে না; কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিজেই এখানে সবচেয়ে শক্তিশালী স্বৈরশাসক ও প্রাণহীন সংবাদ দানব।
আপনার মতামত জানানঃ