ওই সময়ে অঞ্চলটিতে বসবাস করতো হিট্টাইট সম্প্রদায়ের মানুষজন। বৈরী প্রকৃতি, আগ্রাসী জাতিগোষ্ঠী ও দুর্ধর্ষ ডাকাতদের সঙ্গে অভিযোজন করেই চলছিল তাদের জীবন। একদিন তারা স্বজাতি ও সম্পদের সুরক্ষায় অদূরে নরম শিলা মাটি খুঁড়ে নির্মাণ করলেন সুরক্ষিত পাতাল শহর।
আজকের আধুনিক টানেল প্রযুক্তির ভীত দাঁড়িয়ে আছে প্রাচীনকালের সুড়ঙ্গ তৈরির উদ্ভাবনী কৌশলের ওপর। যদিও প্রাচীন যুগে সুড়ঙ্গ নির্মাণের পদ্ধতি ছিল ধীরগতির ও পরিশ্রমসাধ্য, তবুও প্রকৌশলের প্রাথমিক ধারণা ও কৌশলগুলোর বিকাশ উন্নত টানেল নির্মাণের ভিত্তি গড়ে তুলেছিল।
বিভিন্ন যুদ্ধের ইতিহাস ঘাঁটলেই দেখা যাবে যে, যুদ্ধে সৈন্য সংখ্যা কিংবা গোলাবারুদ যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি গুরুত্বপূর্ণ হলো রণকৌশল।প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় রণকৌশলেও গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল সুড়ঙ্গের। গোপন সুড়ঙ্গবিহীন দুর্গ তখন কল্পনাই করা যেত না।
আগেকার দিনের অধিকাংশ দুর্গেই এর অধিবাসীদের জন্য রাখা হতো বিভিন্ন গোপন সুড়ঙ্গ। কোনো কোনো সুড়ঙ্গ শেষ হতো দুর্গ থেকে বেশ কিছু দূরে, যাতে করে শত্রুর আক্রমণের মুখে দুর্গের অধিবাসীরা নিরাপদে পালিয়ে প্রাণ বাঁচাতে পারে। শত্রুদের দ্বারা অবরুদ্ধ থাকা অবস্থায় বিভিন্ন খাদ্য ও যুদ্ধ সামগ্রীও এসব সুড়ঙ্গ পথেই আনা-নেয়া করা হতো। এছাড়া কোনো কোনো সুড়ঙ্গ গিয়ে শেষ হতো কোনো গোপন কুঠুরিতে যেখানে লুকিয়ে থাকা যেতো, রসদ লুকিয়ে রাখা যেতো কিংবা খুঁড়ে রাখা হতো পানির কূপ।
তবে প্রাচীনিকালেই সুড়ঙ্গ ব্যবস্থাকে আরো কয়েক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল কাপাডোশিয়া অঞ্চলের হিট্টাইট সম্প্রদায়। অসংখ্য সুড়ঙ্গপথ ও চেম্বার তৈরির মাধ্যমে রীতিমতো তারা নির্মাণ করেছিল ডেরিনকুয়ু পাতাল শহর। ঐতিহাসিকদের মতে, খ্রিস্টপূর্ব ১২০০-১৬০০ শতাব্দীতে কাপাডোশিয়ায় নির্মিত হয়েছিল এই পাতাল শহর।
ওই সময়ে অঞ্চলটিতে বসবাস করতো হিট্টাইট সম্প্রদায়ের মানুষজন। বৈরী প্রকৃতি, আগ্রাসী জাতিগোষ্ঠী ও দুর্ধর্ষ ডাকাতদের সঙ্গে অভিযোজন করেই চলছিল তাদের জীবন। একদিন তারা স্বজাতি ও সম্পদের সুরক্ষায় অদূরে নরম শিলা মাটি খুঁড়ে নির্মাণ করলেন সুরক্ষিত পাতাল শহর।
হিট্টাইট সম্প্রদায়ের কঠোর পরিশ্রমে নির্মিত ডেরিনকুয়ু মাটির প্রায় ২৫০ ফুট গভীর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। শান্তিপ্রিয় হিট্টাইট জনগোষ্ঠীর প্রায় ২০ হাজার মানুষ বসবাস করতো এ শহরে। আর তাই সবার নির্বিঘ্ন যাতায়াত নিশ্চিতে মাটির উপরিভাগে তৈরি করা হয়েছিল ৬০টি গোপন দরজা। শহরের অলিতে-গলিতে আলো-বাতাস ও অক্সিজেনের বাধাহীন চলাচল নিশ্চিতে আরো নির্মিত হয় প্রায় দেড় হাজার চিমনি।
হিট্টাইট সম্প্রদায়ের নির্মিত পাতালশহরের খোঁজ প্রত্নতাত্ত্বিকরা পেয়েছিলেন ১৯৬৩ সালের দিকে। তুরস্ক তখন আধুনিক রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত। একদিন এক অধিবাসী নিজের বাড়ি মেরামত করছিলেন। আর তখনই আচমকা খসে পড়ে মেঝে। নিজের অজান্তেই তিনি আবিষ্কার করে ফেলেন ৩ হাজার বছরের পুরনো ডেরিনকুয়ু পাতাল শহর। আর তার পরপরই বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসেন বেশ কজন প্রত্নতাত্ত্বিক। সরঞ্জাম গুছিয়ে শুরু করেন অনুসন্ধান।
প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানে একে একে বেরিয়ে আসতে থাকে নগরীর রহস্যময় গোলকধাঁধাপূর্ণ গঠনশৈলীর বৃত্তান্ত।প্রায় ১৮ তলাবিশিষ্ট এ শহরের বিভিন্ন তলায় খুঁজে পাওয়া যায় আস্তাবল, তেলের ঘাঁনি, গুদামঘর, ভোজনকক্ষ, ভূগর্ভস্থ রত্নভান্ডার, প্রার্থনাকক্ষসহ আরও অনেক কিছুই। শহরের দ্বিতীয় তলায় দেখা মিলেছে কিছু অদ্ভুতদর্শন সমাধিরও।
এ থেকে অনুমান করা হয়, দ্বিতীয় তলাটি প্রার্থনালয়, ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও অপরপাশে মৃতদের বিশেষ নিয়মে সমাহিত করার কাজে ব্যবহৃত হতো। এছাড়াও শহরের অভ্যন্তরে সুপেয় পানি সরবরাহের জন্য খুঁজে পাওয়া যায় নলাকৃতির বিশেষ সুরঙ্গের। এসব সুরঙ্গ দিয়ে পানি এসে জমা হতো কূপের তলদেশে। ইতিহাসবিদদের ধারণা, স্কুল, গির্জা ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের বাজারও ছিল এখানে। সবমিলিয়ে এক পরিপূর্ণ সমৃদ্ধ শহর ছিল এই ডেরিনকুয়ু পাতাল নগরী।
ইতিহাসের পালাক্রমে বহুবছর ধরে হাত বদল হয়েছিল হিট্টাইট সম্প্রদায়ের পাতাল শহর। ইতিহাসের বাঁক ঘুরে সুরক্ষিত ডেরিনকুয়ু শহর একসময় ফ্রিজিয়ানদের হাত হয়ে কুক্ষিগত হয় বাইজেনটাইনদের হাতে। তারপর বাইজেনটাইনদের হাত থেকে অটোমানদের হাতে আসে ডেরিনকুয়ু।
অটোমানদের হাতে পড়ার পর পাতাল শহরটি বন্দীদের আটকে রাখতে ব্যবহার করা শুরু হয়।এর পরের ১০০ বছরে ঘটেছে অসংখ্য ঘটনা। একটা সময় পরে শেষ হয়েছে অটোমান অধ্যায়ও। গ্রিস ও তুরস্কের যুদ্ধের পর ১৯২৩ সালে উভয় ভূখণ্ডের মধ্যে আদান-প্রদান হয় নিজেদের জনগণ। সে সময় সেখানে বসবাসরত খ্রিস্টান অধিবাসীরা ছেড়ে যায় রহস্যময় এই পাতাল শহর। অবশেষে চূড়ান্তভাবে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ে প্রায় ৩ হাজার বছর পূর্বে গড়ে ওঠা এই পাতাল নগরী।
আপনার মতামত জানানঃ