বাংলায় ঔপনিবেশিক শক্তির প্রভাব খাটানোর প্রক্রিয়া ব্রিটিশ বাহিনীর জন্য খুব সহজও ছিল না। ইতিহাসের অন্যতম শক্তিশালী নৌবাহিনী থাকা সত্ত্বে বাংলার ওপর রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তি প্রকাশ করতে গিয়ে প্রায়ই ব্রিটিশদের কঠিন সময়ের মুখোমুখি হতে হয়েছিল।
আঠারো শতকের মাঝামাঝি সময়ে বাংলা ছিল রাজনৈতিক অস্থিরতার কেন্দ্রবিন্দু। ইউরোপীয় উপনিবেশবাদী শক্তিগুলোর জন্য বাংলার ইতিহাসের এ সময় ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ১৭৫৬-৫৭ সালের ঘটনাবলি বিশেষ করে ফোর্ট উইলিয়ামের অবরোধ, অন্ধকূপ হত্যাকাণ্ড ও ব্রিটিশদের দ্বারা কলকাতার পুনর্দখল বিশ্বব্যাপী আলোড়ন তুলেছিল। লন্ডন থেকে লেইডেন, হামবুর্গ থেকে প্যারিস ইউরোপীয় সংবাদপত্রে এ ঘটনাগুলো নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা হয়েছিল।
এসসি হিলের Bengal in 1756-57 গ্রন্থটিতে এ সময়ের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। ঐতিহাসিক দলিল ও নথির এ বিশদ সংকলনটি বাংলা অঞ্চলের রাজনৈতিক ও সামরিক পরিস্থিতি তুলে ধরেছে। গ্রন্থটি বিভিন্ন সূত্র যেমন তৎকালীন কর্মকর্তাদের পত্রাবলি ও ইউরোপীয় সংবাদপত্রের প্রতিবেদন থেকে সমকালীন দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছে। গ্রন্থটিতে সংকলিত ইউরোপীয় সংবাদপত্র যেমন Recueil des Gazettes de France ও Gazette d’Utrecht-এর প্রতিবেদনগুলো এ সময়ে ঘটে যাওয়া নানা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার গভীর প্রভাব নিয়ে আলোচনা করে। সংবাদপত্রের বিভিন্ন প্রতিবেদন উঠে আসে নবাব সিরাজউদ্দৌলার নানা পদক্ষেপ কীভাবে বাংলায় ইউরোপীয় শক্তিকে প্রভাবিত করেছিল।
Gazette d’Utrecht-এর ২ জুন, ১৭৫৭ প্রকাশিত এক প্রতিবেদন নবাব সিরাজউদ্দৌলার অভিযান সম্পর্কে উদ্বেগজনক তথ্য প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘১৭৫৬ সালের জুনে প্রায় এক লাখ সৈন্য নিয়ে নবাব কলকাতার দিকে অগ্রসর হন এবং ইংরেজদের পুরোপুরি বিস্মিত করেন। অনেক ইংরেজ নিহত হয় এবং তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়। ফরাসি কোম্পানির এক কর্মকর্তার বরাতে বলা হয়, নবাবের এ প্রতিশোধ ইংরেজদের দ্বারা এক পলাতক মন্ত্রীর আশ্রয় প্রদানের প্রতিক্রিয়া।’
Recueil des Gazettes de France-এর ২৬ নভেম্বর, ১৭৫৭ একটি প্রতিবেদন এ ঘটনাগুলোর সত্যতা নিশ্চিত করে। এতে বলা হয় ‘কলকাতায় এক মুসলমান রাজকুমারকে আশ্রয় দেয়া নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে উত্তেজিত করেছিল। ফলে ইংরেজদের কাশিমবাজার কারখানা ধ্বংস ও ফোর্ট উইলিয়াম দখল হয়। ফরাসি ও ডাচ বসতি স্থাপনকারীরা ইংরেজ পরিবারগুলোকে আশ্রয় দিলেও ডাচদের কাছ থেকে ২০ লাখ রুপি দাবি করে নবাব চাপ সৃষ্টি করেন। যদিও তারা আলোচনা করে দাবি কমিয়ে ৪ লাখ রুপিতে আনতে সক্ষম হয়। এতে ডাচরা সরাসরি সংঘর্ষ এড়াতে সক্ষম হয়েছিল।’
ঘটনাপ্রবাহে নবাবের বিরুদ্ধে ব্রিটিশদের দ্রুত ও কঠোর অবস্থানের উল্লেখ পাওয়া যায়। অ্যাডমিরাল ওয়াটসনের নৌবহর কাশিমবাজারে আঘাত হানে, যা অনেকের মতে অযৌক্তিক অজুহাতের ভিত্তিতে করা হয়। তবে Recueil des Gazettes de France-এর ২৪ জুন, ১৭৫৮ প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ‘১৭৫৭ সালের ২ জুলাইয়ের চিঠিতে ব্রিটিশ বাহিনীর দুর্দশার উল্লেখ ছিল। চন্দননগরের অবরোধ এবং পরবর্তী যুদ্ধে প্রায় ১ হাজার ৫০০ ইউরোপীয় সৈন্য হতাহত হয়। এ ক্ষতির সঙ্গে রোগব্যাধিও ব্রিটিশদের জনশক্তি উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে দেয়।’
Le Courrier d’Avignon-এর ১ জুলাই, ১৭৫৭ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে ব্রিটিশদের ক্ষয়ক্ষতির একটি ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরা হয়। এতে কলকাতার অবরোধে ৬০ জনেরও বেশি অফিসার নিহত এবং ১৫৮ জন বন্দি হওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়। এ পরাজয় ব্রিটিশ শক্তিকে দুর্বল করলেও তারা পাল্টা আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হয়।
বাংলায় ঔপনিবেশিক শক্তির প্রভাব খাটানোর প্রক্রিয়া ব্রিটিশ বাহিনীর জন্য খুব সহজও ছিল না। ইতিহাসের অন্যতম শক্তিশালী নৌবাহিনী থাকা সত্ত্বে বাংলার ওপর রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তি প্রকাশ করতে গিয়ে প্রায়ই ব্রিটিশদের কঠিন সময়ের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। Recueil des Gazettes de France-এর ২৪ জুন, ১৭৫৮ প্রকাশিত প্রতিবেদনটি ব্রিটিশ বাহিনীর ওপর সংঘাতের প্রভাব তুলে ধরে। বাংলা অঞ্চলে ব্রিটিশ নৌবাহিনীর সীমাবদ্ধতা ও সরবরাহ সংকট দীর্ঘমেয়াদি অভিযানের অপারগতার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ‘গঙ্গায় ব্রিটিশদের মাত্র দুটি যুদ্ধজাহাজ চলাচলের উপযোগী রয়েছে। একটি ৬০ বন্দুকবিশিষ্ট, অন্যটি ৫৪ বন্দুকবিশিষ্ট, সঙ্গে একটি ফ্রিগেট। বাকি জাহাজগুলো অচল ঘোষণা করা হয়েছে।’
ব্রিটিশদের সরবরাহ সংকট স্পষ্ট ছিল। ওই প্রতিবেদনে জানানো হয়, সংঘাতের কারণে সে বছর গঙ্গা থেকে ইউরোপে কোনো বাণিজ্য জাহাজ পাঠানো সম্ভব হয়নি। একটি নিরপেক্ষ জাহাজ পন্ডিচেরিতে এসে জানায়, ব্রিটিশ নৌবহরের বেশির ভাগ জাহাজ অচল হয়ে পড়েছে, মাত্র কয়েকটি যুদ্ধজাহাজ কার্যকর অবস্থায় ছিল।
তবে নানা সংকটের মধ্যেও বাংলায় নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয় এবং ব্রিটিশদের রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার দমিয়ে রাখা যায়নি। এক্ষেত্রে কূটনৈতিক বিভিন্ন চাল ও নবাবের ঘনিষ্ঠদের তার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। Recueil des Gazettes de France-এর ৪ মার্চ, ১৭৫৮ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে পলাশীর যুদ্ধ-পরবর্তী পরিস্থিতির বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যায়। লন্ডনের ১৮ ফেব্রুয়ারি, ১৭৫৮ প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ‘ভাইস অ্যাডমিরাল চার্লস ওয়াটসনের মৃত্যু ঘটে ১৬ আগস্ট, ১৭৫৭-তে।’ একই সঙ্গে সিরাজউদ্দৌলার পরাজয় ও তার পতন নিয়েও প্রতিবেদনটিতে বলা হয়।
আলীনগরের চুক্তি অনুযায়ী ব্রিটিশ ও সিরাজউদ্দৌলার মধ্যে সাময়িক শান্তি প্রতিষ্ঠিত হলেও নবাব তার শর্ত পূরণে ব্যর্থ হন। এ অস্থিতিশীলতা ব্রিটিশদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব কাজে লাগাতে সুযোগ দেয়। সিরাজউদ্দৌলার ওপর অসন্তুষ্ট উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা মীর জাফর ব্রিটিশদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে নবাবের দরবারে একটি গোষ্ঠী তৈরি করেন। মীর জাফরের সহায়তায় ব্রিটিশ বাহিনী কর্নেল ক্লাইভের নেতৃত্বে কাশিমবাজার ও গুরুত্বপূর্ণ কটওয়ার দুর্গ দখল করে।
১৭৫৭ সালের ২২ জুন ব্রিটিশ বাহিনী নদী পার হয়ে সিরাজউদ্দৌলার বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালায়। পরের দিন নবাবের বাহিনী বড় ধরনের পরাজয়ের সম্মুখীন হয়। মীর জাফর ও রায় দুর্লভের পূর্বপরিকল্পিত পক্ষত্যাগ ছিল এ পরাজয়ের মূল কারণ। ২৬ জুন মীর জাফর মুর্শিদাবাদে প্রবেশ করে নবাবের সিংহাসন দখল করেন। সিরাজউদ্দৌলাকে পরে আটক এবং গোপনে হত্যা করা হয় বলে জানা যায়। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, মীর জাফরের পুত্রের নির্দেশেই সিরাজউদ্দৌলাকে হত্যা করা হয়েছিল।
মীর জাফরের সঙ্গে ব্রিটিশদের চুক্তি তাদের জন্য ব্যাপক সুবিধা নিশ্চিত করে এবং বাংলায় তাদের প্রভাবকে স্থায়ী করে। প্রতিবেদনে বলা হয়, এ বিপ্লব বাংলার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বদলে দিয়েছিল এবং ব্রিটিশ আধিপত্যকে মজবুত করেছিল।
১৭৫৭ সালের ঘটনাগুলোর প্রভাব বাংলা ও ইউরোপ উভয় ক্ষেত্রেই অনুভূত হয়। তবে এটিও লক্ষণীয় বাংলায় প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে ব্রিটিশদের জন্য কেবল নবাব সিরাজউদ্দৌলাই একমাত্র অন্তরায় ছিল না। Le Courrier d’Avignon-এর ২৭ মে, ১৭৫৭ প্রকাশিত এক প্রতিবেদন মারাঠা-ফরাসি মিত্রতার বিবরণ দেয়, যা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই আরো তীব্র করে তোলে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘মারাঠারা গঙ্গার তীরের একটি ব্রিটিশ দুর্গ দখল করে। ফলে ব্রিটিশদের নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হয়ে পড়ে।’
ঔপনিবেশিক বাংলার ১৭৫৬-৫৭ সালের ঘটনাবলি শুধু স্থানীয় ইতিহাসেই নয়, ইউরোপীয় রাজনীতিতেও গভীর প্রভাব ফেলেছিল। সিরাজউদ্দৌলার শাসন, ব্রিটিশদের উত্থান এবং স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক শক্তির দ্বন্দ্ব বাংলাকে এক বৈশ্বিক রাজনীতির কেন্দ্রে পরিণত করেছিল। কলকাতার পতন, পলাশীর যুদ্ধ ও বাংলার ক্ষমতার পালাবদল শুধু ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জন্য নয়, ইউরোপীয় ভূরাজনীতিতেও এক গুরুত্বপূর্ণ মোড় হিসেবে দেখা দেয়। এ সময়ের ইউরোপীয় সংবাদপত্রগুলোর বিশ্লেষণ বাংলার সংকটময় পরিস্থিতি এবং রাজনৈতিক উত্থান-পতনের একটি গুরুত্বপূর্ণ চিত্র তুলে ধরে।
তৎকালীন ইউরোপীয় পত্রিকাগুলোর প্রতিবেদন থেকে স্পষ্ট হয়, কীভাবে বাংলার ঘটনাগুলো ইউরোপীয় শক্তিগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা বাড়িয়েছে। সিরাজউদ্দৌলার পতন ও পলাশীর যুদ্ধের পরবর্তী পরিস্থিতি শুধু ব্রিটিশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পথই প্রশস্ত করেনি, বরং দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতির গতিপ্রকৃতিও বদলে দিয়েছে।
সংবাদপত্রে প্রকাশিত চিঠি ও নথিগুলো থেকে স্পষ্ট হয় ঔপনিবেশিক আধিপত্য কেবল বাহ্যিক সামরিক শক্তির ওপর নয়, স্থানীয় দ্বন্দ্ব ও কূটনৈতিক চালের ওপরও নির্ভরশীল। ১৭৫৬-৫৭ সালের সংঘাত এবং এর প্রেক্ষাপট আজও ইতিহাসের শিক্ষার মূল্য বহন করে। এটি শুধু অতীতের ঘটনার বিবরণ নয়, বরং আধুনিক বিশ্বে ক্ষমতার রাজনীতির গতিপথ বোঝার একটি হাতিয়ার।
আপনার মতামত জানানঃ